একটি সিদ্ধান্তই যেন বাজিমাত করল চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডের ভাগ্য। সময় উপযোগী সিদ্ধান্তটি একেবারে তলানিতে ঠেকে যাওয়া একটি প্রতিষ্ঠানকে পৌঁছে দিয়েছে উন্নয়নের স্বর্ণ শিখরে। পুরো বছরে সর্বসাকুল্যে মাত্র ৬৩ লাখ টাকা আয় করা প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানই যখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল ঠিক তখনি ওই সিদ্ধান্তের ফলে এখন প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক আয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় আশি কোটি টাকায়। শুধুমাত্র ভ্যাট ও ট্যাক্স বাবদ বছরে সরকারকে পরিশোধ করেছে ৪৬ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নেয়া ওই সিদ্ধান্তের সুফল ঘরে তুলতে শুরু করেছে চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেড। সরকারের ওই সিদ্ধান্তের ফলে জনা দশেক মানুষ ও ব্যবস্থাপনা পাল্টে শূন্য থেকে স্বপ্ন ছোঁয়ার অবস্থায় উন্নীত হয়েছে রাষ্ট্রায়াত্ত প্রতিষ্ঠানটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের সমুদ্রগামী জাহাজের একমাত্র ড্রাই ডক চিটাগাং ড্রাই ডক লিঃ (সিডিডিএল) প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। পতেঙ্গা এলাকার সাগরপাড়ের ৫৪ একর জায়গার উপর ড্রাই ডক গড়ে তোলার কাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সালে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে সরকার প্রকল্পটির কাজ স্থগিত করে দেয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলে ১৯৭৩ সালে নতুন করে কাজ শুরু হয়। যুগোশ্লাভিয়ার কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পের কাজ চিটাগাং ড্রাই ডকের নির্মাণ কাজ শেষ করা হয়। ১৯৮৫ সালে সিডিডিএল বাণিজ্যিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের (বিএসইসি) নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানটি সর্বোচ্চ ১৮০ মিটার দীর্ঘ, সাড়ে আট মিটার ড্রাফট এবং ২৪ মিটার প্রস্থের জাহাজ ডকিং করে মেরামত করতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটি দেশের সমুদ্রগামী জাহাজের একমাত্র ড্রাই ডক হিসেবে কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। প্রতিষ্ঠানটির দুটি জেটি রয়েছে। এর একটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯৭০ সালে। দীর্ঘদিন যাবত এই জেটির সংস্কার ও মেরামত যথাযতভাবে না হওয়ায় এটি অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অপরদিকে ড্রাই ডকের ড্রাফট সাড়ে আট মিটার হলেও দীর্ঘদিন ধরে জেটি এলাকায় ড্রেজিং না করার ফলে নদীর নাব্যতা কমে যায়। ফলে ৭.৫ মিটারের বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হতো না। অপরদিকে সিডিডিএলের দুটি ডক ক্রেন এবং দুটি জেটি ক্রেন দীর্ঘদিনের ব্যবহারে নাজুক অবস্থায় পড়ে। এক পর্যায়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। উপরোক্ত কারণে চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেড ব্যবসা হারাতে শুরু করে। দিন দিন এক ভয়াবহ অবস্থায় পর্যবসিত হয়ে ২০১৫ সালে পরিস্থিতি একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে যে, সরকারের দেয়া নতুন পে স্কেলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা কর্মচারীদের বেতন ভাতা দেয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠানটি মাত্র ৬৩ লাখ টাকা আয় করে। ভয়াবহ রকমের নাজুক ওই অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির ভাগ্য বিপর্যয়ের আশংকা করা হচ্ছিল।
কিন্তু দেশের শিপিং সেক্টরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে সরকার খুব দ্রুত একটি কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ওই সময় নীতি নির্ধারকদের অনেকেই বিরোধিতা করলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডকে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের কাছ থেকে নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। আর এই সিদ্ধান্তই যেন প্রতিষ্ঠানটির ভাগ্য ফিরিয়ে দেয়। ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর দায়িত্ব পাওয়ার পর নৌ বাহিনী প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী ও অস্থায়ী সব কর্মকর্তা কর্মচারীকে স্ব স্ব অবস্থানে রেখে শুধু ব্যবস্থাপনায় জনা দশেক লোক পাল্টে দেয়। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ শীর্ষ পদের আসা নতুন কর্মকর্তারা প্রতিষ্ঠানটির সমস্যা চিহ্নিতকরণ থেকে শুরু করে বিভিন্নমুখী কার্যক্রম হাতে নেন। এরমধ্যে শুরুতেই ড্রাই ডকের সামনে নদী ড্রেজিং করে ৭.৫ মিটারের পরিবর্তে ৮.৫ মিটারের জাহাজ ভেড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। এতে করে ডকের সামনের অংশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে যেসব জাহাজ ডকিং করতে পারতো না, সেসব জাহাজও অনায়াসে ডকিং করার সুযোগ পায়। প্রায় অচল হয়ে যাওয়া ডক ক্রেন এবং জেটি ক্রেন মেরামত করা হয়। এতে করে সিডিডিএল পুরোপুরি সক্ষম হয়ে উঠে। বাড়ানো হয় সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ। ফলে চট্টগ্রাম ড্রাই ডক লিমিটেড ২০১৫ পূর্ববর্তী দূরাবস্থা থেকে দ্রুত ফিরতে শুরু করে। ২০১৪-২০১৫ সালে মাত্র ৬৩ লাখ টাকা আয় করা প্রতিষ্ঠানটি পরের বছরই আয় করে চার কোটি ৪৭ লাখ টাকা। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে আয় করে ৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। আর পেছনে ফিরতে হয়নি প্রতিষ্ঠানটিকে। নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছরই প্রতিষ্ঠানটির লাভের অংক আকাশমুখে ছুটছে। সব ধরনের ভ্যাট ট্যাক্স বাদ দিয়ে আয় করা এই অর্থের পরিমাণ প্রতি বছরই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটি নিট মুনাফা করে ৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। পরের বছর (২০১৮-২০১৯) মুনাফার পরিমান দাঁড়ায় ৫৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকায়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে মুনাফার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৮ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরে শুধুমাত্র ভ্যাট এবং ট্যাক্স বাবদ সরকারকে প্রদান করা হয়েছিল ৪৬ কোটি টাকা। শুধুমাত্র ব্যবস্থাপনা পাল্টে ফেলার সরকারি একটি সিদ্ধান্তের ফলে ড্রাই ডকের ইতিহাসে এমন আকাশ ছোঁয়ার গল্প তৈরি হয়েছে বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করেছেন।
চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৮৫ কোটি টাকা। তবে এর বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ২৯৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। অপরদিকে ওই বছর বিক্রয় লক্ষ্যমাত্রা ছিল টাকা ৩০০ কোটি। অর্জিত হয়েছে ৩০০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। এভাবে ড্রাই ডকের ইতিহাসে শুধু সাফল্যের পালক যুক্ত হয়েছে গত ৬ বছরে।
বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত উপস্থাপন করে প্রতিষ্ঠানটির শীর্ষ একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, আগে বছরের বেশির ভাগ সময়ই ড্রাই ডকে কোনো জাহাজ থাকতো না। কাজও থাকতো না। অথচ এখন প্রতিদিনই ড্রাই ডক ব্যস্ত বিভিন্ন কার্যক্রমে। তিনি বলেন, সিডিডিএল বাণিজ্যিক ও যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের ক্ষেত্রে আইএসও সার্টিফাইড একটি প্রতিষ্ঠান। ইতোমধ্যে তারা বিআইডব্লিউটিসির জন্য দুটি কন্টেনার ভেসেল তৈরি করে সফলভাবে হস্তান্তর করেছে। জাহাজ মেরামতের পাশাপাশি বার্জ, টার্গেট ভেসেল, পন্টুন, কজওয়ে, গ্যাংওয়ে, মুরিং বয়, লাইটিং বয়, চ্যানেল মার্কিং বয়, স্টীল ফুটওভার ব্রিজ প্রভৃতি নির্মাণ করছে। অপরদিকে সিডিডিএল সমুদ্রগামী জাহাজ মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান হলেও পর্যাপ্ত সক্ষমতার অভাবে জাহাজের ইঞ্জিন মেরামত বা রিপ্লেসমেন্টসহ জটিল কাজগুলো করতে পারতো না। বর্তমানে ডকের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতকরণসহ এ খাতের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিজস্ব জনবল দ্বারা জাহাজের ইঞ্জিন মেরামত ও প্রতিস্থাপনের পাশাপাশি সকল ধরনের মেরামত কাজও সম্পন্ন করা হচ্ছে। এতে করে ড্রাই ডকের কার্যক্রম এবং উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক বছরের মধ্যে ২৬টি জাহাজের মেরামত কাজ করা হয়েছে। উক্ত কাজের জন্য ড্রাই ডক ব্যবহার হয়েছে ৩৪০ দিন। এটিই ড্রাই ডকের ইতিহাসে কোনো বছরে সর্বোচ্চ ব্যবহার বলেও ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল চিটাগাং ড্রাই ডক লিমিটেডে গত চার বছরেরও বেশি সময় ধরে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালনকারী কমোডর এম নাজমুল করিম কিচলুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, একটি ভিশন সামনে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিডিডিএল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানটিকে উজ্জীবিতকরণ, অধিকতর লাভজনক ও বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা এবং দেশের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উন্নয়ণের লক্ষ্যে ২০১৫ সালের ২৩ ডিসেম্বর যুগান্তকারী এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওই ভিশন সফল করার লক্ষ্যে কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের আরো এগুতে হবে। তিনি গত অর্থবছরে প্রায় আশি কোটি টাকা লাভ করার কথা স্বীকার করে বলেন, শুধু লাভই নয়, প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী এবং অস্থায়ী মিলে হাজার দেড়েক মানুষ এবং তাদের পরিবার পরিজনের ভাগ্যোন্্নয়নসহ সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি আমরা। আমাদের স্বপ্ন সবাইকে সাথে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের বহুমুখী চেষ্টা চলছে বলেও জানান কমোডর এম নাজমুল করিম কিচলু।