প্রকৃত নাম সানোয়ার হোসেন। পরিচয় সাখাওয়াত হোসেন হিসেবে। বেশ কয়েক বছর ধরে সারাদেশের ন্যায় চট্টগ্রামে প্রতারণার জাল বিস্তার করে সানোয়ার। ‘কাস্টমস অফিসার’ পদবি ধারণ করে নকল আইডি কার্ডও রয়েছে তার। সহজে বোকা বানিয়ে বন্দর থেকে কম দামে নিলামের গাড়ি কিনে দেওয়ার নামে অসংখ্য লোকজনের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লক্ষ লক্ষ টাকা। প্রত্যেকটি ঘটনাতে বন্দর কর্মচারীদের যোগসাজশে ‘প্রতারণার শিকারকে’ নিয়ে বন্দর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন সানোয়ারের অধীনস্থ প্রতারকরা।
চলতি বছরের ১ ফেব্রুয়ারি ডবলমুরিং থানার একটি মামলায় বন্দর কর্মচারীসহ ৬ আসামিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতে দেওয়া জামিন বাতিল আবেদনে এসব প্রতারকদের বন্দরের জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) উপ-পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন। ওই আবেদনে উপ-পরিদর্শক মহিউদ্দিন উল্লেখ করেছেন, প্রতারকরা যেভাবে বন্দরে প্রবেশ করেছে, সে হিসেবে উগ্রজঙ্গিরাও বেশ ধারণ করে বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের এসব কর্মচারীদের ম্যানেজ করে যেকোন সময়ে বন্দরে প্রবেশ করে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে পারে।
তিন বছর ধরে প্রতারণার জাল বিস্তার করে আসলেও সাখাওয়াতকে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ফলে এসব ঘটনায় ডবলমুরিং থানায় সাখাওয়াতের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া একটি মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে হয়েছে পুলিশকে। আরেকটি মামলায় একজনের নামে অভিযোগপত্র দিলেও মামলার আসামি সাখাওয়াতকে চিহ্নিত করতে না পারায় তার নামে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। তবে হাল ছেড়ে দেননি পুলিশ। সর্বশেষ আরেকটি প্রতারনা করতে এসে গত ৩০ সেপ্টেম্বর নগরীর দেওয়াট হাট এলাকায় সানোয়ার হোসেন ধরা পড়ে ডবলমুরিং থানা পুলিশের হাতে। এসময় তার কাছ থেকে সাখাওয়াত নামে ‘অফিসার কাস্টমস’ পদবী উল্লেখ করা একটি আইডি কার্ড উদ্ধার করে গ্রেপ্তারকারী তদন্ত কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক তারেক আজিজ। গত ১ অক্টোবর আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেয় সানোয়ার প্রকাশ ‘কাস্টমস অফিসার’ সাখাওয়াত। তবে ঘটনায় অন্য প্রতারক আসামিদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারলেও থানার রুটিন কাজের কারণে অভিযানে যেতে পারেননি বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন তিনি। এরমধ্যে বন্দর থানায় গত ১ ফেব্রুয়ারি দায়ের হওয়া আরেকটি প্রতারনার মামলায় ১৭ হতে ১৯ নভেম্বর ঢাকা, সাভার ও চট্টগ্রামে টানা অভিযান চালিয়ে অন্য ৬জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। পুলিশের ধারণা গ্রেপ্তারকৃত এই ৭জন প্রত্যেকটি ঘটনায় জড়িত। প্রতারকচক্রটি বন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের নিরাপত্তা প্রহরীদের ব্যবহার করে ভুক্তভোগীদের বন্দরে নিয়ে নিলামের গাড়ি দেখিয়ে নিয়ে আসেন। এতে বিশ্বাস করে প্রতারকের হাতে টাকা তুলে দেয় প্রতারনার শিকার ভুক্তভোগীরা। ভুক্তভোগীদের একজন মানিকগঞ্জের বাসিন্দা শাহিনুর রহমান রহমান হালিম। বন্দর থেকে কম দামে অকশনের (নিলামের) গাড়ি কিনে দেওয়ার নামে প্রতারকরা তার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় ১০ লাখ ১৯ হাজার টাকা।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডি চট্টগ্রাম মেট্রোর উপ-পরিদর্শক মো. মহিউদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘প্রতারকরা নিজের নাম গোপন করে অন্য নাম ধারণ করে। সবসময় ‘শাটিং স্যুটিং’ চলাফেরা করতো। সত্যিকারের কাস্টমস কর্মকর্তাদের বেশভূষা নিত। টার্গেটকে কাস্টমস হাউজের অভ্যন্তরে এনে টাকা লেনদেন করতেন তারা। পরে টাকা নিয়ে সটকে পড়েন। পাশাপাশি মোবাইল ও সিম নষ্ট করে ফেলে দেন।’ তিনি বলেন, ‘মামলার আসামি নজরুলকে গ্রেপ্তারের পর অন্যদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। তবে নজরুল তার আসল নাম নয়। আসল নাম মহিদুল ইসলাম সরকার। অন্যদিকে সাখাওয়াত নিজেকে ‘সহকারী কমিশনার কাস্টমস’ পরিচয় দেয়। মহিদুল ইসলাম সরকার প্রকাশ নজরুল নিজেকে কাস্টমস কর্মকর্তা এবং সহকারী কমিশনার কাস্টমসের পিএ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। গ্রেপ্তার হওয়া আরেকজন মোবারক হোসেন প্রকাশ প্রতারক সুমন মহিদুল ইসলাম প্রকাশ নজরুলকে তার মামা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন ভুক্তভোগীকে। নজরুল ভুক্তভোগীদের বন্দর অভ্যন্তরে প্রবেশ করানোর জন্য বন্দরের ক্যাজুয়াল কর্মচারী ইউসুফকে কন্ট্রাক্ট করে। ইউসুফ কন্ট্রাক্ট করে বন্দরের স্থায়ী কর্মচারী সিকিউরিটি গার্ড নুরুল আবছার ও অন্য ক্যাজুয়াল কর্মচারী পিয়ন রুহুল আমিনকে। এরপর ভুক্তভোগীর পক্ষে তার এক বন্ধু আমিনুল ইসলামকে ইউসুফের মাধ্যমে বন্দরে প্রবেশ করিয়ে একটি ২০০৫ মডেলের এঙ নোহা দেখান প্রতারকরা। এরপর বাদী গাড়িটি কিনতে আগ্রহ প্রকাশ করলে চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কাস্টমসের পেছনে সোনালী ব্যাংকের গেইটে বসে হালিমের কাছ থেকে বস্তাভর্তি ১০ লাখ ১৯ হাজার টাকা নেয় সানোয়ার হোসেন প্রকাশ প্রতারক সাখাওয়াত। এরপর সাখাওয়াত ভুক্তভোগী হালিমকে বলেন, ‘আপনি ৪নং গেটে যান, গাড়ির ডকুমেন্ট রেডি হচ্ছে। ৪নং গেট থেকে গাড়ি বুঝে নেবেন। এরপর হালিম ৪নং গেটে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর কাউকে না পেয়ে সাখাওয়াতের মুঠোফোনে ফোন করলে তার ফোন বন্ধ পেলে বুঝতে পারেন তিনি প্রতারনার শিকার হয়েছেন। এরপর বন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।’
এ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছি। সানোয়ারকে এই মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। তাকে রিমান্ডে এনে তাদের চক্রে আর কারা জড়িত তাদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে।’ তিনি বলেন, এভাবে বন্দরের কর্মচারীদের ম্যানেজ করে প্রতারকরা সহজে বন্দর অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। বন্দর একটি কেপিআইভুক্ত (জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) এলাকা। এভাবে যেকোন অপরাধী সহজে বন্দরে প্রবেশ করে যেকোন নাশকতামূলক আরো বড় ঘটনা ঘটাতে পারে।
অন্যদিকে ডবলমুরিং থানার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক তারেক আজিজ বলেন, গত ১১ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার উবার চালক মো. ইব্রাহীম ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ইব্রাহীমকে বন্দর থেকে কমদামে নিলামের গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে প্রতারকরা ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। ওই মামলায় প্রতারক সাখাওয়াতকে আসামি করা হয়নি। তবে মামলায় সন্ধিগ্ধ একজনকে গ্রেপ্তারের পর প্রতারক সাখাওয়াতের খবর পাই। সে গত ৩০ সেপ্টেম্বর একই কায়দায় আরেকটি প্রতারনার কাজ করতে আসলে কৌশলে দেওয়ান হাট মোড় থেকে তাকে গ্রেপ্তার করি। এরপর মুঠোফোনে ছবি তুলে বাদীকে দেখাইলে সে প্রতারক সাখাওয়াতকে চিহ্নিত করে। এরপর যাচাইবাচাই করে জানতে পারি সাখাওয়াত তার আসল নাম নয়। তার আসল নাম সানোয়ার হোসেন।
এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, বেশ কয়েকবছর ধরে সাখাওয়াতসহ অন্যান্য প্রতারকরা ছদ্মনাম ব্যবহার করে বন্দর থেকে নিলামের গাড়ি কিনে দেওয়ার কথা বলে লোকজনের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে আসছিল। তাকে গ্রেপ্তারের পর জিঞ্জাসাবাদের এক পর্যায়ে সে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। ওই টাকা আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে।
একই কায়দায় ২০১৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নগরীর ডবলমুরিং থানায় একটি মামলা করেন কুমিল্লা জেলার তোফায়েল আহমদ নামের এক ভুক্তভোগী। ওইসময় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জাপানি নোহাবাস নিলামে বিক্রি করবে। আবু তাহের নামে এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে প্রতারকদের সাথে পরিচয় হয়। ওইসময় নোহা গাড়ি কিনে দেওয়ার নামে ১০ লাখ ১৫ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় প্রতারকরা। ওই মামলায় সাখাওয়াতকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে সাখাওয়াতকে চিহ্নিত করতে না পেরে শুধু আবু তাহেরকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অন্যদিকে গত বছরের ১৫ অক্টোবর একই কায়দায় বন্দর থেকে স্ক্যাপ মালামাল নিলামে কিনে দেওয়ার নামে ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় প্রতারক চক্রটি। পরে ২১ অক্টোবর ডবলমুরিং থানায় মামলা দায়ের করেন ভুক্তভোগী বরিশাল জেলার মোখলেসুর রহমান। এখানেও সাখাওয়াত হোসেন নিজেকে কাস্টমসের বড় কর্মকর্তা পরিচয় দেয়। ডবলমুরিং থানায় দায়ের হওয়া মামলাটিতে কোন আসামিকে শনাক্ত করতে পারেননি পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা। পরে মামলাটি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিআইডি কার্যালয়ে কথা হলে সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শাহনেওয়াজ খালেদ বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নিলামের এঙ নোহা কিনে দেওয়ার কথা বলে প্রতারকরা ভুক্তভোগী হালিমের কাছ থেকে ১০ লাখ ১৯ হাজার টাকা টাকা নেয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে বন্দর থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলায় আমরা প্রতারক চক্রের তিনজনকে ঢাকা ও সাভারে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করি। পরে তাদের তথ্য মতে চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত তিন কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করি। শুধু এই মামলা নয় বন্দর ও ডবলমুরিং থানায় কমপক্ষে চারটি মামলার খবর পাওয়া গেছে, যেগুলোতে একই চক্র নিলামের গাড়ি ও স্ক্র্যাপ কিনে দেওয়ার নামে লোকজন থেকে ৫০ লাখ টাকার বেশি হাতিয়ে নিয়েছে।
পুলিশের এ সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, ‘বন্দরের কর্মচারীদের ম্যানেজ করেই প্রতারকরা ভুক্তভোগীদের বন্দর অভ্যন্তরে ঢুকাতে সমর্থ হয়েছে। ভুক্তভোগী যদি বন্দরে প্রবেশ করতে না পারতেন তাহলে হয়তো প্রতারকদের সহজে টাকা দিয়ে দিতেন না। প্রতারনার শিকারও হতেন না।’ এখন চুড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া মামলাগুলোও উজ্জীবিত করা যাবে এবং সানোয়ারসহ সম্পৃক্ত অন্যদের আসামি করে আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করেন এ উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (নিরাপত্তা) লে. কর্নেল আহমেদ জুনাইদ আলম খান টেলিফোনে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বন্দর সচিবের সাথে কথা বলতে বলেন। পরে যোগাযোগ করা হলে সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হওয়া কর্মচারীদের বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উল্লেখ করেন বন্দরের সচিব ওমর ফারুক। তিনি মুঠোফোনে দৈনিক আজাদীকে বলেন, ‘অন্যের গেটপাস ব্যবহার করে কোন একজন বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। এটি খুবই নগন্য ঘটনা। তবে ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করা হয়েছে। এটি বন্দরের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার মতো ঘটনা নয় বলে দাবি করেন তিনি।