এক সপ্তাহের মধ্যে ট্যারিফ সমস্যার সমাধান না হলে বন্দর বন্ধ

পোর্ট ইউজার্স ফোরামের আল্টিমেটাম আজ থেকে ৪ ঘণ্টার কর্মবিরতি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২৫ at ৯:৩৪ পূর্বাহ্ণ

বর্ধিত ট্যারিফ আদায় বন্ধ না করলে আজ থেকে ৪ ঘণ্টা করে কর্মবিরতি এবং এক সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেয়ার আল্টিমেটাম দিয়েছেন পোর্ট ইউজার্স ফোরামের নেতৃবৃন্দ। তারা বলেছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বিভিন্ন সেবায় অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ট্যারিফ আরোপ করা হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নতুন ট্যারিফ সমস্যার সমাধান না হলে চট্টগ্রাম বন্দর বন্ধ করে দেওয়া হবে। গতকাল শনিবার দুপুরে নগরীর নেভি কনভেনশন হলে আয়োজিত পোর্ট ইউজার্স ফোরামের প্রতিবাদ সভা থেকে এ হুঁশিয়ারি দেয়া হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন সেবায় বর্ধিত ট্যারিফ আরোপের প্রতিবাদে এ সমাবেশের আয়োজন করে পোর্ট ইউজার্স ফোরাম। সমাবেশে বন্দর ব্যবহারকারী বিভিন্ন সংগঠনের আড়াই হাজারের বেশি ব্যবসায়ী উপস্থিত ছিলেন। তারা হাত তুলে বর্ধিত ট্যারিফ স্থগিতের দাবি জানান।

ব্যবসায়ী সমাবেশে বক্তারা বলেন, ব্যবসায়ীদের আপত্তি উপেক্ষা করে গত ১৪ সেপ্টেম্বর বন্দরের নতুন ট্যারিফের গেজেট প্রকাশ করা হয়। ১৫ অক্টোবর থেকে নতুন ট্যারিফ কার্যকর হয়। বন্দরের ৫২টি সেবা খাতে আগের তুলনায় গড়ে প্রায় ৪১ শতাংশ হারে ফি ও মাশুল বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিদেশি অপারেটরদের সুবিধা দিতে নতুন ট্যারিফ কার্যকর করা হচ্ছে বলে তারা সমালোচনা করেন।

ফোরামের সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি এস এম আবু তৈয়বের সঞ্চালনায় সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক এম এ সালাম। বক্তব্য দেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক আমিরুল হক, বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু, এমডিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস এসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম, চিটাগাং ইনল্যান্ড ভেসেল ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি হাজী সফিক আহমেদ, শিপিং এজেন্টের শাহেদ সরওয়ার, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচি, শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. পারভেজ আকতার ও বিপণী বিতান ব্যবসায়ী সমিতির নেতা শারুদ নিজাম।

সভাপতির বক্তব্যে আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বর্ধিত মাশুল স্থগিত করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত ট্যারিফ নির্ধারণ করতে হবে। এই দাবিতে আগামীকাল রোববার থেকে চার ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করবেন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা। এক সপ্তাহের মধ্যে সমাধান না হলে বড় কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

ব্যবসায়ী নেতা আমিরুল হক বলেন, ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে যখন প্রশাসকেরা বসেছিলেন, সেই সময় মাশুল বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এটা হতে দেওয়া যাবে না। আমরা বিদেশি অপারেটরের বিরুদ্ধে নই। দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আপনি বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেন। কিন্তু ট্যারিফ বাড়িয়ে বিদেশি অপারেটর নিয়োগ দেওয়া যাবে না। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, মাশুল বাড়ানোর জন্য আগামী দিনে বন্দর বন্ধ হলে এর জন্য আপনারাই দায়ী থাকবেন।

এম এ সালাম বলেন, ব্যবসায়ীরা দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি। ৮৫ শতাংশ আমদানিরপ্তানি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে হয়। বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। আমি বিশ্বাস করি, আমরা একসঙ্গে না বললে সমাধান হবে না।

তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর একটি সেবাধর্মী সংস্থা। এই সেবাকেন্দ্র লোকসানে নেই। আড়াইতিন হাজার কোটি টাকা লাভ করছে। তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে কেন এত কারসাজি? ট্রেইলার ধর্মঘট শুরু হয়েছে, আমাদের কন্টেনার যাবে না। আমরা বন্দরের ট্যারিফ শিডিউল পুনর্নির্ধারণ করার দাবি জানাই। তিনি বলেন, মোংলা ও পায়রা বন্দরে মাশুল বাড়ানো হয়নি। শুধু বাড়ানো হয়েছে চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম বন্দর লাভে আছে। তাহলে কেন এই কারসাজি?

এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ট্রাম্পের ট্যারিফে পৃথিবীতে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। যে সরকার আমেরিকা গিয়ে ট্যারিফ কমায় সেই সরকার বন্দরে ট্যারিফ বাড়ায়। এতে দেশের ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন। এ ট্যারিফ অযৌক্তিক মনে করি। ইতিমধ্যে এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

বাফার পরিচালক অমিয় শঙ্কর বর্মণ বলেন, বন্দর ও অফডক একসঙ্গে ট্যারিফ, চার্জ বাড়িয়েছে। তা অসহনীয়। কোনো ক্ষেত্রে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

এমডিএম মহিউদ্দিন বলেন, বন্দরের নতুন ট্যারিফে ব্যবসায়ীরা প্রাথমিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার অনুরোধ জানাই। আমেরিকার ট্যারিফ নিয়ে আমরা কেউ সুখে নেই। আমাদের এই দুর্দিনে বন্দরের ট্যারিফ বৃদ্ধি কাম্য নয়।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সাইফুল আলম বলেন, ব্যবসায়ীদের জন্য দুঃসংবাদ। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা। বন্দর অর্থনীতির লাইফ লাইন। এটা শেষ করতে নানা ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আমদানিরপ্তানিকারকের ব্যথা আমরা জানি। ১২ টাকার ফি ১১৫ টাকা করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যাবে। নতুন ট্যারিফ কমানো না গেলে ব্যবসায়ীদের যাওয়ার জায়গা থাকবে না। সিঅ্যান্ডএফের ১৩ হাজার শ্রমিককর্মচারী এ খরচের বোঝা নিয়ে কাজ করতে অপারগ।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা অত্যন্ত কনসার্ন। বন্দর কোনো কোনো ক্ষেত্র ৪৪০ শতাংশ ট্যারিফ বাড়িয়েছে। পোর্ট লিমিট বাড়ানোর সময় ট্যারিফ বাড়ানো হয়েছে। পাইলটিং, পোর্ট ডিউজ দিতে হচ্ছে। কস্ট বেইজড ট্যারিফ হওয়া উচিত। শিপ ওনার চার্জ বাড়িয়ে দেবে। শিল্পবাণিজ্য ক্ষেত্রে অচলাবস্থা তৈরি হবে। আমাদের শেষ ভরসা প্রফেসর ইউনূস। ট্যারিফ বাড়াতে হলে স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে বাড়াতে হবে।

বন্দর ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির সোহেল বলেন, বন্দরের নতুন ট্যারিফ শিডিউলে ৫৭ টাকার গেট পাস ২৩০ টাকা করা হয়েছে। আমাদের ১২ হাজার গাড়ি আছে বন্দরে। ২৩ হাজার টাকায় ট্রিপ মেরে ৫০০ টাকা আয় হয় না, আমার ওপর ৩০ হাজার টাকা আয়কর।

চট্টগ্রাম প্রাইম মুভার ও ফ্লাটবেড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, আমাদের ১৫ হাজার গাড়ি, ১০ হাজার শ্রমিক। ১৫ বছর বলার পরও বন্দর টার্মিনাল দিচ্ছে না। বন্দরে চালকদের ওয়াশ রুম, ক্যান্টিন নেই। তিন ধরনের ট্যাঙ দিই। এখন নতুন করে বন্দর ৫৭ টাকার পাসের ফি ২৩০ টাকা করেছে। একজন মানুষ কতবার ট্যাক্স দেবে? এটা সংস্কার করা দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৪০ বছর পর বাস্তবতার ভিত্তিতে সমন্বিত ট্যারিফ, কার্যকর না হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে
পরবর্তী নিবন্ধনাশকতার প্রমাণ পেলেই কঠোর পদক্ষেপ