মা এবং সন্তান- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পর্ক। এই নিবিড় সম্পর্ক অটুট এবং চিরন্তন। জন্মের পর থেকেই সন্তানের মাঝে একজন মা তাঁর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পান, নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিয়ে সন্তানকে প্রতিপালন করেন। তাঁর স্বপ্ন সন্তান বড় হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, তাঁর মুখ উজ্জ্বল করবে। আর আমাদের দেশের দরিদ্র মধ্যবিত্ত পরিবারের মায়েরা তাঁদের সন্তানদেরকে যেভাবে মানুষ করেন তাতে সন্তানদেরকে নিয়ে তাদের প্রত্যাশা অনেক বেশি থাকে। সন্তানদের সাথে এই মায়েদের বন্ধন অনেক গভীর। ছেলে ঘরের বাইরে গেলে ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মায়ের মানসিক অস্থিরতা কাটে না। দরজার বাইরে গিয়ে ছেলের আগমনের অপেক্ষায় থাকেন। ছেলেকে দেখা মাত্র মায়ের যে আনন্দ সেটা একমাত্র মা’ই উপলব্ধি করতে পারেন।
১৯৭১ সাল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালী জাতির জন্য একটি চরম পরীক্ষা। এই পরীক্ষা আমাদের জীবন-মৃত্যুর পরীক্ষা। পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে হবে। এদেশের কিশোর-যুবক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রশিক্ষণ নিয়ে পাক সেনাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এই প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের হাজার হাজার ছেলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যায়। এ দেশের গ্রাম-গঞ্জের ছেলেরা যখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল, তখন মায়েরা তাদের ছেলেদেরকে কোন বাধা দেননি। বরং সর্বস্ব দিয়ে তাদেরকে সাহায্য করেছেন। এই মায়েদের অনেকেই লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু দেশের প্রতি তাঁদের যে অকৃত্রিম মায়া তারই প্রতিফলন ঘটেছিল তাঁদের এই মহান ত্যাগের মধ্য দিয়ে। এই মা’দের ঋণ বাঙালী জাতি কখনও শোধ করতে পারবে না।
আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। চট্টগ্রাম জেলার মিরসরাই থানার একটি নিভৃত গ্রামের মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান আমি। মা ও নানির অত্যন্ত আদরে লালিত পালিত। স্কুল জীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসাবে সকলের নিকট পরিচিত ছিলাম। ১৯৬৪ সালে জোরারগঞ্জ মডেল হাই স্কুল থেকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় জুনিয়ার বৃত্তি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দশম স্থান অধিকার করি।
এস.এস.সি বিজ্ঞান বিভাগে মেধাবৃত্তিসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হই। থাকতাম কলেজ হোস্টেলে। একদিন ছুটি পেলেই মা ও নানিকে দেখার জন্য গ্রামে ছুটে যেতাম। মাও অপেক্ষা করে থাকতেন কখন আমি বাড়ি আসব। আমাকে তাঁর হাতের তৈরী পছন্দের খাবারটি খাওয়াতে পারবেন।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস। আমি তখন চট্টগ্রাম কলেজ থেকে বি.এস-সি পরীক্ষার্থী। পঁচিশে মার্চ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও আমি চট্টগ্রাম শহরে ছিলাম। ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর শত্রুমুক্ত ছিল। ৭ই এপ্রিল কোর্ট বিল্ডিং দখল করে পাক সেনারা যখন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা উড়াল, তখন বুঝতে পারলাম চট্টগ্রাম শহরে থাকা আর নিরাপদ নয়। আমি আমার এক বন্ধুসহ পায়ে হেঁটে এবং রিঙায় গ্রামে গিয়ে পৌঁছালাম। গ্রামে গিয়ে সকল ছেলেদেরকে উদ্ধুদ্ধ করতে থাকি মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য। গ্রামের শিক্ষিত-অশিক্ষিত সকলের অগাধ বিশ্বাস ছিল আমার উপর। অভিভাবকেরা যখন জানতে পারল আমি যাচ্ছি, তখন সবাই তাদের ছেলেদেরকে পাঠাতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমার যোগাড় হয়ে গেল একটি বড় দল- ৭০ জন।
জুন মাস। বৃষ্টির দিন। একটি অন্ধকার রাতে যাত্রার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাত্রার পূর্বে বিদায়ের পালা এই বিদায় কিন্তু সহজ বিদায় নয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের বিদায়। কিন্তু গ্রামের অশিক্ষিত দরিদ্র মায়েরা সেদিন কি মন্ত্রে মুগ্ধ হয়ে তাঁদের প্রিয় সন্তানদেরকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তা আজও আমার বোধগম্য হয়না। আমি শুধু উপলব্ধি করতে পারি তাঁদের কঠিন দেশপ্রেম।
আমার মা লেখাপড়া জানতেন না। তাই আমাকে লেখাপড়া করিয়ে নিজের জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে চেয়েছেন। আমাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখেছেন। সেই মা আমাকে যুদ্ধে পাঠাচ্ছেন। আমার এই যাত্রা যে কতটুকু নিরাপদ সবই তিনি জানতেন। সেই মুহূর্তে একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন ছিল অত্যন্ত বিপদ-সংকুল। মায়ের কাছে ফেরত আসার সম্ভাবনা ছিল শতকরা বিশ ভাগ। তারপরও তিনি আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন এবং আমাকে বিদায় জানালেন। ঐ মুহূর্তে তাঁর হাতে টাকা ছিল না। তাঁর সম্বল একটি সোনার আংটি এবং দশ টাকার একটি নোট আমার হাতে দিলেন। এইটি ছিল আমার জন্য একটি বিরাট সম্পদ। ভারতে গিয়ে আংটিটি বিক্রি করে আমি যে টাকা পেয়েছিলাম সেটি ছিল আমার জন্য অতি দুর্লভ প্রাপ্তি। বিদায়ের এই করুণ মুহূর্তে আমার জন্য অশ্রু সংবরণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু আমার মা কাঁদেননি। কারণ তিনি জানতেন তিনি কাঁদলে আমার মানসিক অবস্থা কি হবে। আর এই মুহূর্তে আমার মনোবল ভেঙ্গে পড়লে আমার পক্ষে আমার লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন হবে।
অনেক বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে সীমান্তের ঐ পারে ট্রেনিং সেন্টারে গিয়ে পৌঁছলাম। ত্রিপুরা রাজ্যের জঙ্গল থেকে মায়ের সাথে যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না। তখন কোন মোবাইল অথবা টেলিফোন যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল না। কোন প্রকার চিঠি-পত্রের আদান-প্রদান ছিল না। মা তাঁর প্রিয় ছেলের অনুপস্থিতিতে হানাদার কবলিত গ্রামের বাড়িতে কিভাবে তাঁর জীবনের এ সময়টা কাটাতেন তা বাস্তবে চিন্তা করা কঠিন, শুধু উপলব্ধি করতে পারতাম। আমি একবার ভিতরে ঢুকেও মায়ের সাথে দেখা করার সুযোগ পাইনি। পরবর্তীতে আগরতলার নিকট আখাউড়া সীমান্তে চলে যাই। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৭ই ডিসেম্বর ১৯৭১ আমি আমার থানা মিরসরাই পৌঁছে বাড়িতে মায়ের সাথে দেখা করতে যাই। সেদিন মায়ের যে আনন্দ এবং গর্ব – একজন মুক্তিযোদ্ধার মা হিসাবে তা ভাষায় ব্যক্ত করা কঠিন। সেদিন তাঁর আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। একটি স্বাধীন হানাদার মুক্ত দেশে মুক্ত বাতাসে জীবন কাটাবেন- এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় পাওয়া।
লম্বা চুল ও গোঁফওয়ালা তাঁর মুক্তিযোদ্ধা ছেলের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। এক রাত বাড়িতে মায়ের সাথে কাটালাম। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম কিভাবে তিনি সময় কাটিয়েছেন। আত্মীয়-স্বজনদের অনেককেই পাক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বার বার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলই গ্রামে এসেছে তাদের জন্য মা খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। তাদের মাঝেই তাঁর ছেলের অস্তিত্ব যেন তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন।
বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। এই স্বাধীনতার পিছনের গল্প অনেকের অজানা। মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান জাতি স্বীকার করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের মা- যারা সকল স্নেহ মমতা বিসর্জন দিয়ে সন্তানদেরকে যুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তাঁদের কথা কেউ মনে রাখেনি। সেদিনের মায়েরা আধুনিক মায়েদের মত শিক্ষিত ছিলেন না। তবে তাদের যে দেশপ্রেম এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদান মুক্তিযুদ্ধের একটি অবিস্মরণীয় অঙ্গ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই মায়েদের অবদান আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বি:দ্র: আমার মা বেগম মেহেরুন্নিসা আল্লাহর রহমতে এখনও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। তাঁর বয়স এখন ৯০ বছর। সকলের নিকট দোয়া প্রার্থী-আমার মায়ের মানসিক এবং শারীরিক সুস্থতার জন্যে আন্তরিকভাবে দোয়া করবেন।
লেখক : ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ, বীর মুক্তিযোদ্ধা।