ডেঙ্গুর প্রকোপে চট্টগ্রামসহ সারাদেশ অনেকটাই দিশেহারা। এর মাঝে থেমে নেই ম্যালেরিয়ার প্রকোপও। বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়ে ভর করেছে ম্যালেরিয়ার থাবা। বিশেষ করে গত জুন মাস থেকে এ রোগের প্রকোপ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে।
কেবল জুন মাসেই এ অঞ্চলে (বৃহত্তর চট্টগ্রামে) আড়াই হাজারের বেশি (২৬৭১ জন) ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে। যা এর আগের মাসে (মে) শনাক্তের ৩ গুণ বেশি। আর আগের ৪ মাসের (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) মোট শনাক্তের দ্বিগুণেরও বেশি। গত মে মাসে শনাক্ত হয় ৮৯১ জনের। আর আগের চার মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৪২০ জন। সবমিলিয়ে এখন পর্যন্ত (গত ৬ মাসে) প্রায় ৫ হাজার (৪৯৮২ জন) ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রামে।
এদিকে, চলতি বছর ২৫ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ৪ জনই বৃহত্তর চট্টগ্রামের। এর মাঝে বান্দরবানে মৃত্যু হয়েছে তিন জনের। আরেক জনের মৃত্যু হয়েছে কক্সবাজারে। এই ৪ জনের মধ্যে জুন পর্যন্ত মৃত্যু হয় তিন জনের। অপরজনের মৃত্যু হয়েছে জুলাই মাসে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয় ও জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচি (এনএমইপি) সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত বৃহত্তর চট্টগ্রামে আক্রান্তদের ৯২% পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের। এই তিন জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৪ হাজার ৫৮৭ জন। তবে ম্যালেরিয়ায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বান্দরবানে। এখন পর্যন্ত গত ৬ মাসে এ জেলায় ২৯৩৩ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। যা বৃহত্তর চট্টগ্রামে মোট আক্রান্তের ৫৯ শতাংশ। জেলাটিতে শুধু জুন মাসেই আক্রান্ত হয়েছে ১ হাজার ৬৯৩ জন। আগের ৫ মাসে এ জেলায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৪০ জন। সবমিলিয়ে পাবর্ত্য অঞ্চলের এ জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ খুব ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যা অ্যালার্মিং হিসেবেই দেখছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
বিভাগীয় পর্যায়ে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু রোগ সংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত সংরক্ষণ ও তদারকির দায়িত্বে রয়েছেন বিভাগীয় কীটতত্ত্ববিদ মফিজুল হক শাহ। তিনি আজাদীকে বলেন, জুন মাসে ম্যালেরিয়ার প্রকোপটা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও কঙবাজার জেলায় এর প্রকোপ বেশি দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে পার্বত্য বান্দরবান সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ জেলায় এক মাসেই (জুনে) দেড় হাজারের বেশি কেস (রোগী) পাওয়া গেছে। যা খুবই অ্যালার্মিং।
যদিও গত বছরের তুলনায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের হার এবার কিছুটা কম বলে জানিয়েছেন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির সাথে সম্পৃত্ত কর্মকর্তারা। এনএমইপি’র সার্ভিলেন্স মেডিকেল অফিসার হিসেবে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের দায়িত্বে রয়েছেন ডা. সিরাজুল ইসলাম আর বান্দরবানের দায়িত্বে রয়েছেন ডা. শাহরিয়ার তানভির আহমেদ। তারা জানান, গত বছর একই সময়ে (৬ মাসে) ৭ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হয়। এবার এ সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। আর বান্দরবানে গত বছরের জুন এক মাসেই আক্রান্ত হয় চার হাজারের বেশি। এবার এ সংখ্যা দেড় হাজারের কিছু বেশি। হিসেবে গত বছরের তুলনায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা এবার কিছুটা কম।
বান্দরবানের পর রাঙ্গামাটি ও কঙবাজারে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এরপরই রয়েছে খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রাম। এনএমইপি’র তথ্য অনুযায়ী, ৫ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত) চট্টগ্রাম জেলায় ম্যালেরিয়া রোগী শনাক্ত হয় ২১ জন। আর কেবল জুন মাসেই শনাক্ত হয়েছে ১৭ জন। কঙবাজার জেলায় আগের ৫ মাসে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন। তবে জুন মাসে এ জেলায় রোগী শনাক্ত হয় ২১৩ জন। রাঙ্গামাটিতে আগের ৫ মাসে শনাক্ত হয় ৩৬৭ জন। আর কেবল জুন মাসেই আক্রান্ত ৬৬৭ জন। খাগড়াছড়িতে আগের ৫ মাসে রোগী পাওয়া যায় ৪১ জন। আর জুন মাসে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৮১ জনে।
এদিকে, এ বিষয়ে কথা বলতে বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. মাহবুবুর রহমানকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। তবে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ার প্রকোপের এ পরিস্থিতিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে দেখছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, পার্বত্য অঞ্চলে প্রায় সময়েই ম্যালেরিয়ার প্রকোপ থাকে। তবে বর্ষা মৌসুমে এই প্রকোপ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া আছে। যাতে ম্যালেরিয়া নিয়ে ঘরে ঘরে সচেতনতামূলক প্রচারণা কার্যক্রম চালানো হয়। আর জ্বর আসলে মানুষ যাতে অবহেলা না করে। রোগীকে যাতে দ্রুত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যায় এবং পরীক্ষা–নিরীক্ষা করায়।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বান্দরবানের বিশেষ করে লামা, আলিকদম ও থানচি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বেশি। এটি অ্যালার্মিং বলা যায়। আক্রান্ত কেউ যাতে মারা না যায় এখন সে লক্ষ্যেই কার্যক্রম চালানো হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মানুষকে সচেতন করতে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সেভিয়ার ম্যালেরিয়ায় একবার অচেতন হয়ে পড়লে ওই রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই পরিবারে কারো জ্বর হলে দেরি না করে যাতে স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়ে আসে। দ্রুত পরীক্ষা–নিরীক্ষার ব্যবস্থা করে। কারণ, প্রাথমিকভাবে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হলে, ওই রোগীকে বাঁচানো সম্ভব। তবে বেশ কিছু উপজেলায় খুবই দুর্গম ও গহীন অঞ্চল রয়েছে। যেখানকার মানুষ সচেতন নয়। এসব অঞ্চলে মানুষের অসচেতনতাও একটি বড় সমস্যা বলে মনে করেন স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্টরা।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বান্দরবানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৭০৯ জন। ২০২০ সালে আক্রান্ত হয় ৪ হাজার ১৬৬ জন। আর ২০২১ সালে রোগীর সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ২২৮ জন। আর গতবছরের (২০২২ সালের) প্রথম ৬ মাসেই এ জেলায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৬৮০ জনে। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসে জেলায় আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৯৩৩ জন। হিসেবে গতবছরের তুলনায় এবছর আক্রান্তের হার কিছুটা কম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পার্বত্য অঞ্চলে সারা বছর রোগী পাওয়া গেলেও জুন–জুলাই মাসে এ রোগের প্রকোপ খুব বেশি। এ রোগ প্রতিরোধের উপায় হিসেবে কীটনাশক যুক্ত মশারি ব্যবহার, সব সন্দেহজনক জ্বরের রোগীর মানসম্মতভাবে ম্যালেরিয়া শনাক্ত বা নিশ্চিত করে যথাযথ চিকিৎসা প্রদান, রোগ ও কীটতাত্ত্বিক নিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন নিশ্চিত করার পারমর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক এম এ ফয়েজ।
এসব অঞ্চলে ম্যালেরিয়া নির্মূলকরণে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্গম এলাকায় দক্ষ চিকিৎসক স্বল্পতা ও সহজে চিকিৎসা দিতে না পারা, নগরায়ণ ও সময়ের পরিবর্তিত বাস্তবতায় মানুষের দ্রুত অবস্থানগত পরিবর্তন, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কীটনাশকযুক্ত মশারি টানানো, তিন বছর পর পর সাধারণ মশারি কীটনাশকে চুবিয়ে ব্যবহার করা, বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড়, ডোবা, নর্দমা, পুকুর, গর্ত পরিষ্কার রাখাসহ অ্যানোফিলিস মশা যাতে বংশবিস্তার করতে না পারে সেজন্য সতর্ক থাকার কথা বলেছেন চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা।