
যুগে যুগে কালে কালে আমাদের সমাজ পরিমণ্ডলে এমন কিছু পুণ্য পুরুষের জন্ম হয় যাঁদের মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, শ্রম, আত্মত্যাগ, চিন্তা চেতনায়– দেশ, সমাজ, জাতি, সদ্ধর্ম, আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠে। তেমনি এক কালজয়ী মহাপুরুষ, মহাজীবন, শতাব্দীর আলোকিত সূর্য, বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু, শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ, মহামান্য ত্রয়োদশ সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির।
রাউজান উপজেলাস্থ উত্তর গুজরা গ্রামে ১৯২৫ সালের ১৮ নভেম্বর এক আলো ঝলমল পুণ্য লগনে পিতা প্রেম লাল বডুয়া ও মাতা মেনেকা রাণী বড়ুয়ার ঘর আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন আলোর নন্দন লোকনাথ বড়ুয়া। সেদিনের লোকনাথ কিশোর বয়সে মাতাকে হারিয়ে তাঁর মামা পশ্চিম বিনাজুরী গ্রামের কীর্তিমান সংঘ মনীষা ভদন্ত সারানন্দ মহাস্হবির এর সার্বিক সহযোগিতায় ১৯৪৪ সালে গৌরবদীপ্ত সংঘিক ব্যক্তিত্ব, উপ সংঘরাজ ভদন্ত গুণালঙ্কার মহাস্থবির মহোদয়ের নিকট হাটহাজারীর জোবরা গ্রামে শ্রামণ্য ধর্মে দীক্ষা নেন। পাঁচ বছর পর শ্রামণ্য ধর্মের ইতি টেনে ১৯৪৯ সালে গুরু ভদন্ত গুণালঙ্কার মহাস্থবিরের উপাধ্যায়ত্বে দুর্লভ উপসম্পদা লাভ করেন। উত্তর গুজরা ডোমখালী গ্রামের সেদিনের সেই লোকনাথ বড়ুয়া আজকের মহামান্য সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির। এই মহানুভব সংঘ মনীষার ৮২ বছরের প্রব্রজিত জীবন যেন এক বর্ণাঢ্য ইতিহাস। সুদীর্ঘকাল বৌদ্ধ সমাজ গগনকে তিনি তাঁর মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, শ্রম, আত্মত্যাগ, শীল, সমাধি, প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। ৮২ বছরের ভিক্ষুত্ব জীবনে বৃহত্তর বৌদ্ধ সমাজকে তিনি অকাতরে শুধু দিয়েই গেছেন।
কর্মবীর ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির মহোদয় যেসমস্ত জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছেন তারমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো:
মুবাইছড়ি জ্ঞানোদয় পালি টোল, দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি। ধর্মোদয় পালি টোল ও দশবল রাজ বিহার, দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি। ত্রিপিটক প্রচার বোর্ড গঠন মহামান্য ৮ম সংঘরাজ ভদন্ত শীলালংকার মহাথেরোর সাথে যৌথ প্রয়াসে মনোঘর অনাথ আশ্রম, ভেদভেদি, রাঙ্গামাটি। চন্দ্রঘোনা জ্ঞানশ্রী শিশু সদন, বড়ইছড়ি, কাপ্তাই। কদলপুর অনাথ আশ্রম ও ভিক্ষু ট্রেনিং সেন্টার, রাউজান। সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডল ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদ। ৮. ত্রৈমাসিক ধর্মায়তন পত্রিকা, সংঘরাজ ভিক্ষু মহামন্ডল ধর্মীয় শিক্ষা পরিষদের মুখপত্র। জোবরা গুণালংকার বৌদ্ধ অনাথালয়, হাটহাজারী। পশ্চিম বিনাজুরী ধর্মকথিক অনাথ আশ্রম, বিনাজুরী, রাউজান। পশ্চিম বিনাজুরী উচ্চ বিদ্যালয়, বিনাজুরী, রাউজান। গুইমারা দেওয়ান পাড়া ড. জ্ঞানশ্রী বুদ্ধ বিহার, মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি। গুইমারা দেওয়ান পাড়া ড. জ্ঞানশ্রী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি। গুইমারা দেওয়ান পাড়া অনাথ আশ্রম, মাটিরাঙ্গা, খাগড়াছড়ি। উচাই সূর্যাপুর জ্ঞানশ্রী বৌদ্ধ বিহার, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট। উচাই উপ সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী নৃ–তাত্ত্বিক উচ্চ বিদ্যালয়, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট। নূরপুর জ্ঞানশ্রী বৌদ্ধ বিহার, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট। বারকান্দি সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী সার্বজনীন বৌদ্ধ বিহার, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট। সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী আন্তর্জাতিক বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, পশ্চিম বিনাজুরী, রাউজান। বাংলাদেশ বুদ্ধ শাসন কল্যাণ ট্রাষ্ট । বান্দরবান উজিপাড়া ড. জ্ঞানশ্রী বৌদ্ধ বিহার। নানিয়ারছড় দ্বিচান পাড়া ড. জ্ঞানশ্রী সাধনা বৌদ্ধ বিহার। সংঘরাজ ড. জ্ঞানশ্রী বৃদ্ধাশ্রম, পশ্চিম বিনাজুরী। জ্ঞানশ্রী প্রভাতি পালিটোল, উত্তর গুজরা, ডোমখালী, রাউজান।
মহামনীষী ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির মহোদয় দেশে–বিদেশে যে সমস্ত দুর্লভ সম্মাননা লাভ করেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– ১। ১৯৮১ সালে থাইল্যান্ড হতে শাসনশোভন জ্ঞানভানক উপাধি লাভ। ২। ২০০১ সালে বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক বিনয়াচার্য উপাধি লাভ। ৩। ২০০৪ সালে বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক উপ সংঘরাজ স্বীকৃতি লাভ ।
৪। ২০০৬ সালে বার্মা সরকার কর্তৃক মহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধ্বজ উপাধি লাভ। ৫। ২০০৭ সালে থাইল্যান্ড এর মহাচুল্লালংকার বিশ্ববিদ্যালয় হতে সম্মান সূচক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ। ৬। ২০০৮ সালে বৌদ্ধ কৃষ্টি প্রচার সংঘ হতে স্বর্ণ পদক ও উপাধি লাভ। ৭। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি কর্তৃক পুণ্যাচার–উ, গুণমেজু স্বর্ণ পদক লাভ। ৮। ২০১৪ সালে ওয়ার্ল্ড ফেলোশীপ অব বুড্ডিস্ট ইয়থ কর্তৃক আউট স্ট্যান্ডিং এ্যাওয়ার্ড লাভ। ৯। ২০২০ সালের ২০ মে সংঘরাজ ভিক্ষু সহাসভার সর্বোচ্চ সম্মাননা মহামান্য ত্রয়োদশ ‘সংঘরাজ’ নির্বাচিত হন। ১০। ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সমাজসেবায় বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। ১১। ২০২৩ সালে বার্মা সরকার কর্তৃক ‘অগ্গমহাপণ্ডিত’ উপাধি লাভ। ১২। ২০২৪ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব বাংলাদেশী বুড্ডিস্ট কর্তৃক সম্মাননা ও সংবর্ধনা লাভ করেন। তাছাড়া মহামান্য সংঘরাজ উপসম্পদা লাভের পর থেকে অসংখ্য গ্রাম, বিহার এবং সংগঠন থেকে সংবর্ধনা, সম্মাননা লাভ করেন।
সংঘরাজ ভদন্ত ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির একজন আলোকিত মহাপুরুষ। যাঁর দ্যুতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছে। যাঁর পুণ্য পরশে সৃজিত হয়েছে অসংখ্য গৌরবগাথা। তিনি আমাদের অহংকার, গর্ব, দুর্লভ সম্পদ, আলোর প্রদীপ। যে প্রদীপের আলোয় আলোকিত হয়েছে বৌদ্ধ সমাজ গগণ। যাঁর কল্যাণ স্পর্শে অসংখ্য পথহারা, দিশাহারা মানুষ খুঁজে পেয়েছে নতুন পথের ঠিকানা। তাঁকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলাদেশী বৌদ্ধদের সর্বোচ্চ ধর্মীয় গুরু ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির গত ১৩ নভেম্বর ৪.৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালে ১০০ বছর বয়সে বার্ধক্যজনিত কারণে পরপারে পাড়ি জমান। ১৮ নভেম্বর রাউজানস্থ পশ্চিম বিনাজুরী শ্মশান বিহারে এই পুণ্যপুরুষের পবিত্র মরদেহের পেৃটিকাবদ্ধ, ১০১ তম জন্মদিন উদ্যাপন অনুষ্ঠিত হবে। বুদ্ধাঙ্কুর ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির’র মত মহাপুরুষদের কখনো মৃত্যু হয় না। তাঁদের সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে তাঁরা অনন্তকাল মানুষের মনোমন্দিরে বেঁচে থাকেন। ড. জ্ঞানশ্রী মহাস্থবির ও আমাদের আত্মার পোতাশ্রয়ে, হৃদয়ের অনিন্দ্য নিলয়ে শত শতাব্দীকাল অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতি যুব।












