এপ্রিল ইজ দ্যা ক্রুয়েলেস্ট মান্থ। টিএস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ডের এই বাক্যটি আগস্ট এলেই আমার ভীষণভাবে মনে পড়ে। বাঙালি জীবনে, আমাদের জীবনে আগস্ট ইজ দ্যা ক্রুয়েলেস্ট মান্থ, এক বেদনার মাস। বিষণ্নতা নিয়েই যেন আগস্ট আসে। আমার জন্মমাসেও এত বিয়োগান্তর ঘটনা মেনে নিতে হয়, প্রিয় মুখগুলো হারিয়ে যেতে থাকে, আপনজন হারানোর বেদনা নিয়ে নিঃসীম শূন্যতায় আমি কিছুই খুঁজে পাই না, কিছু অনুপম অনির্বচনীয় স্মৃতি ছাড়া, আর এই স্মৃতির ভেতর মানুষ শিশু থেকে শিশুতর হয়ে হামাগুড়ি দেয়, বেঁচে থাকার কিছু অবলম্বন খুঁজে ফেরে, তৈরি হয় কিছু দায় জীবনের প্রতি।
কবি মোহাম্মদ রফিক, আমাদের রফিক ভাইয়ের মৃত্যুতে আমার আবারও এই কথাগুলোই মনে হলো। একজন শিক্ষক থেকে কী করে সবার ভাই হয়ে যায়, একজন প্রবীন শিক্ষক থেকে কী করে নবীনতর ছাত্রটিরও বন্ধু হয়ে যেতে পারে– রফিক ভাইয়ের ব্যক্তিত্বের এটাও একটা বড় পরিচয়, আর এখন আমি বুঝতে পারি এমন পরিচয়ের ভেতরই এমন বন্ধুত্বের ভেতরই মানুষ বেঁচে থাকে পরম্পরায়। রফিক ভাই আমারও ভাই হয়ে গেলেন। বন্ধুও হয়ে গেলেন।
আজ চকিতে এত সান্নিধ্যস্মৃতিমুহূর্ত উঁকি দিচ্ছে, ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ, কেবলই কানে বাজছে তার সেই দরাজ কণ্ঠ। রফিক এই নামটি কখন শুনি? আমরা তখন চট্টগ্রামে থাকি, বন্ধু নায়েম লিটু আর আমি দুজনেই তখন চট্টগ্রাম কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। কবি সুনীল নাথ ছাড়া সাহিত্য সমাজের আর কাউকেই চিনতাম না। কবি সুনীল নাথকে খুঁজে বের করা, তার সাথে পরিচয়– তাও ছিল আমার আর লিটুর কাছে অপার বিস্ময়। ভীষণ ক্ষ্যাপাটে ছিলেন এই কবি, কাউকেই সমীহ করতেন না, দুর্মুখ হিসেবেই খ্যাতি ছিল তখন চট্টগ্রামের সাহিত্য মহলে। কিন্তু আমরা বুঝতাম কী অকৃত্রিম আর শক্তিমান কবি ছিলেন এই সুনীল নাথ। জাগতিক ভান তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর ১১ গোলাপ সিংহ লেইন–এর ডেরায় আমরা যেতাম, প্রায় রোজই যেতাম, তার ডেরায় অন্যদের প্রবেশাধিকার সীমিত থাকলেও আমাদের দুজনের জন্য ছিল সদা উন্মুক্ত, কী অপথ্য স্নেহই না পেয়েছিলাম আমরা! সুনীল দা জীবিত কবিদের মধ্যে তখন কাউকেই কবি হিসেবে গণ্য করতেন না, একজন ছাড়া। তিনি ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। সুনীল নাথের মুখেই প্রথম শুনি কবি মোহাম্মদ রফিকের নাম। তখন থেকেই ভীষণ আগ্রহ তৈরি হয় রফিক সম্পর্কে। তাঁর ডেরাতেই সম্ভবত আজকের কাগজের সাহিত্য সাময়িকী বা কবি অরুণ সেন সম্পাদিত ঋতপত্রের কোনও সংখ্যায় রফিকের কবিতা পড়ে সুনীল নাথের ধারণাই উচ্চকিত হয়েছিল মনে। তারপর পূর্নাঙ্গ গ্রন্থ কপিলা পড়ে ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম আর মনে মনে হয়তো সুপ্ত বাসনাও তৈরি হয়েছিল মোহাম্মদ রফিকের সান্নিধ্যপরশ পাব একদিন। জীবন মানুষকে কত ঘাটেই না নিয়ে যায় কত জলের স্বাদই না আস্বাদন করায়! একদিন কবি মোহাম্মদ রফিকও আমাদের বন্ধু হয়ে গেল। আর এই বন্ধুত্ব টিকে ছিল তাঁর মৃত্যুদিন পর্যন্ত। মৃত্যুর দুই দিন আগে ম্যাসেঞ্জার ইনবক্ তাকে আমি আমার কবিতার সদ্য নির্মাণ করা একটি ভিডিও শেয়ার করেছিলাম, তিনি দেখেছিলেন। এমনি করেই তিনি সবসময় খোঁজ–খবর রাখতেন – আমার, আমার স্ত্রীর, আমার কন্যা–পুত্র এখন কত বড় হলো আরও নানা ব্যক্তিগত বিষয়ে। বেশিরভাগ সময় রফিক ভাই নিজেই ফোন করতেন, ফোন শেষে আমার আফসোস হতো আমিও তো আগে ফোন করে খোঁজ নিতে পারতাম! লম্বা সময় ধরে আমাদের কথা হতো, এক–একটা কথপোকথন হতো চল্লিশ–পঞ্চাশ মিনিটেরও ওপরে। হেন কোনও বিষয় নেই যা নিয়ে আমাদের আলাপ হতো না। যোবাল হারিরির স্যাপিয়েন্স, পৃথিবীর বিলুপ্তি, মহাবিশ্বের আয়ু, মহাজাগতিক ভাবনা। সভ্যতার পরিসমাপ্তি– প্রতিটি সভ্যতারই একটা সার্কেল থাকে, প্রতিটি সার্কেলই তিন হাজার বছরের কাছাকাছি, রফিক ভাই হিসেব–নিকেশ করে মহাভারত থেকে শুরু করে বিভিন্ন পৌরাণিক গ্রন্থের রেফারেন্স দিয়ে শোনাতেন আমাদের সভ্যতার সার্কেলটিও ফুরিয়ে আসছে। শেষের দিকে এসব বিষয় নিয়ে অনেক কথা হতো। প্রতিবার আলাপ শেষেই নতুন করে ভাবনার কিংবা ভিন্নভাবে ভাবনার নানা সূত্র পেতাম, এসব অনেক কিছুতেই ভিন্নতর ভাবনাও ছিল আমার। রফিক ভাইয়ের মতো এমন স্মৃতিধর মানুষ আমি দ্বিতীয়জন দেখিনি। এত এত বিষয় নিয়ে কত কত মানুষ নিয়ে তার স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বেরিয়ে আসছে স্রোতের মতো গল্প, ঘটনা, ইতিহাস। তাঁকে সবসময় মনে হতো আমার চলমান বিশ্বপাঠশালা।
কী লিখছ এখন? আমার লেখালেখির খোঁজ নিতেন। আমি বলতাম, রফিক ভাই আমি তো এখন লিখতে পারছি না, লেখা আসছে না। এ–কথা শুনে তিনি খুব ক্ষেপে যেতেন। লেখা আসছে না মানে কী? লেখা কি ওহী নাকি যে তোমার ওপর নাযেল হবে! এসব ছাড়ো। বলো তো লেখার জন্য কতবার টেবিলে বসেছ! বসতে হবে। কাগজ কলম নিয়ে টেবিলে বসতে হবে। মন–হৃদয়–দেহের মহাসংযোগ ঘটাতে হবে। তবেই না লেখা হবে। এসব আসছে না আসছে না বললে তো হবে না।
২০০৬–২০০৭–২০০৮ এই সময়গুলোর দিকে তার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় খুব যেতাম। আমি আর লিটু। আমার তখন অফিস ছিল পুরান ঢাকায় বাংলাবাজারে, সবে ঢাকায় এসেছি, চাকরিতে ঢুকেছি। লিটু আগে থেকেই অবস্থান করত রফিক ভাইয়ের বাসায় আর আমি বৃহস্পতিবার বিকেলে অফিস শেষ করে গুলিস্তান থেকে বাসে উঠতাম, তখন ওই লাইনে হানিফ নামে একটা বাস ছিল, উঠে পড়তাম, প্রান্তিক গেইটে নেমে পড়তাম। শুক্রবার কাটিয়ে শনিবার সকাল সকাল ঢাকায় ফিরে আসতাম। শনিবার সকালে জাহাঙ্গীরনগর থেকে একটা লালচে গাড়ি ঢাকা আসত। সেই গাড়িতেই ফেরার চেষ্টা করতাম বেশিরভাগ সময়। প্রথমবার যখন যাচ্ছিলাম রফিক ভাই ফোন করলেন, তুমি কদ্দুর? আমি আর কবি নায়েম লিটু তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। আমার খুব হাসি পেয়েছিল। প্রান্তিক গেইটে নামতেই সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। প্রান্তিক গেইটের কাছেই তার বাসা, আমি ভুল করে তার বাসা পার হয়ে খেলার মাঠের দিকে চলে গেলাম, আমাকে খুঁজে পেতে লিটুকে পাঠালেন, লিটুকে নিয়ে রফিক ভাইয়ের ভবনের কাছে আসতেই দেখি রফিক ভাই গেইটে দাঁড়িয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন। ভীষণ ভালো লাগলো আমার। রফিক ভাইয়ের বাসায় খুব রুটিনে বেঁধে রাখতেন আমাদের। বেশি রাত জাগতেন না। আমাদেরও রাত জাগতে দিতেন না। খুব সকালে উঠে পড়তেন। ভোরের আলোয় বসে কবিতা লিখতেন। বলতেন, ভোরের আলো–হাওয়া যদি গায়ে না লাগে তবে মন জাগবে কেন! আমি, লিটু, রফিক ভাই– আমরা তিনজন দলবেঁধে প্রান্তিক গেইটের হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে বাসায় ফিরে বসার ঘরে গোল হয়ে বসতাম আর আমাদের সাম্প্রতিক লেখা কবিতা পাঠ করে শোনাতাম। আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের কবিতা পাঠ করে শোনাতাম। সেই এক অনির্বচনীয় মুহূর্ত ছিল। কোনও লাইন ভালো লাগলে রফিক ভাই থামিয়ে দিতেন, বলতেন আবার পড়ো তো। দুপুরে, রাতে আমরা তিনবেলাই প্রান্তিক গেইটের হোটেলে খেতে যেতাম। মাঝে মাঝে লিটু অবশ্য খিচুড়ি রান্না করতো। দুপুরে খাওয়ার পর আমরা গান শুনতাম। রফিক ভাই তাঁর প্লেয়ারে তাঁর ভালো লাগা গানগুলো আমাদের শোনাতেন। আর গানের পেছনের গল্প শোনাতেন। গানের পেছনের এত গল্প তাঁর জানা আমি আশ্চর্য হয়ে যেতাম। তার সঙ্গীতসংগ্রহ আমাকে অবাক করে দিয়েছিল। ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের এমন সমৃদ্ধ সংগ্রহ আমি কোথাও আর দেখিনি। ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের প্রতি আমার আগ্রহের জায়গা তৈরি হয় অনেকটা রফিক ভাইয়ের কারণেই। বড়ে গোলাম আলী খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, আব্দুল করিম খাঁ, বেলায়েত খাঁ, বৈজুন্তি বালা, ভীমসেন যোশি এমন কত কত সঙ্গীতগুরুর সন্ধান আমি প্রথম পেয়েছি তার কাছে। এসবই আমার সঙ্গীতের কান তৈরিতে সাহায্য করেছে বলা যায়। রফিক ভাই বলতেন, ভারত মহাদেশের শিল্পসাহিত্যের সবচেয়ে বড় ঐশ্বর্য তার সঙ্গীত। এই সঙ্গীতের ভেতরই সে তার সকল মানুষকে ধর্ম–জাতি–বর্ণ–ভাষা নির্বিশেষে যুক্ত করেছে। এখানেই সঙ্গীত অনন্য। আর এই সত্য নজরুলের মতো কেউ ধারণ করতে পারেনি। এই বিশ্লেষণ দুর্দান্ত লেগেছিল আমার। গান শুনে নিয়ম করে আমাদের ঘণ্টা/দেড় ঘণ্টার মতো ঘুমাতে হতো।
একবার শিমুল সালাহ উদ্দীন, সাদিকা রুমন তাদের আরও বন্ধুরা মিলে ‘ধ্বনি’ আবৃত্তি সংগঠন থেকে জাহাঙ্গীর নগর ক্যাম্পাসে রফিক ভাইকে নিয়ে আয়োজন করল তিনদিনব্যাপী উৎসব। হায়াৎ মামুদ, কবি কামাল চৌধুরী আরও অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম, প্রথম দিন রফিক ভাইয়ের কবিতা নিয়ে আমি লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেছিলাম। দ্বিতীয় দিন আমাদের বন্ধু কবি আসমা বীথিও চট্টগ্রাম থেকে যোগ দিয়েছিল, রফিক ভাইয়ের কবিতা নিয়ে বলেছিল। প্রথম দুই দিন আমার থাকার সুযোগ হয়েছিল। সেই অনুষ্ঠান সফল করতে কী যে পরিশ্রম করেছিল শিমুল আর তার বন্ধুরা! রফিক ভাইয়ের প্রিয় ছাত্রদের এই উদ্যোগ ভীষণ প্রাণিত করেছিল আমাকে সেদিন আর এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আমরা কী দারুণ আনন্দেই না সময়গুলো কাটিয়েছিলাম রফিক ভাইয়ের বাসায়।
কবিতাভাবনা, কবিতাদর্শন, কবিতার ভবিষ্যৎ ইত্যকার নানা বিষয় নিয়েই তো কথা হতো আমাদের। কবিতা বিষয়ক রফিক ভাইয়ের কিছু ভাবনা বা আলোচনা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল। বোদল্যায়ার বা এলিয়ট বা তাদের হাত ধরে ইউরোপের যে আধুনিক চেতনায় আমরা আচ্ছন্ন হলাম তার মূলে রয়েছে নৈরাশ্যবাদ, হতাশা, ক্ষয়, ব্যক্তিমানুষের একাকীত্ব। এই চেতনা ধারণ করে মহান কবিতা লেখা সম্ভব নয়। এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। মহান কবিতা মহান আশা সঞ্চার করে, ক্ষয় নয় বরং বেঁচে থাকার ব্রত শক্তি জাগিয়ে তোলে। পৃথিবীর মহাকাব্যগুলোর মধ্য দিয়ে যে মৌলসুর উচ্চারিত হয়েছে যুগে যুগে। আমাদের কালের কবিতায় কোথায় সেসব উজ্জীবনী?
রফিক ভাই আমাদের ইতিহাস ঐতিহ্য মাটি আলো বাতাস নদী আর কৃষিবর্তী জীবন খুঁড়ে সেই সামষ্টিক জীবনের আশাবাদই সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন তারা সমস্ত কবিতায়। এ মহাকাব্যিক যাত্রায় তিনি কতটা সফল হয়েছেন তা ইতিহাসই বলবে।
আচানক ডাক এল, রফিক! রফিক!
ভূ–পৃষ্ঠ মাড়িয়ে কোথা থেকে;
ফিরে তাকাইনি ভয়ে, যদি দেখি কেউ নেই
শূন্যে একটি আলোর গোলক আবর্তিত হাওয়ায়–হাওয়ায়
ফিরে ফিরে ডাক আসে হ্রস্বতায়, রফিক! রফিক!
ছুটে চলি জ্ঞানশূন্য দিগ্বিদিক
আমার পায়ের নীচে সাত সমুদ্দুর ঢেউ
শিরের মাস্তুল ছুঁয়ে নক্ষত্রের ছোঁয়া
চাঁদের কিরণ আঙুলের ফাঁক গলিয়ে গলিয়ে
ও কে স্বর ভাঙে, রফিক! রফিক!
আমার শরীরে স্পর্শ শূন্যতায় আতপ্ত শরীর
রোমকূপ ফেটে পড়ে সহস্র পুষ্পের বিমলিন স্নিগ্ধ সৌরভে মোহিত
আমি তবে নেই আছি আছি চরাচরে উধাও বিলীন
হঠাৎ বজ্রের শিখা ফুঁড়ে গেল বিচ্ছিন্ন বিখণ্ড, আমি আছি
মাথা কুটছে একটি ডাক, রফিক! রফিক! শুনি মরিয়া অথই।
মানব পদাবলি/৭৬ সংখ্যক কবিতা/প্রকাশক: বাতিঘর, ২০১৭
রফিক ভাই আপনি আছেন। থাকবেন। চরাচরে মানব পরিচয়ে মিশে থাকবেন।