ভোররাত থেকেই ঝুম বৃষ্টি। এযেন বিরতিহীন মুষলধারে বৃষ্টি। সকালে ঘুম ভাঙতেই জানালার গ্লাসে চোখ পড়ে। ততক্ষণে সকাল ন’টা বেজে দু’চার মিনিট। উঠে দেখি চারপাশটা বৃষ্টির পানিতে থৈথৈ করছে। এদিকে বৃষ্টি বিরতিতে যাবার কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এগারোটায় আমার ওরিয়েন্টেশন পোগ্রাম শুরু। পোগ্রাম শুরু হতে আর মাত্র এক ঘন্টা ছত্রিশ মিনিট। আমি তাড়াহুড়ো করেই ব্রাশ করতে করতে ফ্রেশ হতে গেলাম। রেডি হতে হতে সাঁইত্রিশ মিনিট ফুরালো। টেবিলে আম্মুর সাজিয়ে রাখা নাস্তার প্লেট স্পর্শ করার সময়টুকু পেলাম না। বাকি ঊনষাট মিনিট হাতে রেখে কলেজের উদ্দেশ্য বের হয়ে পড়ি। তখনও বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বাসা থেকে দু’মিনিট হেঁটে বাস স্টেশনে গেলাম।
স্টেশনে কোনো বাস নেই। রাস্তাও ফাঁকা। মানুষের সাড়াশব্দ নেই। স্টেশনের ধারে রফিক চাচার চায়ের ঝুপড়ি খোলা আছে। রফিক চাচা চমৎকার চা বানান। দু’পা বাড়িয়ে চাচার ঝুপড়ির বারান্দায় ঢুকলাম। ততক্ষণে চাচা এক কাপ চা বানিয়ে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। রফিক চাচা বললেন, বাজান আইজকা স্টেশনে কোনো বাস নাই। কলেজ ক্যামনে যাইবা?
রফিক চাচার কথা শুনে আমার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। অনার্সের প্রথম ক্লাস আমার। যেভাবেই হোক যেতেই হবে। ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপে চুমুক বসাতেই দেখি পূর্বদিক থেকে স্টেশনের দিকে একটা রিকশা আসছে। ঝুম বৃষ্টিতে তা–ও আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে।
স্টেশনের ধারে রিকশা আসতেই ডাক দিলাম এই যে মামা, চন্দনপুরা কলেজ রোড যাবেন? রিকশাওয়ালা মামা ঝুপড়ির পাশে রিকশা দাঁড় করিয়ে বললেন আমি ওইদিকেই যাচ্ছি। রিকশায় তো যাত্রী আছে। এই বলে রিকশাওয়ালা মামা রফিক চাচার ঝুপড়িতে ঢুকে চা–বিস্কুট খাওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
এদিকে আমি ছাতা খুলে ঝুপড়ি থেকে বের হয়ে রিকশায় বসে থাকা যাত্রীর সাথে কথা বলতে চেষ্টা করি। এক্সকিউজ মি! রিকশায় কেউ আছেন কি? প্রথমবারে কোনো সাড়াশব্দ মেলেনি। দ্বিতীয়বারে মধুরকণ্ঠ ভেসে আসে জ্বি বলুন…
আমি ভীত স্বরে বলি, আসলে আজ আমার অনার্সের ওরিয়েন্টেশন পোগ্রাম। শুরু হতে মাত্র পঁচিশ মিনিট বাকি। কোনোভাবে কলেজে পৌঁছাতে যদি একট্টু সাহায্য করতেন, খুশি হতাম। রিকশার ভেতর থেকে কিছুটা মৃদু হাসির স্বরে বলেন, জ্বি অবশ্যই। আপনি চাইলে আমার সাথে যেতে পারেন। আমি কিছুটা ভীত সঞ্চিত মনে রিকশায় উঠে বসি। ততক্ষণে রিকশাওয়ালা মামাও চলে আসেন এবং গন্তব্যে যাত্রা শুরু করেন।
ঝুম বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিকশা চলছে। রিকশার হুডির ভেতর আমি আর অপরিচিত যাত্রী। বাইরে রিকশাওয়ালা মামা রেইনকোট গায়ে গান গাইতে গাইতে রিকশা টানছেন। মিনিট দশেক পর তিনি আমার সম্পর্কে জানতে চাইলেন। কোনো কিছু না ভেবেই দ্বিধাহীনভাবে আমার সব পরিচয় বলে ফেলি। পরক্ষণে মিনিট পাঁচেক পেরোলে বলি, আপনার নাম জানতে পারি কি? প্রথমে নিশ্চুপ ছিলেন। আমিও দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করিনি। মিনিট দুয়েক পর এক শব্দে বললেন, নীরা। তারপর দু’জনেই বেশ চুপচাপ। রিকশা চলছে। রিকশার হুডিতে বৃষ্টির শব্দ যেন রিমঝিম ছন্দ বুনছে।
চার মিনিট বাকি থাকতেই রিকশা কলেজের মেইন গেইটে পৌঁছে গেলো। রিকশা থামতেই নীরা হুটহাট করে নেমে পড়েন। তাড়াহুড়ো করে রিকশাওয়ালা মামাকে ভাড়াও দিয়ে দিলেন। ভাড়াটা আমি দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নাহ, নীরা কিছুতেই আমাকে ভাড়া দিতে দেবেন না।
নীরা সেদিন ছাতা নিয়ে যাননি। চট্টগ্রাম কলেজের মেইন গেইট থেকে পশ্চিম দিকে রাস্তা পার হতে খুব তাড়াহুড়ো করছিলেন তিনি। ততক্ষণে বুঝতে পেরেছি, নীরা মহসিন কলেজে পড়েন। আমি ভেবেছিলাম নীরা আমাদের কলেজে পড়েন। তা কিন্তু নাহ্। তখনও ঝুম বৃষ্টি। রাস্তার এপাশ থেকে ওপাশ আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। নীরা না চাইলেও আমি, এক হাতে ছাতা নিয়ে আরেক হাতে নীরার হাত শক্ত করে ধরে রাস্তা পার করে দিই। মহসিন কলেজের মেইন গেইট পেরোতেই নীরা মৃদু হেসে বলে উঠেন, আল্লাহ হাফেজ। সবসময়ই ভালো থাকুন। সুন্দর থাকুন। আবার দেখা হবে।
দু’হাজার আঠারো সাল থেকে আজ–অব্দি পাঁচ বর্ষা ফুরিয়ে গেলেও আর দেখা হয়নি নীরর সাথে। আর কত বর্ষা পেরোলে অপেক্ষার শেষ হবে!