ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ২০২৪ সালে নগরের ৮৫টি স্থানে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ২০২৫ সালে এ সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩৩–এ। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে নগরে জলাবদ্ধতাপ্রবণ এলাকার সংখ্যা কমেছে ৫২টি। স্থানীয় সরকার বিভাগে সম্প্রতি পাঠানো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়। চট্টগ্রামের দীর্ঘ কয়েক যুগের সমস্যা জলাবদ্ধতা। এক বছরের ব্যবধানে এ সমস্যা সমাধানের যে অগ্রগতি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। তবে এ উন্নতির কারণ হিসেবে জানা গেছে, চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে তদারকি করতে গত বছরের জানুয়ারিতে চারজন উপদেষ্টাকে দায়িত্ব দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গঠন করা হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টাদের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি। গত বর্ষা মৌসুমে নগরে দফায় দফায় বৈঠক করার পাশাপাশি নিয়মিত খাল পরিষ্কারসহ বিভিন্ন কার্যক্রম তদারকি করে কমিটি। এতে গতি বাড়ে জলাবদ্ধতা নিরসন সংক্রান্ত চলমান কাজের। এর সঙ্গে যোগ হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ। ফলে পূর্বের চেয়ে জলাবদ্ধতা সমস্যা থেকে কিছুটা মুক্তি পায় নগরবাসী।
এদিকে এক বছর দায়িত্ব পাওয়া চার উপদেষ্টার উপস্থিতিতে আগে নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে অগ্রগতি নিয়ে আজ বুধবার একটি সভা হওয়ার কথা রয়েছে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায়। এতে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। দায়িত্বপ্রাপ্ত চার উপদেষ্টা হচ্ছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, শিল্প এবং গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। এছাড়া স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন, চট্টগ্রম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এস এ মনিরুজ্জামান ও সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী নুরুল করিমসহ বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বশীল ২৫ কর্মকর্তাকে সভায় আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, জলাবদ্ধতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করেছি। এতে সাফল্য এসেছে। ১৬শ কিলোমিটার নালার কাজ করেছি। ৩ কোটি টাকা খরচ করে নৌ–বাহিনী দিয়ে আগ্রাবাদ এরিয়ায় ২৭ বছরের পুরনো বঙ কার্লভার্ট ক্লিন করেছি। সংযুক্ত নাছির খালও ক্লিন করেছি। মুরাদপুর ও বহাদ্দারহাটে এখন পানি ওঠেনা। কারণ, বহাদ্দারহাট মুখে নালার উপর থাকা একটা বড় মার্কেট আমরা ভেঙ্গে দিয়েছি। অন্যান্য যে সার্ভিস অরিয়েন্টেড অর্গানাইজেশন যেটা আর্মির ৩৪ ব্রিগেডের সাথে একসাথে কাজ করে নালাটার সংযোগটা বারইপাড়া খালের সাথে করে দিয়েছি। বারইপাড়া খাল দিয়ে সেটা কর্ণফুলী নদীতে পড়েছে। ফলে আমরা এখানে দৃশ্যমান রেজাল্ট পেয়েছি। সিডিএ, সেনাবাহিনীর ৩৪ ব্রিগেড ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন, পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা প্রশাসন, পুলিশ কমিশনার অফিসসহ সংশ্লিষ্টরাও আমাদের কর্মসূচির সাথে সমন্বয় করে কাজ করেছে।
মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল–নালা পরিষ্কারের সুবিধার্থে মেশিনারিজ এবং ইক্যুপমেন্ট সংগ্রহে সিটি কর্পোরেশনের ২৯৮ কোটি টাকার একটি প্রকল্প আটকে আছে। বিষয়গুলোও সভায় আমি তুলে ধরব। কারণ জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল–নালা পরিষ্কার এবং বর্জ্য অপসারণের জন্য ইক্যুপমেন্ট এবং মেশিনারিজ সংগ্রহ করা খুব জরুরি, এগুলোর বিকল্প নেই। সিডিএ’র চলমান মেগা প্রকল্পের ৩৬টি খাল আমাদের বুঝিয়ে দিলে ব্যবস্থাপনার জন্য বাজেট প্রয়োজন, সেটাও বলব। এছাড়া আমাদের আরো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরব।
যেভাবে কাজ করে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি : চলতি বছরের (২০২৪) ৫ জানুয়ারি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে প্রথম সভা করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টারা। এরপর ১৮ জানুয়ারি জলাবদ্ধতা প্রকল্পের বাস্তব অবস্থা জানতে নগরের বিভিন্ন খাল ও ড্রেন সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। পরদিন ১৯ জানুয়ারি সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, বন্দর, পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাগুলোর সাথে বৈঠক করেন। এতে এবছর জলাবদ্ধতা থেকে নগরবাসীকে মুক্তি দিতে ১১টি করণীয় নির্ধারণ করে তা বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ, নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ড্রেন পরিষ্কারসহ ১১টি করণীয় নির্ধারণ করে তা শেষ করতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধাারিত করণীয়গুলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক), সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিভাগীয় কমিশন, জেলা প্রশাসন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বাস্তবায়ন করার কথা। বলা হয়, যে সংস্থা বাস্তবায়ন করতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমনকি জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান প্রকল্পের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়া হতে পারে।
চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে অনুষ্ঠিত প্রথম সভার পর থেকে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসতে থাকে। গতি পায় খাল খননসহ পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান ১৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজও। এর বাইরে সিটি কর্পোরেশন নগরের বিভিন্ন খাল–নালা পরিষ্কার শুরু করে। এগিয়ে আসে বিএনপি–জামায়াতও, দল দুটির উদ্যোগেও পৃথক খাল খনন শুরু হয়। তৎপর হয় বিভাগীয় এবং জেলা প্রশাসনও।
জলাবদদ্ধতা নিরসনে চার প্রকল্প : জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরে বর্তমানে ১৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকার চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো হল– ৮ হাজার ৬২৬ কোটি ৬২ লাখ টাকা ব্যয়ে সিডিএ’র ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সমপ্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ শীর্ষক মেগা প্রকল্প, সিডিএ’র দুই হাজার ৭৭৯ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু থেকে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্প, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গৃহীত ‘বহাদ্দারহাট বাড়ইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল নতুন খাল খনন প্রকল্প ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের এ হাজার ৬২০ কোটি টাকায় গৃহীত ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা বা জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্প।












