এক বছরেই ‘ক্লিন, গ্রিন ও হেলদি সিটি’র পথে চট্টগ্রাম

আলমগীর মোহাম্মদ | শুক্রবার , ৩১ অক্টোবর, ২০২৫ at ৮:০৪ পূর্বাহ্ণ

৪ নভেম্বর, ২০২৫, এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেনের দায়িত্ব গ্রহণের এক বছর পূর্ণ হচ্ছে। গত বছরের শেষ দিকে, চরম অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং এক বিশাল প্রশাসনিক জঞ্জাল কাঁধে নিয়ে তিনি এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। মেয়র হিসেবে তাঁর এই এক বছরের পথচলা কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা প্রদর্শন নয়, বরং রুচি ও মেধাভিত্তিক নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগণের আস্থা ও প্রত্যাশা পূরণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই নগরীর প্রধান হিসেবে তাঁর প্রথম বছরের সফলতাগুলো প্রমাণ করে, একটি শহরকে আমূল পরিবর্তনের জন্য উচ্চশিক্ষা, পেশাগত সততা এবং সুদৃঢ় চারিত্রিক দৃঢ়তা কতটা অপরিহার্য।

ক্রিকেটের ভাষায়, তিনি যেন ব্রায়ান লারার মতো ঝলমলে না হয়েও শিবনারায়ণ চন্দরপালের মতো নীরব অথচ অবিচল নির্ভরতার প্রতীক। গত সতেরো বছর ধরে বিএনপির মতো একটি সংগঠনকে প্রতিকূল পরিবেশে তিনি যেভাবে আগলে রেখেছেন, তা তাঁর সাংগঠনিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক। কিন্তু মেয়র হিসেবে তাঁর আবির্ভাব কেবল রাজনীতির গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং প্রশাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা এই চারটি স্তম্ভে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছে।

দীর্ঘদিন ধরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ ছিল অনিয়ম ও দুর্নীতির এক ‘কালো অধ্যায়’। মেয়র হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেনের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এই আর্থিক দুর্বলতা দূর করা। তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই হোল্ডিং ট্যাক্স জালিয়াতির মাধ্যমে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৪০ কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা উন্মোচিত হয়। মেয়র কালবিলম্ব না করে জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে রাজস্ব বিভাগের দুই কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেন এবং তিনজন হিসাব সহকারীকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে অন্য বিভাগে সংযুক্ত করেন। শুধু তাই নয়, রাজস্ব ফাঁকি রোধে দায়িত্বে চরম অবহেলার অভিযোগে তিনি চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)-কেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে প্রমাণ করেন যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে পদপদবি কোনো বাধা হবে না। একইসঙ্গে, দীর্ঘদিনের সমন্বয়হীনতার অবসান ঘটিয়ে মেয়র দ্রুততম সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে কর্পোরেশনের দেনাপাওনা বিষয়ক অচলাবস্থা নিরসন করেন। এর ফলস্বরূপ, আর্থিকভাবে ধুঁকতে থাকা চসিক এক লপ্তে একশো কোটি টাকা পৌরকর আদায় করতে সক্ষম হয়যা কর্পোরেশনের আর্থিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে এক বিশাল অর্জন।

সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল বিগত দশ বছরের সবচেয়ে অবহেলিত খাত। শিক্ষক নিয়োগে নগ্ন দলীয়করণ ও অযোগ্য লোকজনের আধিক্যের কারণে পড়ালেখার পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। দায়িত্ব বুঝে নিয়ে মেয়র দ্রুত সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুলকলেজগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। এই খাতে তাঁর সবচেয়ে যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার। জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত, অথচ সাবেক সরকারের আমলে লুটে নেওয়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা ডা. শাহাদাতের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ও বিচক্ষণ পদক্ষেপের ফলে আদালতের রায়ে কর্পোরেশন তাদের স্বতন্ত্র এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পুনরুদ্ধার করে। তিনি প্রশাসনিক জটিলতা কাটাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য শিক্ষক প্রফেসর নছরুল কাদিরকে ভাইসচ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন, যা শিক্ষকশিক্ষার্থীদের মাঝে নতুন উদ্যম এনেছে। এছাড়াও, বৃহৎ পরিসরে অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম আয়োজনে তাঁর অনন্য ভূমিকা ছিল, যার ফলে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে এটি শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চে পরিণত হয়েছিল।

পেশায় চিকিৎসক হওয়ায় ডা. শাহাদাত হোসেন জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর একটি অভিনব উদ্যোগ হলো দেশে প্রথমবারের মতো চালু করা ‘স্টুডেন্টস হেলথ কার্ড’। প্রাথমিকভাবে পাঁচটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য চালু হওয়া এই কর্মসূচির লক্ষ্য হলো শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও টিকাদান নিশ্চিত করা, চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণ এবং ৫ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত মোট ১৪ বার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রেকর্ড রাখা। এটি শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যসচেতনতা সৃষ্টি করে ক্লিন, গ্রিন, হেলদি চট্টগ্রাম গড়ে তোলার এক সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ। পাশাপাশি, এই লক্ষ্য পূরণে তিনি পরিচ্ছন্নতা বিভাগে গতিশীলতা আনার জন্য কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। ‘ডোর টু ডোর’ সেবার মান পর্যবেক্ষণে তিনি এক মাসের নিবিড় পর্যবেক্ষণের ঘোষণা দেন এবং রাতের বেলা বিভিন্ন ওয়ার্ডে সরেজমিন ঘুরে কর্মস্থলে অনুপস্থিত কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থার হুঁশিয়ারি দেন।

চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দুটি দুঃখ জলাবদ্ধতা এবং ভগ্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা তাঁকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করেছে। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই তিনি জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সাথে শেষ করার কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই উদ্যোগের ফলস্বরূপ, এবার টানা চার দিনের ভারী বর্ষণেও নগরবাসীকে আগের মতো জলের তলে তলিয়ে যেতে হয়নি যা নগরবাসীর কাছে এক বিশাল স্বস্তির বিষয়। তিনি চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে মনোরেল এবং আধুনিক ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করার মতো একাধিক বড় পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন এবং সকল ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদারদের উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন: মানসম্মত ও টেকসই রাস্তা নির্মাণে কোনো ধরনের কারচুপি সহ্য করা হবে না।

তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও বিচক্ষণ প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ফলস্বরূপ, দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই চসিক দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। বিদায়ী ২০২৪২০২৫ অর্থবছরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সিটি গভর্ন্যান্স মূল্যায়নে চসিক দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। ১৫টি সূচকের উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত এই মূল্যায়নে চসিক ১০০ নম্বরের মধ্যে ৯০ নম্বর পেয়েছিল। বিশেষত আর্থিক ব্যবস্থাপনা (৩৭/৪০) ও নাগরিক সম্পৃক্ততা (৩০/৩০)-তে তাঁর নেতৃত্বাধীন চসিক অসাধারণ সাফল্য দেখায়।

ডা. শাহাদাত হোসেনের মেয়র হিসেবে প্রথম বছর প্রমাণ করেছে যে যোগ্য নেতৃত্ব থাকলে একটি প্রতিষ্ঠানকে দ্রুত গতিতে ইতিবাচক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তিনি কেবল প্রশাসনিক জঞ্জাল পরিষ্কার করেননি, বরং দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর ‘স্কুল হেলথ কার্ড’ ও বিশ্ববিদ্যালয় পুনরুদ্ধার দেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে পেশাগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার সঠিক প্রয়োগের উজ্জ্বল উদাহরণ। এখন চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা, মেয়রের এই ‘কাজ পাগল’ মানসিকতা যেন ভবিষ্যতে আরও গতিশীল হয়। চট্টগ্রামকে বিশ্বমানের, গ্রিন ও হেলদি সিটি নির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর গৃহীত উদ্যোগগুলো সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে ডা. শাহাদাত হোসেন সত্যিকার অর্থে একজন ‘জনতার মেয়র’ হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নেবেন এবং চসিক দেশের জন্য একটি মডেল কর্পোরেশনে পরিণত হবে।

লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও অনুবাদক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইস্তেগফারের কুরআনীয় কনসেপ্ট: বিশ্ব মুসলিমের জন্য মুক্তির বার্তা
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা