প্রকৃতির নিয়মেই একসময় সব মানুষকেই চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। কিন্তু কারো চলে যাওয়ায় মানুষের মধ্যে রক্তক্ষরণ হয়, কষ্ট হয়, হাহাকার ওঠে, সৃষ্টি হয় এক ভয়ঙ্কর শূন্যতার। একজন দার্শনিকের কথায় ‘কারো মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়ে ভারি, আবার কারো মৃত্যু বেলে হাসের পালকের চেয়ে হালকা’। যারা মানুষের জন্য, মানবতার জন্য কাজ করে তাদের মৃত্যু থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারি। মানুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম আর মানব সভ্যতা অনন্তকাল তাদের স্মৃতি ও কর্মকে বয়ে বেড়ায়। এসব মানুষদের মধ্যে অন্যতম বিজ্ঞানী, শিক্ষক, চিন্তাবিদ ও এক পরম সংবেদনশীল মানুষ প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া। এত শীঘ্রই, এত অগোচরে, সবাইকে অনেকটা না জানিয়ে তিনি চলে যাবেন কেউ ভাবতে পারেনি। তার গুণগ্রাহী সুহৃদ কিংবা আপনজনরা তাকে আরো বহুদিন পাবে বলে আশা করেছিল। তবু তিনি চলে গেলেন। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংগঠক পদার্থবিজ্ঞানী একুশে পদক প্রাপ্ত প্রফেসর ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন শিক্ষাবিদ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নাগরিক আন্দোলনের সামনের সারির সংগঠক। তার তিরোধানে চট্টগ্রামের মানুষ তাদের এক প্রিয় অভিভাবককে হারাল। সাধারণ মানুষ, দলিত মানুষ, অভিভাবকহীন মানুষের তিনি ছিলেন অভিভাবক। শিশুর মত সরল ছিলেন তিনি। আকাশের মত উদার ছিল তার মন। বিশ্বের যাবতীয় জ্ঞানভাণ্ডারে তার ছিল স্বভাবসিদ্ধ যাতায়াত। তার চিন্তা ও জানার জগৎ ছিল বিশাল ক্যানভাসের। যে কেউ যে কোনো সভায় ডাকলে তাকে পেতেন বিনা অজুহাতে। সময়মত অনুষ্ঠানে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন। শোষণহীন, সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। মানুষের উপর অগাধ বিশ্বাস ছিল মহান এই শিক্ষাবিদ এবং সংগঠকের। জনগণের শক্তির উত্থান চাইতেন সব সময়। যেখানেই মানুষের স্বার্থের কথা সেখানে তিনি চলে যেতেন একজন সাধারণ মানুষের মত। কারো ডাকার অপেক্ষা করতেন না তিনি। দুনিয়ার সর্বশেষ আবিষ্কার আর মানুষের সংগ্রামের খবর রাখতেন তিনি। বক্তব্য রাখতে গিয়ে এক জগৎ থেকে আরেক জগতে চলে যেতেন। এতে অনেকে হয়ত বিরক্তও হতেন কখনও কখনও। তবু নিজের মধ্যে থাকা অনেক কিছুকে ব্যক্ত করতেন তিনি মানুষের লড়াইকে শানিত করতে। তাঁর বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ নজরুল সুকান্ত থেকে শুরু করে শেঙপিয়ার মিল্টন সবাইকে তিনি উদ্ধৃত করতেন অহরহ। বলার চেষ্টা করতেন সকলের অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষা এবং মানুষের মুক্তির জন্য কাজ করা। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন। সারা জীবন কাজ করেছেন পদার্থ বিজ্ঞানের মতো মৌলিক বিজ্ঞান নিয়ে। এক কথায় একজন সমগ্র মানুষ হওয়ার জন্য যতগুলো মহৎ গুণাবলী থাকা দরকার তার বেশিরভাগই ছিল এ মহৎ মানুষটির মধ্যে।
প্রগতিশীল বিভিন্ন আন্দোলনের পাশাপাশি পরিবেশসহ বিভিন্ন সামাজিক ও নাগরিক আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে এত ধরনের সাফল্যের অনেক কিছুই অনেকের জানা ছিল না। একুশে পদক প্রাপ্ত ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন আত্মপ্রচারবিমুখ, এক অতি নির্লোভ সহজ সরল মানুষ। চট্টগ্রামের রিকশা চালক, সাম্পানের মাঝি, কারখানা শ্রমিক এমনকি মাঠের কৃষক সবার কাছে তিনি ছিলেন স্যার। তাঁর সরলতায় ও মহত্মতায় মানুষ মুগ্ধ হতো। কোনো দলের পরিচয়ে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার সুযোগ দেননি এই মানুষটি। সংগঠক ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া শুধু একটি নামই নয়, একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি সত্যিকার এক কর্মীবান্ধব সংগঠক ছিলেন। কর্মীবান্ধব ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার কাছে যে কোনো পর্যায়ের সংগঠক যে কোনো সমস্যা নিয়ে তার কাছে গেলে তিনি কাউকে বিমুখ করতেন না। আর কিছু না হোক অন্তত মনযোগ দিয়ে তার কথা শুনতেন। সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। বর্তমান প্রেক্ষিতে কর্মীদের সম্মান জানানো, গুরুত্ব দিয়ে তাদের অভাব অভিযোগ শোনার মানুষ খুব অভাব। এ ক্ষেত্রে ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন ব্যতিক্রম। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী দুঃসময়ে ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়ার ভূমিকা চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রত্যেকটি সামাজিক আন্দোলনে ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া অত্যন্ত দুঃসাহসী ভূমিকা পালন করে গেছেন। মানবতার জন্য, মানুষের জন্য সংবেদনশীল এ মানুষটিকে হারিয়ে কেবল চট্টগ্রামের মানুষ নয় সব মানুষ যারা তাকে চিনতেন তারা বেদনাবিদ্ধ। তাঁর অনুপস্থিতি সবাইকে বার বার তাঁর কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। গণতন্ত্র ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পক্ষের সাহসী মানুষ ছিলেন ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া। মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সর্বদা সোচ্চার। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও ড. বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া ছিলেন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তাঁর মহাপ্রয়াণে আমরা একজন বিবেকবান অভিভাবককে হারালাম। তিনি তাঁর বিভিন্ন প্রকাশিত লেখনীর মাধ্যমে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের নানা বাঁকের বর্ণনা করেছেন নিরপেক্ষভাবে। তিনি ছিলেন একজন আলোকিত মানুষ। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন বাঙালি চিরদিন তা মনে রাখবে।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, রামু সরকারি কলেজ