এক দশকে তরুণদের মধ্যে ডায়াবেটিস আক্রান্ত বেড়েছে দ্বিগুণ

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত রোগে বিশ্বে প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ রোগীর পা কেটে ফেলার অন্যতম কারণও ডায়াবেটিস। ফলে রোগটি চিহ্নিত হয়েছে একটি নীরব ঘাতক ব্যাধি হিসেবে। আর বিশ্বব্যাপী এই রোগের ভীতিকর প্রভাবকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে ডায়াবেটিসের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে জাতিসংঘ। যক্ষ্মা ও এইচআইভি/এইডসসহ নানা সংক্রামক রোগের পাশাপাশি কোনো অসংক্রামক ব্যাধিকে প্রথমবারের মতো বিশ্বজনীন স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেটি হলো ডায়াবেটিস। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য মতে, প্রতি ১১ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত (২০১৯ সালের তথ্য)। হিসেবে বিশ্বে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ৪২৫ মিলিয়ন। তবে ২০৪৫ সালে ৪৮ শতাংশ বেড়ে আক্রান্তের এই সংখ্যা ৬২৯ মিলিয়নে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা সংস্থাটির। সংস্থাটি বলছে, পৃথিবীর মোট ডায়াবেটিস রোগীর ৮৭ শতাংশই উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলোর বাসিন্দা। এছাড়া গড়ে প্রতি ৬টি নবজাতকের ১ জন মায়ের ডায়াবেটিস দ্বারা আক্রান্ত। আতংকের বিষয়, প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি দুজন মানুষের একজন জানেনই না তিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এর পিছনে সচেতনতার অভাবকেই দেখছেন চিকিৎসকরা। সম্প্রতি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস
ও হরমোন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ও বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতাল এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের জনস্বাস্থ্য বিভাগ যৌথভাবে ২১০০ জনের উপর একটি গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য মতে, গৃহিণীদের বড় একটি অংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। তরুণদের মধ্যেও গত এক দশকে এ রোগে আক্রান্তের হার দ্বিগুণ বেড়েছে। ৬০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা প্রকট। এছাড়া ডায়াবেটিসে ভুগছেন এমন রোগীরা দীর্ঘমেয়াদী জটিলতায় যেমন স্নায়ুবিক সমস্যা, চোখের সমস্যা, পায়ের সমস্যা, হৃদরোগে আক্রান্ত। গবেষণায় দেখা যায়, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ৬০ শতাংশ রোগী শহরের এবং বাকি ৪০ শতাংশ রোগী গ্রামের। আবার গ্রামের আক্রান্তদের মাঝে ৫৯ জনই নারী, যাদের বেশিরভাগই গৃহিণী।
গবেষকরা বলছেন, শহরের মতো গ্রামেও ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অর্ধেকের বেশি ডায়াবেটিস রোগী বিষণ্নতায় ভোগেন, চলাফেরায় সমস্যা অনুভব, দুর্বলতা, ব্যথা ও অস্বস্তি অনুভব করেন। চট্টগ্রামের উচ্চবিত্ত এলাকার মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বর্তমানে বেশি হলেও নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের মধ্যেও এর হার কম নয়। প্রায় ৫০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী তাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে সন্তুষ্ট নয় বলে গবেষণায় উঠে আসে।
গবেষকদলে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকলোজি বিভাগের শিক্ষক আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডায়াবেটিস হরমোন রোগ বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার, চবি শিক্ষক নাইম চৌধুরী ও মাহবুব হাসান, চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালে উপ-পরিচালক ডা. নওশাদ আজগর চৌধুরী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের জনস্বাস্থ্য বিভাগের ডা. নাজমুল আলম ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডা. মাসুদ রানা।
অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন, বিষণ্নতায় থাকা ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ বলে মনে করেন চমেক হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগের প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার। চট্টগ্রামে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা গত বিশ বছরে তিন গুণ বেড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে ৩০ ভাগের ক্ষেত্রেই ওষুধ সেবন, হাঁটা-চলা কোনোটির মাধ্যমেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হচ্ছে না। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের পেছনে চট্টগ্রামের ভৌগোলিক অবস্থানও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে মনে করেন তিনি।
অন্যদিকে, প্রতি ৭ জন গর্ভবতী নারীর ১ জনের শরীরে ডায়াবেটিস ধরা পড়ছে বলে জানান চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সাবেক প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা হাসিনা আক্তার লিপি। উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এটি গভীর আতংকের বিষয়। কারণ, নারীর গর্ভধারণের আগে বা গর্ভকালীন সময়ে সচরাচর ডায়াবেটিস পরীক্ষা করানো হয় না। গর্ভবতী নারীর শরীরে ডায়াবেটিস থাকলে গর্ভের শিশুটিও ডায়াবেটিসে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। অথচ প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। কিন্তু ধরা না পড়লে মায়ের পাশাপাশি শিশুর যথেষ্ট ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। তাই সচেতন হওয়ার পাশাপাশি যত দ্রুত সম্ভব শরীরে ডায়াবেটিস রয়েছে কিনা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
আগে বয়স্করা ডায়াবেটিসে বেশি আক্রান্ত হলেও বর্তমানে ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সীদের শরীরে ডায়াবেটিস বেশি ধরা পড়ছে বলে জানান হাসিনা আক্তার লিপি। বেশি বেশি ধূমপান, ত্রুটিযুক্ত খাদ্যাভাস ও শারীরিক পরিশ্রম না করার কারণেই তরুণরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন বলে মনে করেন তিনি।
চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে বর্তমানে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। প্রতি বছর এ সংখ্যা বাড়ছে। তবে শঙ্কার বিষয় হলো, প্রতি দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে একজন এখনো জানতে পারছেন না তার ডায়াবেটিস রয়েছে। রোগ শনাক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ। শনাক্ত করা না থাকলে ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়। বর্তমানে বিশ্বে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ১০ম স্থানে।
এরই মাঝে আজ ১৪ নভেম্বর পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস। ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে চট্টগ্রামেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। বিশ্বজুড়ে ডায়াবেটিস রোগ ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিশ্ব ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এদিন বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক বেনটিং জন্ম নিয়েছিলেন এবং তিনি বিজ্ঞানী চার্লস বেস্টের সঙ্গে একত্রে ইনসুলিন আবিষ্কার করেছিলেন।
দিবসটি উপলক্ষে চট্টগ্রামে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি। চট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির উদ্যোগে নগরীর ডায়াবেটিক জেনারেল হাসপাতাল প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি পালন করা হবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগের আয়োজনে থাকছে নানা কর্মসূচি। দিবসটি উপলক্ষে থাকছে র‌্যালি, সেমিনার ও আলোচনা সভা।
ডায়াবেটিস কি : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস মূলত একটি বিপাকজনিত রোগ। ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাবে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা দেহে জটিলতা সৃষ্টি করে। এছাড়া শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপক পরিবর্তন, স্থূুলতার পাশাপাশি বার্ধক্যও ডায়াবেটিসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এ কারণে এই রোগের ব্যয়টাও একটু বেশি। ডায়াবেটিস প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম বলে জানান চিকিৎসকরা। প্রতিকার হিসেবে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও ওজন নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ করে চিকিৎসকরা বলছেন, শুধু সচেতন হলে এবং কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ রোগ ৭০ ভাগ প্রতিরোধ সম্ভব।
ডায়াবেটিস আক্রান্তের নেপথ্যে কায়িক পরিশ্রম না করা, মোটা হওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে না রাখা, ফাস্ট ফুড খাওয়া ও কোমল পানীয় পান করাকে অন্যতম কারণ হিসেবে বলছেন চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা বলছেন, সচেতনতার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ না করলে রোগীর কিডনি, চোখ, হার্ট, যৌন দুর্বলতা, দাঁত, চামড়া, পা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। ফলে শারীরিক জটিলতার পাশাপাশি অন্ধত্ব ও পঙ্গুত্ব বরণ করা ছাড়াও অকালে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
ডায়াবেটিস জটিলতার কারণে অনেক সময় পায়ে পচনশীল রোগ হয়ে পা কেটে ফেলার মতো ভয়ংকর অবস্থারও সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডায়াবেটিস চিকিৎসায় পাঁচটি নিয়ম মেনে চললে বেশ কিছু জটিলতা (অন্ধত্ব, হার্ট এটাক, কিডনি বিকল হওয়া ও পঙ্গুত্ব) রোধ করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুষম খাদ্য ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হওয়া, শরীরের ওজন আদর্শ ওজনে রাখা অর্থাৎ বিএমআই ২৫-এর মধ্যে রাখা, ডায়াবেটিস শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া, নিয়মিত ব্যায়াম করা এবং ওষুধ-ইনসুলিন ও নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মতো চলা। এই নিয়মগুলো মেনে চললে ডায়াবেটিস রোগীদের বড় ধরনের জটিলতায় পড়ার আশঙ্কা কম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশের সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে হাইকোর্টের নির্দেশ
পরবর্তী নিবন্ধপাকিস্তানের স্বপ্ন ভেঙে বিশ্বসেরা ইংল্যান্ড