চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) এলইডি বাতি স্থাপন সংক্রান্ত একটি প্রকল্পের পুনঃদরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি। এর প্রেক্ষিতে পুনঃদরপত্রের অনুমোদন চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পত্রও দেয় সংস্থাটি। তবে মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত জানানোর আগেই আরেকটি চিঠি দেয় চসিক। এতে পূর্বে আহূত দরপত্র এবং টেন্ডার সিকিউরিটির সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়, যা প্রথম চিঠির সঙ্গে ‘সাংঘর্ষিক’ বলে জানিয়েছেন চসিকের একাধিক প্রকৌশলী। এদিকে প্রকল্পটির মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব করে চসিক। অথচ এর আগেও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল। এ অবস্থায় বারবার মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে চসিকের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার ভারতীয় ঋণ সহায়তা প্রকল্পের অধীনে ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্স এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক এলইডি বাতি স্থাপন প্রকল্পটি ২০১৯ সালের ৯ জুলাই একনেকে অনুমোদন পায়। প্রকল্পের আওতায় নগরের ৪১ ওয়ার্ডে মোট ৪৬৬ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন করা কথা। উল্লেখ্য, গত ২৯ মে অনুষ্ঠিত চসিকের সর্বশেষ সাধারণ সভায় প্রকল্পটির ধীরগতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন সিটি মেয়র। এছাড়া প্রকল্পে ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ‘অনিয়ম’ প্রক্রিয়ায় পিপিআর ‘লঙ্ঘন’ করায় প্রকল্প পরিচালককে শোকজ করা হয়।
দরপত্র নিয়ে দুই রকম চিঠি : প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর। দরপত্র দাখিলের শেষ দিনে একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর তিনজন বিডার অংশ নেন। পরবর্তীতে দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি ও ২৭ মার্চ পৃথক দুইটি সভা করে। সভায় চসিকের চাহিদার প্রেক্ষিতে এলজিইডি থেকে আসা ‘পিপিআর’ বিশেষজ্ঞের মতামতের প্রেক্ষিতে পুনরায় দরপত্র আহ্বানের সুপারিশ করা হয়। পরবর্তীতে ৫ মে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ শহীদুল আলম স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে প্রকল্পের পুনঃদরপত্র আহ্বানের অনুমোদন চেয়ে দাপ্তরিক পত্র দেন। এদিকে ২৬ মে আরেকটি পত্র পাঠানো হয় মন্ত্রণালয়ে। এতে স্বাক্ষর করেন সিটি মেয়র। চিঠিতে দরপত্রের বিদ্যমান মেয়াদ ৯০ দিন এবং টেন্ডার সিকিউরিটির মেয়াদ ২৮ দিন বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। দরপত্র আহ্বানের পর তার মেয়াদ থাকে ১৮০ দিন। ওই হিসাবে বিদ্যমান দরপত্রের মেয়াদ ২০২১ সালের ১৪ ডিসেম্বর থেকে আগামী ১২ জুন পর্যন্ত রয়েছে। যা ৯০ দিন বৃদ্ধির করে আগামী ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়। এছাড়া টেন্ডার সিকিউরিটির মেয়াদ আছে আগামী ১০ জুলাই পর্যন্ত। তা বৃদ্ধি করে ৮ অক্টোবর করার প্রস্তাব করা হয়।
ব্যাখ্যা চেয়েছে মন্ত্রণালয় : গত ২৮ মার্চ প্রকল্পের মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধির জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেয় চসিক। অথচ একনেকে অনুমোদনের সময় প্রকল্পটির মেয়াদ ধরা হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। অবশ্য প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন অনুযায়ী প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর।
এ বিষয়ে চসিকের একটি নথিতে উল্লেখ করা হয়, প্রকল্পের প্রশাসনিক অনুমোদন হয় ২০১৯ সালের ১৯ নভেম্বর। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতির কারণে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ পরিকল্পনা কমিশন, ভৌত অবকাঠামো বিভাগ প্রকল্পের মেয়াদ ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধির অনুমোদন দেয়।
এদিকে চসিক সর্বশেষ মেয়াদ বৃদ্ধির যে আবেদন করে এর প্রেক্ষিতে ব্যাখা চেয়েছে মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে গত ২৬ মে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সহকারী সচিব পলি কর স্বাক্ষরিত চসিক পত্রে বলা হয়, প্রকল্পের বার বার মেয়াদ বৃদ্ধির কারণ/ ব্যাখ্যা জানা প্রয়োজন। ব্যাখ্যা জরুরি ভিত্তিতে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানানোর জন্য নির্দেশ দেয়া হয় ওই পত্রে।
দরপত্রের সময় বৃদ্ধি নিয়ে নানা প্রশ্ন : জানা গেছে, চুক্তি অনুযায়ী ভারতের এক্সিম ব্যাংক তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের শর্ট লিস্ট পাঠায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে– ‘এনার্জি ইফিসিয়েন্সি সার্ভিসেস লিমিটেড’, ‘সিগনিফাই ইনোভেশন্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’ এবং ‘শাপর্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’। একইভাবে বাংলাদেশের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হয় প্রকল্পের জন্য। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে– ‘ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড’, ‘এইচটিএমএস লিমিটেড’ ও ‘ফটো স্টার লিমিটেড’। শর্ট লিস্টের প্রতিষ্ঠানগুলোই দরপত্রে অংশ নেয়। বাছাই শেষে ভারতীয় একটি ও বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত করা হবে। যারা যৌথভাবে কাজ করবে।
নিয়ম অনুযায়ী একই ব্যক্তির মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নিতে পারবে না। তবে শর্ট লিস্টে থাকা বাংলাদেশের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেড ও এইচটিএমএস লিমিটেড এর সঙ্গে একই ব্যক্তির সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চসিকের বিভিন্ন নথিপত্রে এইচটিএমএস লিমিটেড এর পরিচালক হিসেবে প্রকৌশলী মো. মাহবুব হোসাইনের নাম রয়েছে। আবার ট্রেড ম্যাজিস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও তার নাম রয়েছে।
চসিকের একাধিক প্রকৌশলী জানিয়েছেন, বিদ্যমান দরপত্রের সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব করে ‘কৌশলে’ পুনঃদরপত্র আহ্বান প্রক্রিয়াকে আড়াল করার চেষ্টা করা হচ্ছে। কারণ পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হলে একই ব্যক্তির দুই প্রতিষ্ঠানের অংশ নেয়ার সুযোগ বন্ধ হবে।
মেয়র যা বললেন : প্রকল্পের সামগ্রিক বিষয়ে মেয়র দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এখন মন্ত্রণালয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দিবে সেভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করব।
দুটো চিঠি প্রেরণ প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, আমরা সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। সে আলোকে রি–টেন্ডারের প্রথম চিঠি দেয়া হয়েছে। দ্বিতীয় চিঠি প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, ভারতীয় ব্যাংকের সম্মতির প্রয়োজন আছে। আবার জিনিসপত্রেরও দাম বেড়ে যাচ্ছে। বিলম্ব করতে গিয়ে যদি প্রকল্পই বাতিল হয়ে যায় তখন কী হবে। তাই দ্বিতীয় পর্যায়ের চিঠিটি দেয়া। প্রথম চিঠির সঙ্গে এটা সাংঘর্ষিক হবে না।
এক ব্যক্তির দুই প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভায় ধরা পড়লে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসলে আমরা চাচ্ছি, যেন প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়। লম্বা প্রক্রিয়া করতে গিয়ে যদি ভারতীয় ব্যাংক বলে, আমরা টাকা দিবো না, তখন তো আমরা বঞ্চিত হয়ে যাব।
প্রকল্পের সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, প্রজেক্টের সময় বৃদ্ধি না করলে তো রি–টেন্ডারও করা যাবে না। পুনরায় দরপত্র আহ্বান করা হোক বা দরপত্র বাস্তবায়ন করা হোক, যাই করা হোক না কেন সময় বৃদ্ধি করতেই হবে।