যুগে যুগে লক্ষ–কোটি মানুষের আগমন হচ্ছে পৃথিবীতে, আবার বিদায়ও নিচ্ছে। কিন্তু পৃথিবীতে সবাই স্মরণীয় হয়ে থাকে না। পৃথিবীতে তারাই স্মরণীয় হয়ে থাকে, যারা পৃথিবীর পরিবর্তনে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে। তেমনি যখন তুরস্কে ইসলাম ছিল নিষিদ্ধ। মুসলিম নিজেকে মুসলিম বলে পরিচয় দিতে ভয় পেত। আল্লাহর ফরজ বিধান পালনে থাকতো বাধা। ভয়ে সবাই স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তখনই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঘুমন্ত জাতিকে জাগ্রত করার লক্ষ্যে এক ঘুম ভাঙা সিংহের আবির্ভাব হয়। তাঁর নাম প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান হোজা।
তিনি ১৯৬৯ সালে প্রখ্যাত আলেম মেহমেদ জাহিদ কতকু’র পরামর্শে রাজনীতিতে পদার্পন করেন এবং মাত্র ১০ জন উন্মাদকে নিয়ে মিল্লি গুরুশ (ইসলামি ভিশন) আন্দোলনের যাত্রা শুরু করেন। এরবাকান হোজা দল গঠনের পরপরই বলেছিলেন, “আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আমরাই থাকবো।” নির্বাচনের ফলাফলে মিল্লি সালামেত পার্টির আসন সংখ্যা মাত্র ৪৮ টি। বাধ্য হয়ে ঈঐচ মিল্লি সালামেত পার্টির দাবি (৫ মন্ত্রণালয় ও ভাইস প্রাইম মিনিস্টার পদ দেওয়ার শর্তে) কোয়ালিশন করে। সেদিন এরবাকান মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন, এখন ক্ষমতায় কারা? মাত্র ৪৮টি আসন নিয়ে ১৯৭৪ সাল থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত ৪ বছরের ক্ষমতায় আমেরিকাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মুসলিমদের অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন এরবাকান উপ–প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময় তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেন সফরে যায়। তখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় এরবাকানের উপর। তিনি কালক্ষেপন না করে সেনাবাহিনীকে সাইপ্রাস দখলের নির্দেশ দেন। আমেরিকার এয়ারক্রফট যদি আসে সেখানেও হামলার নির্দেশ দেন।
সেদিন সাইপ্রাস বিজয়ের পর কথা বলার সাহস হয়নি আমেরিকার। পরে তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী দ্রুত বৃটেন ত্যাগ করে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়। ১৯৭৪ এর সাইপ্রাস বিজয়ের পর তুরস্কের ওপর ঊসনধৎমড় বা বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা। সেসময় তুরস্কের ইসলামপন্থিসহ অনেকেই তাকে দোষারপ করেছিল এবং শঙ্কিত ছিল আমেরিকার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। এরবাকান সংসদে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে আমেরিকার ভয়ে ভীতুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা আমার কী করবে?’ এই সিংহ পুরুষ এরবাকান সেই সময় আমেরিকার এমবার্গো দেওয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে আমেরিকার ২৫টি ঘাঁটি বন্ধ করে দিয়ে সেখানে তুরস্কের পতাকা উড়িয়ে দেয়।
১৯৮০ সালে এরবাকান হোজার দল বিরোধী দলে ছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় পরবর্তীতে তুরষ্কের মাটিতে আমেরিকার সকল সামরিক ঘাঁটি চালু করা হয়। আজ এ সকল ঘাঁটি থেকেই প্রতিনিয়ত বিমান হামলা হচ্ছে– সিরিয়াতে, ইরাকে। আর নিহত হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা।
এরবাকান হোজা তুরষ্কের অবকাঠামোগত উন্নয়নেও মনোযোগ দিয়েছিলেন। তাঁর দল মিল্লি সালামেত ও রেফাহ পার্টির শাসনামলে ১৮টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ১৬টি সার কারখানা, ১৪টি চিনির ফ্যাক্টরি, ২৩টি সুমের ব্যাংক ফ্যাক্টরি, ৬টি উদ্ভিদ ফ্যাক্টরি, ৭৭টি বৃহৎ শিল্পসেবা প্রতিষ্ঠান, ৬৩টি ঙৎমধহরুবফ রহফঁংঃৎরধষ তড়হব, ২৫৩টি ছোট শিল্প–কারখানা, ৩২টি বৃহৎ মেশিনারি ফ্যাক্টরি, ৪টি নৌ কারখানা, ১০টি ইঞ্জিন ফ্যাক্টরি, ১১টি ইলেক্ট্রো–মেকানিক্যাল শিল্প কারখানা, ৩টি গবেষণা সেন্টার (প্রাকৃতিক সম্পদ), ৪টি ইলেক্ট্রোনিক শিল্প কারখানা গড়ে তোলেন এবং সর্বশেষ ঞধশংধহ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। যা ফ্যাক্টরি বানানোর ফ্যাক্টরি ছিল। এটাই সত্যিকারের উন্নয়ন। যারা রাস্তাঘাট আর বিল্ডিং এর মধ্যে উন্নয়ন খোঁজে তারা হয় অন্ধ, না হয় অজ্ঞ। কেননা, এই সাদা বিল্ডিং আর রাস্তাঘাট আমাকে আপনাকে খাবার দিবে না। রেড ইন্ডিয়ানরা একটা কথা বলেছিলেন, “যখন নদীর মাছ শেষ হয়ে যাবে, গাছপালা ধ্বংস হয়ে যাবে, খাবারের অবশিষ্ট আর কিছুই থাকবে না, তখন এই সাদা চামড়ার ব্রিটিশরা বুঝতে পারবে যে, টাকা চিবিয়ে খাওয়া যায় না।” বর্তমান সময়ে ভারী শিল্পে উন্নয়ন ব্যতীত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি তুরস্কের শিল্প বিপ্লব ঘটান। এজন্যই এরবাকান হোজাকে তুরস্কের শিল্প বিপ্লবের অঘোষিত জনক বলা হয়।
আমেরিকা, ইসরাইল, ন্যাটোর ভয়ে যখন কেউ নির্যাতিত মুসলিমদের পাশে দাঁড়ানোর সাহস পাচ্ছিলো না, তখন প্রফেসর এরবাকান ক্ষমতায় থেকে হোক আর না থেকেই হোক অসহায় মুসলিমদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি সর্বদা মুসলিমদের ঐক্যের জন্য কাজ করেছেন। এবং আমেরিকা–ইসরাইলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে কট্টর ছিলেন। একবার সাবেক প্রেসিডেন্ট আব্দুল্লাহ গুল প্রফেসর এরবাকানকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হোজা, আমেরিকার সাথে আমরা কীভাবে পেরে উঠবো?”
এরবাকান হোজা হেসে বলেছিলেন, “তুমি এ কথা বলার মাধ্যমেই নিজেকে ওদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসে ও গোলামে পরিণত করেছ। মিল্লি গুরুশ কী, তুমি কী ভুলে গিয়েছ? আমরা শুধু ক্ষমতায় থাকার জন্য নয় বরং সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য রাজনীতি করি।”
তিনি সবসময় জায়োনিজমের হাত থেকে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করতে এবং একটি বাসযোগ্য পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। প্রফেসর ড. এরবাকান ১৯৯৭ সালে ক্ষমতায় থাকাকালীন ফিলিস্তিনে ইসরাইল কোনো হামলা করার সাহস দেখায়নি। সে সময়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনারা কী কারণে ফিলিস্তিনে হামলা করেননি?’ উত্তরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “যে ব্যক্তি এক দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা পেয়ে সাইপ্রাস দখল করে নিতে পারে, তার ক্ষমতাকালে ফিলিস্তিনে হামলা করা আত্মহত্যার শামিল।”
ড. এরবাকান হোজা তাঁর ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবদ্দশায় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছেন মাত্র পঁচিশ বছর। আর বাকি ১৫ বছর তাঁর কেটেছে জেলে অথবা রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ অবস্থায়। তিনি একাধারে একজন প্রধানমন্ত্রী, গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, কুরআনের হাফেজ, আলেম ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। এই সাহসী সিংহ পুরুষ ২০১১ সালে আল্লাহর জিম্মায় চলে যান। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের উত্তম স্থান দান করুন।
সূত্র: অনুবাদক, মু. বুরহান উদ্দিনের অনুবাদকৃত ‘ইসলাম ও জ্ঞান’ বইয়ের অনুধাবনে লেখা