একজন ভালো শিক্ষক মানুষকে কতটা অনুপ্রাণিত করতে পারেন, কল্পনাকে বাস্তব রূপ দান করতে পারেন ও শেখার প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলতে পারেন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত শ্রদ্ধেয় অজিত কুমার আইচ। আমাদের সর্বজন পরিচিত সবার প্রিয় অজিত স্যার। চট্টগ্রাম শহরের বুকে কম মানুষই আছেন যারা অজিত স্যারকে চেনেন না। কথিত আছে ‘থাকতে মানুষের মূল্য বোঝা যায় না’। কিন্তু এই প্রবাদটি অজিত স্যারের বেলায় বড্ড বেমানান। তিনি থাকতেও সবার হৃদয়ে ছিলেন, চলে গিয়েও সবার মধ্যে আছেন। যিনি তার সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি তাকে মনে রেখেছেন। এমন ব্যক্তিত্বকে কেউ কখনোই ভুলবে না। উইলিয়াম আর্থার ওয়ার্ড বলেছেন, ‘মাঝারি মানের শিক্ষক বলেন, ভালো শিক্ষক বুঝিয়ে দেন, শ্রেষ্ঠ শিক্ষক করে দেখান, আর মহান শিক্ষক অনুপ্রাণিত করেন’। সত্যিই আমরা একজন মহান শিক্ষককে হারিয়েছি।
অজিত কুমার আইচ ১৯৪৭ সালের ৩০ শে জুন চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলাধীন জিরি ইউনিয়নের অন্তর্গত মহিরা গ্রামের যোগেন্দ্র লাল আইচ ও বিজলী প্রভা আইচের ঘর আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করেন। মহিরা–হিখাইন জগদ্বন্ধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা শেষে কর্তালা বেলখাইন মহাবোধি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস এস সি উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৫ সালে পটিয়া কলেজ থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে এইচ এস সি উত্তীর্ণ হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্যার আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। অসুস্থতার জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণ সম্ভব হয়নি বলে পরবর্তীতে তিনি বহিরাগত পরীক্ষার্থী হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। চট্টগ্রাম টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বি.এড এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ১৯৭৭–৭৮ শিক্ষাবর্ষে বি.এড ডিগ্রি এবং ১৯৯৭–৯৮ শিক্ষাবর্ষে একই কলেজ থেকে এম.এড (২য় ব্যাচ) ডিগ্রি লাভ করেন।
শ্রদ্ধেয় অজিত কুমার আইচ হাস্যোজ্জ্বল মুখচ্ছবির এক প্রতীক। তিনি একাধারে শিক্ষক, প্রশিক্ষক, গবেষক শিক্ষানুরাগী, সাহিত্যপ্রেমী, সমাজকর্মী, সাংস্কৃতিক সংগঠক, লেখক ও সম্পাদক। বাংলা এবং ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে সমান পারদর্শী এই মহান ব্যক্তি দীর্ঘ ৫০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে উত্তর ভূর্ষি অন্নদা জীবন উচ্চ বিদ্যালয়, হাবিলাসদ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, মিউনিসিপাল মডেল হাই স্কুল, ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এন্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। গতানুগতিক নিয়ম অনুসারে পূর্বের স্কুলগুলো থেকে তিনি বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ঠিকই, কিন্তু কর্মস্পৃহা ও শিক্ষার নেশায় মত্ত হয়ে তিনি ২০১৩ সালের ২৯ শে জানুয়ারি বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলে যোগদান করেন। জীবনকে নিয়ম শৃঙ্খলার আবর্তে বেঁধে নবোদ্যমে শুরু করলেন শিক্ষাদান ও শিক্ষার লালন। জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষার পরীক্ষক ও নিরীক্ষক এবং কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের বাংলা ও ইংরেজি বিষয়ের পরীক্ষক এবং প্রধান পরীক্ষক হিসেবে ৫ বার দায়িত্ব পালন করেন। যদিও জীবনের শেষ দিন পর্যন্তও তিনি কর্মজীবন থেকে অবসর নেননি। কিন্তু বিধাতার অমোঘ নিয়মে পৃথিবী থেকেই অবসর নিতে হলো বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক অজিত কুমার আইচকে।
মহান শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ গভর্নিং বডি এবং অপর্ণাচরণ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি অগ্রণী মাধ্যমিক স্কুল, চন্দনপুরা, চট্টগ্রামের পরিচালক ছিলেন। শ্রদ্ধেয় অজিত স্যার ছিলেন চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য। তাছাড়া বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (চট্টগ্রাম জেলা ইউনিট), পটিয়া শিক্ষক সমিতি (চট্ট–সিটি), চাটগাঁ ভাষা পরিষদ, বাংলাদেশ হিন্দু ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ গীতা শিক্ষা কমিটি, সমাজ–সমীক্ষা সংঘ, বাঙলা শিক্ষক পর্ষদ, ইসকন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের আজীবন সদস্য ছিলেন। তিনি খেলাঘর, চট্টগ্রাম মহানগরী শাখার সহ সভাপতি, অবসর সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর উপদেষ্টা সদস্য, কসমোপলিটন ইউনেস্কো ক্লাবের সহ সভাপতি, মহিরা– ব্রজেশ্বরী প্রগতি সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, চট্টগ্রাম জেলা শিক্ষক সমবায় কল্যাণ সমিতির সদস্য, প্রথম আলো বন্ধু সভা এবং দ্য আরবান কো–অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড এর সদস্য ছিলেন।
তিনি ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির বেশ কয়েকটি বাংলা ও ইংরেজি পাঠ্যবই প্রণয়ন করেন। তার মধ্যে সহজ পদ্ধতির বাংলা ব্যাকরণ ও রচনা, ব্যবহারিক বাংলা ব্যাকরণ রচনা, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি নিজেকে প্রকাশ করতে চাইতেন না। তাঁর শিক্ষা, ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ দৈনিক পত্রিকা ও স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। তার ব্যক্তিগত লাইব্রেরি বিশাল এবং সমৃদ্ধ। গত কয়েক দশকের ম্যাগাজিন ও পত্রিকা সেখানে রয়েছে।
ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন তিন কন্যা ও এক পুত্রের জনক। নাতি, নাতনি, পুত্রবধূ, মেয়ে জামাই নিয়ে সুন্দর সংসারে তার পত্নী রত্না মজুমদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষিকা। জীবনকে সচল ও কর্মোদ্যমী রাখার এক দৃষ্টান্ত ও অনুপ্রেরণা আমাদের শ্রদ্ধেয় অজিত স্যার। যে বয়সে বার্ধক্যের নানা সমস্যা জর্জরিত মানুষ শুধু চিকিৎসক আর বিশ্রামের সুযোগ খোঁজে, সেই বয়সেই স্যার নতুনভাবে জীবনকে গ্রহণ করলেন। সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন বয়স একটা সংখ্যা মাত্র।
বাংলাদেশ এলিমেন্টারি স্কুলের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সকলেরই ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। এই বয়সের একজন কর্মক্ষম শিক্ষক তথা অভিভাবক পেয়ে প্রত্যেকেই খুশি ছিল। কখনো বয়সের কারণে একটু রাগ হলেও পরক্ষণে স্নেহের পরবসে বুঝিয়ে দিতেন। কখনোই প্রতিষ্ঠানে কাউকে তুই /তুমি সম্বোধন করতেন না। আয়া দারোয়ান থেকে শুরু করে সবাইকে ‘আপনি‘ বলেই সম্বোধন করতেন। শেষের দিকটায় ছাত্র–ছাত্রীদের খুব পড়াতে চাইতেন। ক্লাস অডিটে গেলে কিছু না কিছু শিক্ষামূলক উপদেশ দিতেন। এমনকি অনুপস্থিত শিক্ষকের ক্লাস নিতেও কার্পণ্য করতেন না। নিজের টেবিল, ফাইলপত্র নিজেই গুছিয়ে রাখতেন। বন্ধের আগেও শেষ কর্ম দিবস পালন করে গেছেন। নিজেও অসুস্থতার জন্য ছুটি নেননি কাউকেও তেমন ভোগাননি। সত্যি বলতে এমন মানুষ বর্তমান সমাজে বিরল। নীতির কাছে যেমন তিনি অটল তেমনি বয়সের কাছে অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু মৃত্যু অবধারিত। বিধাতার এই নিয়মের অন্যথা তিনি করেননি। অসাম্প্রদায়িক, উদারচেতা সর্বজন প্রিয় এই মহান শিক্ষক ৮ই জুন ২০২৫ চিকিৎসাধীন অবস্থায় এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কিন্তু হাজার হাজার শিক্ষার্থী, সহকর্মী, শিক্ষানুরাগী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও স্বজনের মনে নিজেকে অমলিন ও চিরস্থায়ী করে গেছেন।
লেখক: গল্পকার, শিক্ষক ও সংগীতশিল্পী।