কারিমা বেলুচ, পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী এক অদম্য সমাজকর্মী ও নারী নেত্রী, যার সাহসী উচ্চারণে বেলুচিস্তানে সামরিক নির্যাতন সহ সকল ধরনের অন্যায়, বৈষম্য বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করা হয়েছিল তাঁর মৃতদেহ ভেসে উঠে টরেন্টোর হারবারফ্রন্ট উপকূলে। চিরতরে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে তাঁর প্রতিবাদী স্বর।
বালোচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের প্রাক্তন চেয়ারপারসন কারিমা বেলুচের রাজনীতি শুরু হয় ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে। শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার বঞ্চিত বেলুচ নারীরা সাধারণত পশ্চাদপদ। সেখান থেকে বেরিয়ে এসে কারিমা বেলুচ রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন, সকল অন্যায় নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কন্ঠে সোচ্চার হয়েছেন, চেষ্টা করেছেন নারীদের তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে, সামনে এগিয়ে নিতে।
বেলুচিস্তানে পাকিস্তানি সামরিক অভিযান, সামরিক নির্যাতন, সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে এবং স্বাধীন বেলুচিস্তানের দাবিতে উচ্চকিত বেলুচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনের নেতৃত্ব দিয়েছেন কারিমা বেলুচ। ২০১৩ সালে পাকিস্তান সরকার বেলুচ স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশন জঙ্গী সংগঠন ঘোষণা দিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে কারিমা বেলুচকে গোপন আশ্রয়ে চলে যেতে হয়। বন্ধুর বাসায়, আত্মীয়ের বাসায় লুক্কায়িত জীবনে চলতে থাকে আন্দোলন। সবশেষে উপায় না পেয়ে, সংগঠনের পরামর্শে এবং অনেকের সহায়তায় ২০১৬ সালে পাড়ি দেন কানাডায়।
২০১৬ সালেই বিবিসির প্রভাবিত শতনারীর তালিকাভুক্ত হন কারিমা বেলুচ। কানাডায় বসে তিনি খনিজ সম্পদে ভরপুর বেলুচিস্তানের সম্পদ কীভাবে অন্য জায়গায় নিয়ে তাদের সাথে পাকিস্তান বৈষম্যের নীতি পালন করে তা তুলে ধরেন বিশ্ব-দরবারে। কোনরকম মিডিয়াকে ঢুকতে দেয়া হয় না বেলুচিস্তানে, সেখানে কী হয় জানে না বহির্বিশ্ব। ভীষণভাবে বঞ্চিত ও সামরিকবাহিনী দ্বারা নির্যাতিত বেলুচদের কাহিনী বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করতে থাকেন কারিমা বেলুচ।
সামরিকবাহিনী কর্তৃক নারীদের নির্যাতন, ধর্ষণ, যৌনদাসি বানানোর সংবাদ, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সামরিক জান্তা কর্তৃক নারী নির্যাতনের চিত্র কারিমা বেলুচ সাহসিকতার সাথে বিশ্বকে জানান। ২০১৯ সালে তিনি পাকিস্তানের ইমরান খান সরকার বেলুস্তানে যে নিপীড়ন চালিয়ে আসছে সে তথ্যও প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেন, বহির্জগত থেকে বালুচিস্তানকে বিচ্ছিন্ন রাখতে সেখানকার মানুষের শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, যথেচ্ছ হত্যাকাণ্ড চালানো হচ্ছে। সুইৎজারল্যান্ডে রাষ্ট্রপুঞ্জের অধিবেশনেও পাক নৃশংসতার বিরুদ্ধে সরব হন তিনি।
সংকটময় এক পরিস্থিতিতে কারিমা বেলুচ ছাত্র রাজনীতিতে যোগ দেন। সেখান থেকে বালুচিস্তান স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন আজাদের প্রথম নারী চেয়ারপার্সন এবং ক্রমান্বয়ে স্বাধীন বেলুচিস্তান আন্দোলনের এক অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনো জানা না গেলেও বিভিন্ন সংগঠন এটিকে পরিকল্পিত হত্যা বলেছেন। বিভিন্ন মাধ্যমে চলছে কারিমা বেলুচ মৃত্যুতে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ।
৩৫ বছরের কারিমা গত রবিবার দুপুর থেকে নিখোঁজ ছিলেন। পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে তাঁর খোঁজে তল্লাশি অভিযানে নামেন টরন্টো পুলিশ। সোমবার হারবারফ্রন্ট উপকূল থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। স্বামী হামাল হায়দর এবং এক ভাই কারিমাকে শনাক্ত করেন। কারিমার মৃত্যুতে ৪০ দিন শোকপালনের ঘোষণা করেছে স্বাধীন বালুচিস্তানের দাবিতে সরব হওয়া ‘বালোচ ন্যাশনাল মুভমেন্ট’।