আমার দাদা মরহুম দবির উদ্দিনের নাম অনেকে শুনেছেন। বিশেষ করে যাঁরা মহান ভাষা আন্দোলনের ঘটনাক্রম জেনেছেন তাঁরা অবশ্যই শুনে থাকবেন। কারণ তিনি মহান ভাষা আন্দালনের সাথে সক্রিয় ছিলেন। আপনারা জানেন, ১৯৫২ সালে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। এ কবিতা কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক এই প্রেস স্থাপন করেছিলেন। তখনকার সময়ে এইটিই চট্টগ্রামে আধুনিক ছাপাখানা। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার এর সম্মতিতেই কোহিনূর প্রেসে গোপনে চলে মাহবুব আলম চৌধুরীর কবিতা ছাপার কাজ। কোহিনূর প্রেসের তৎকালীন ম্যানেজার ছিলেন দবির উদ্দিন চৌধুরী। এই কবিতাটি ছাপানোর জন্য তাঁকে জেলে যেতে হয়েছিল। ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে বাঁচানোর জন্য তিনি সেই সময় বলেছিলেন, প্রেসের মালিক এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। সব দোষ আমার। পাক–সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ–র বিরুদ্ধে জারি করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। মামলা হলে গ্রেপ্তার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবির উদ্দিনকে। ছয় মাস জেল খাটার পর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে উনাকে জেল থেকে ছেড়ে দেয়া হয়।
আমার দাদা দবির উদ্দিনের এই অসীম সাহসিকতার জন্য ২০১৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ‘ভাষা সৈনিক’ হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন। আমার বাবা মহান মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় সংগঠক আবদুর রহমান চৌধুরী নিজের স্মৃতিচারণে সবসময় দাদার কৃতিত্বের কথা তুলে ধরেন।
আত্মত্যাগের অহংকারের সঙ্গে ভাষার গৌরব সুপ্রতিষ্ঠিত করার অনন্য দিন মহান একুশে। রক্ত–পলাশের ফাগুনের এমনই এক আগুন–ঝরা দিনে মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবিতে রাজপথ রাঙানোর সেই স্মৃতি, রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আজ। একইসাথে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতির জীবনে শোকাবহ, গৌরবোজ্জ্বল, অহংকারে মহিমান্বিত চিরভাস্বর দিন। আজ আমাদের কন্ঠে চির অম্লান সেই গান– ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি।’ ভাষার জন্য আত্মদানের গর্বে গর্বিত বাঙালি আজ পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে সেই সব উত্তরসূরিকে, যাঁদের বুকের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে, আত্নত্যাগে বলীয়ান হয়ে কেবল বাংলা ভাষায়ই নয়, বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সব ভাষাভাষীর ভাষার অধিকার।
লেখক : নারীনেত্রী ও সংগঠক