মা! এক অমিয় বুলি দিয়ে শুরু আমাদের মাতৃভাষার প্রতি প্রগাঢ় বন্দনা। মাকে পিছন থেকে ঝাপটে ধরে সেই ভাষাতে তার কাছে শত আবদার অনুযোগ, আর অনুরাগ। জননীর মুখে ভাষায় ভালোবাসার ফল্গুধারা আর মমতার স্পর্শে প্রতিটি সন্তানের হৃদয় হয় বরফ গলা নদী। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ঘুম পাড়ানি গান শুনে পার করেছি আমরা কত মিষ্টি শিশু বেলা। দুশো বছর ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন ও শোষণের পর, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পরবর্তী সময়ে পূর্ব বাংলার জনতা পুনরায় বঞ্চনার শিকার, নিপীড়ন অন্যায় ভাবে শোষিত হতে চায়নি। চেয়েছিল জনগণের কল্যাণের ভিত্তিতে সুশাসন। কিন্তু ১৯৪৮ এ এসে উর্দু হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। যা উস্কে দিয়েছিল জাতীয় অস্তিত্ব, অধিকার ও ভাগ্যের কঠিন প্রশ্ন। তাইতো গর্জে উঠে সোনার বাংলার দামাল ছেলেদের প্রতিবাদী বজ্র কন্ঠ। বাংলা ভাষার মর্যাদা রাষ্ট্র ভাষা দাবী নিয়ে ভাষা শহীদের রক্তে রাঙা হলো রাজপথ। মাতৃভাষা যে কোনো জাতির শিকড় ও জ্ঞান চর্চার সেরা মাধ্যম। এটি শুধু বলা, লেখা ও হিসাব নিকাশের জন্যে নয়। আবেগ অনুভূতিকে হৃদয়াঙ্গম করার জন্যে মহান ভাষা হলো মাতৃভাষা। অকপটে স্বীকার করতেই হবে।
৪৮ থেকে ৫২ সাল এক সুদীর্ঘ সংগ্রাম। ১৯৫২সালে ২১ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির আত্মজাগরণ ও রক্তিম বাঁক সূচিত হয়। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে ক্ষোভের আগুনের লেলিহান শিখা। এই চট্টগ্রাম শহরে প্রতিটি জনতা ও ছাত্রদের মনে ও জেগেছিল প্রতিশোধের আগুনের ফুলকি।
ঢাকায় গোলাগুলির পর বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারাদেশ। চট্টগ্রাম শহরের জেলা পর্যায়ে সব থানায় স্কুলও কলেজ হতে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। গ্রামের প্রতিটি স্কুলে কলেজে স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় আমার বাবা চট্রগ্রাম মিউনিসিপাল মডেল স্কুলের ছাত্র। ছাত্র হত্যা ও অন্যায় ভাবে গুলি করার প্রতিবাদে সেই মিউনিসিপাল মডেল স্কুলে একটি বিক্ষোভ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই ঐতিহাসিক সভাতে ছিলেন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, তোফতুন্নেছা আজিম ও আমার বাবা মরহুম এডভোকেট এস এম শামসুল ইসলাম। সভার পর প্রতিবাদী মিছিল বের করে।
বাবার হৃদয়ে ছিল স্বাধীনতা ও জন্মভূমির জন্যে শহীদ মাস্টারদা সূর্য সেনের দেশপ্রেমের দীক্ষা। মাতৃভাষার প্রতি এক আকুল প্রাণ। ১৯৭১ সালে পাক হায়েনা কর্তৃক নির্যাতিত নির্ভীক, দুঃসাহসী, সংগ্রামী পিতার চোখে মুখে দেখেছি ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এক দুর্নিবার শক্তি। সেই চেতনার দাবানল জ্বলছে আমার শিরা উপশিরায়। পারিবারিক শিক্ষা ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাঝে যোগসূত্র সৃষ্টি না হলে সুনাগরিক হওয়া সম্ভব নয়। তাই করতে আমাকে ভর্তি করেন অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার স্মৃতি বিজড়িত অপর্ণা চরণ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। সেই বিদ্যালয় এসে সুযোগ পেয়েছি আমি স্বদেশপ্রেমের আরাধনা।
আমি তখন ফ্রক পরা খুকী। ঠিক মনে নেই তখন কোন ক্লাসে। থ্রি কিংবা ফোর। সেদিন বাজে প্রায় রাত আটটা। বাবার প্রিয় ফুল চন্দ্র মল্লিকা ডালিয়া দিয়ে সাজানো ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত। ঘুণাক্ষরে টের পাইনি আমাকে প্রভাত ফেরীতে নিয়ে যাওয়ার আয়োজন চলছিল তাঁর মন জুড়ে। বললেন মা! খুব ভোরে শহীদ মিনার যাবো। যাবি? আমিও খুব উৎফুল্ল চিত্তে এক কথায় রাজী হয়ে গেলাম। এই খুশিতে সারা রাত ঘুম হয়নি। কত বার যে ঘুম থেকে উঠে পড়ি! যদি ফেলে চলে যায়! ফজরের আজান দিয়েছে বাবা ডাকলেন। নামাজের পর যাত্রা শুরু হলো জীবনের প্রথম প্রভাত ফেরীতে। ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা নিবেদন করতে ১৯৫৩ সাল হতে প্রভাত ফেরী শুরু হয়। অমর একুশের সেই বহমান ধারার অবিনাশী চেতনার সাক্ষী হতে চললাম। আকাশ তখন ও নিকষ কালো। আইস ফ্যাক্টরি রোড হয়ে নিউ মার্কেট আসতেই লোক জনের ভিড় সমাগম জীবনে প্রথম নজরে পড়ে। নগ্ন পায়ে ফুল হাতে বেশ লম্বা লাইন শুরু হয়ে গেছে। মাইকে একুশের গান বাজছে। তরুণ, যুবা কি বৃদ্ধ মনপ্রাণ খুলে অনেকেই গাইছিল কালজয়ী গান- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। চারদিকে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনতার ঢল। ব্যানার, ফেস্টুনে ভরে গেছে পুরো শহীদ মিনার এলাকা। আমিও খুব উৎসাহ নিয়ে প্রাণ খুলে গাইতে গাইতে শহীদ মিনার উপস্থিত হলাম। ধীরে ধীরে আকাশ ফর্সা হচ্ছে। সূর্যের আলোটা মাত্র দেখা দিলো। পুষ্প অর্পণ করার পর, একপাশে কিছুক্ষণ বাবার সাথে দাঁড়িয়ে রইলাম। সাধারণ জনতা পুষ্প অর্পণ করে চলে যাচ্ছে। বাবা বললেন, আজকে এই মুক্ত খোলা আকাশের নিচে বাংলা ভাষায় কথা বলছ সালাম রফিক জব্বারসহ আরো অনেক ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে। বাবার সাথে আমার শিশু মনটাও গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায় আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লো। ভাষায় প্রকাশ করতে পারবনা। মহান একুশের দাবী ছিল সর্বস্তরের বাংলা ভাষা চালু। আজকে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন হচ্ছে। বাঙালি জাতির জন্যে অনেক সম্মানের। কেউ বাংলা ভাষা ভালো জানেন। কিন্তু ইংরেজি ভাষা জানেন না বলে, তাকে অবজ্ঞা করি। দেখা যাচ্ছে সন্তানের মাতৃভাষার প্রতি অনাগ্রহ। শুদ্ধ উচ্চারণ করতে পারেনা। ওদিকে ইংরেজিতে অসাধারণ পাণ্ডিত্য তাই সাধুবাদ দেই। গর্বের শেষ নেই মা বাবার। আধুনিকতার নামে ভাষা কে অবজ্ঞা। না জানে শুদ্ধ বাংলাভাষা, না বুঝে আঞ্চলিক ভাষা। এই লজ্জা কোথায় রাখি? অনেক বলিদান ও রক্তক্ষয়ের বিনিময়ে যে ভাষা তার অবমূল্যায়ন সত্যিই দুঃখের। যদি এই হয় আগামী প্রজন্মের জন্যে হবে ভয়াবহ সমস্যা। মাতৃভাষা হলো জাতিসত্তার অংশ। তার প্রতি সম্মান বিলীন হলে পঙ্গু জাতিতে পরিণত হবে। সন্তানের মাঝে মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধা লালন করার দায়িত্ব আমাদের। শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাতে ও প্রচলিত শিক্ষা মাধ্যম গুলিতে বাংলা ভাষার শুদ্ধ চর্চার সুযোগ ও যথাযথ আগ্রহ সৃষ্টি করার প্রয়োজন। বাংলা ইংরেজি মিশ্রিত ভাষাকে অনুউৎসাহিত করবো। বিশ্বের উন্নত দেশ গুলি জাপান, জার্মানি, ফ্রান্স, চায়না মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও যত্নশীল। বাহান্নের একুশ পথ দেখিয়েছে ৬৬,৬৯, ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। অমর একুশ শুধু শোক প্রকাশ করে কালো ব্যাজ ধারণ ও শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অপর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মাতৃভাষার প্রতি মর্যাদা লালনের জন্যে এই একুশ। তারুণ্যের বিজয় প্রতীক। একুশ জাতীয় প্রেরণার মূল মন্ত্র। এক অফুরন্ত উজ্জীবনী শক্তি। তরুণ সমাজের হাত ধরে ৫১থেকে ৭১ নায্য দাবী আদায় ও স্বাধিকার আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
সকল ভাষা শহীদ, ভাষাসৈনিক, শব্দসৈনিক ১৯৫২সালে সারাদেশে আন্দোলনকারী ছাত্র ও জনতার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান জ্ঞাপন করছি।একুশের প্রথম ইতিহাস প্রসিদ্ধ কবিতা চট্টগ্রামের রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ঐতিহাসিক লাল দিঘির ময়দানে পাঠ করেন তাঁরই সতীর্থ রাজনীতিবিদ চৌধুরী হারুণ-উর-রশীদ। এটি চট্টগ্রামবাসীর জন্যে অত্যন্ত গৌরবের। আজকে আমি তাঁদেরকে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।
আমি ক্ষোভে ফুঁসে উঠা অকুতোভয় বিপ্লবীর এক গর্বিত সন্তান। আমার রক্তে বইছে সেই বায়ান্নে ভাই হারানোর হাহাকার। আমার ধমনীর সমগ্র অস্তিত্বে বইছে একাত্তরে পাক হায়েনার বুটের লাথি। আজ তাই স্বপ্ন দেখি, একদিন বিশ্ব দরবারে শীর্ষ সেরা ও জনপ্রিয় ভাষাতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা স্থান করে নেবে সম্মিলিত ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়।
লেখক : শিক্ষিকা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডিউ ড্রপস প্রিপারেটরী স্কুল,
পাস্ট প্রেসিডেন্ট, ইনার হুইল ক্লাব অব চিটাগাং