একুশে পদকে ভূষিত হয়ে চট্টগ্রামকে সম্মানিত করেছেন

ব্যতিক্রমধর্মী সাহসী আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক

ড. মইনুল ইসলাম | বুধবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদীতে আমার কলাম লেখা শুরু করেছিলাম ১৯৮২ সাল থেকে, তৎকালীন আজাদী সম্পাদক অধ্যাপক খালেদের সস্নেহ দাবির কাছে নতিস্বীকার করে। তখন আমি সহকারী অধ্যাপক ক্যাটেগরি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য। ঐ সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় সামরিক শাসন এবং সামরিক বাহিনীর প্রভূত ভর্তুকিপ্রাপ্ত রেশনের বিরুদ্ধে প্রকাশিত আমার একটি প্রবন্ধ সারা দেশে প্রবল আলোড়ন সুষ্টি করেছিল। ঐ প্রবন্ধ ছাপানোর অপরাধে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরকে প্রায় চাকুরিচ্যুত করার ব্যবস্থা করেছিল এরশাদ সরকার– এটুকু অনেকটাই জানাজানি হয়েছিল সাংবাদিক মহলে। খালেদ স্যারের সাথে মাঝেমাঝে বিভিন্ন সভা-সেমিনার-আন্দোলনের সুবাদে দেখা-সাক্ষাৎ হতো, যার মাধ্যমে আমার সাথে তাঁর শ্রদ্ধা ও স্নেহের সম্পর্কটা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছিল। এমন একটি পর্যায়ে একদিন তিনি সরাসরি আমাকে বলে বসলেন, ‘আপনি আজাদীতে লেখেন’। আমি তাঁকে নিরস্ত করতে চাইলাম এই বলে, ‘আপনি আমার লেখা নিয়ে বিপদে পড়বেন। কারণ, আমি সত্য কথা লিখতে দ্বিধা করি না’। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘আপনার লেখায় আমি বা আজাদীর কেউ কখনো হাত দেবে না’। এভাবেই শুরু করেছিলাম আজাদীতে গত চল্লিশ বছর ধরে আমার কলাম লেখা। খালেদ স্যার তাঁর কথা রেখেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। দৈনিক আজাদীতে আমার লেখা কলামে কখনোই সম্পাদকের কলম কাটাছেঁড়া করেনি খালেদ স্যারের সম্পাদনার মেয়াদে, যদিও ঢাকার জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো আমার লেখায় অনেক বেশি সম্পাদকের ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি, সরকারের ভয়ে আমার অনেক লেখা ঢাকার পত্রিকাগুলো ছাপানোর সাহসও পায় না।
খালেদ স্যারের মৃত্যুর পর মালেক ভাই সম্পাদক হয়েও একই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল আমার পরিবার ঢাকায় বসবাস করেছিল ছেলেমেয়ের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনে, যদিও আমি চট্টগ্রামেই থাকতাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরির সুবাদে। ঐ সময়টায় আজাদীতে আমার লেখালেখি কিছুটা অনিয়মিত হলেও বন্ধ হয়নি। আমি সশরীরে আজাদী অফিসে গিয়ে অরুণদার কাছে লেখা দিয়ে আসতাম। (তখনো ই-মেইলে লেখা পাঠানোর ব্যবস্থা চালু হয়নি। একেবারে অপারগ হলে কখনো কখনো ক্যুরিয়ার সার্ভিসের সহায়তা নিতে হত, কারণ আমার গাড়ী তখন ঢাকায় থাকত)। যখন অরুণদাকে কক্ষে পেতাম না, তখন সরাসরি মালেক ভাইকেও কয়েকবার লেখা দিয়ে আসতে হয়েছিল। এভাবেই শুরু হয়েছিল মালেক ভাইয়ের সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক। তাঁর অফিসে গেলে চা-বিস্কুট খেয়ে আসতেই হতো। ক্রমেই বিস্ময়ের সাথে আমি আবিষ্কার করলাম, তিনি অনায়াসে আমার বড় ভাইয়ের আসনে আসীন হয়ে গেছেন। ২০১১ সালে কিছুদিনের জন্য আমার নজরে পড়ল, কোন অজ্ঞাত কারণে আজাদীতে আমার লেখা মাঝেমাঝে ছাপা হচ্ছে না। হয়তো উপসম্পাদকীয় ছাপানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কারো বিরাগভাজন হওয়ায় এই অবহেলা! বিস্ময়াহত হয়ে আমি আজাদীতে লেখা পাঠানো বন্ধ করে দিলাম। এর কিছুদিন পর অরুণদা এক সভায় আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন এ-ব্যাপারে, আমিও খোলাখুলি আমার সন্দেহ এবং হতাশার কথা জানালাম। উনি বললেন, ‘মালেক সাহেব নিশ্চয়ই এটা জানেন না’। এর কিছুদিন পর অরুণদা বললেন, ‘আপনি আবার লিখতে শুরু করুন। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার কলামটা ‘ডঃ মইনুল ইসলামের কলাম’ নাম দিয়ে আজাদীতে পাক্ষিকভাবে ছাপা হবে’। অতএব, ২০১২ সাল থেকে এক দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে আমার কলাম নিয়মিতভাবে আজাদীতে প্রকাশিত হয়ে চলেছে। কিছুদিন পর রাশেদ রউফ উপসম্পাদকীয় সম্পাদনার দায়িত্বে আসল, ফলে ই-মেইলে সরাসরি তার কাছে এখন আমার লেখা পৌঁছে যাচ্ছে পনেরো দিন পরপর মঙ্গলবার, ‘ডঃ মইনুল ইসলামের কলাম’ পাক্ষিকভাবে ছাপা হচ্ছে মাসে নিয়মিতভাবে দু’বার, বৃহস্পতিবার। মালেক ভাই এই সুদীর্ঘ সময় ধরে তাঁর অঙ্গীকার বজায় রেখে চলেছেন। আমার লেখায় আজাদী সম্পাদকের কাটাছেঁড়ার হাত একেবারেই পড়ে না। অত্যন্ত ব্যতিক্রমধর্মী সাহসী ব্যক্তি না হলে মালেক ভাই এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে পারতেন না। কারণ, গত এক দশকে সরকারের সমালোচনামূলক বক্তব্য সংবলিত লেখার ব্যাপারে বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিদের অসহিষ্ণুতা দৃষ্টিকটুভাবে বেড়ে গেছে।
অথচ, ব্যক্তিজীবনে মালেক ভাই যেমনি মৃদুভাষী তেমনি অজাতশত্রু স্বভাবের। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। কাউকে আঘাত করার মতো কোন কথা তাঁর মুখ থেকে কখনোই নিঃসৃত হয় না। ব্যক্তিগত আলাপেও নেহাতই ভদ্রজনোচিত তাঁর আচার-আচরণ। চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতের অভিভাবকের আসনটা তাঁর পাকাপোক্ত হয়েছে। ক্রমেই তিনি চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জগতের মুরব্বীর আসনটাও দখল করে নিচ্ছেন। অনুপম স্যারের পাশাপাশি এখন মালেক ভাই চট্টগ্রামের সকল মহলের কাছে সভা-সেমিনারে পৌরহিত্য করার জন্য অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। চট্টগ্রামের নানা আন্দোলন-সংগ্রামেও আজাদী এখন নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে। উদাহরণ: চট্টগ্রামের সিটি হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধির অপপ্রয়াসের বিরুদ্ধে সফল আন্দালন এবং সিআরবি’তে প্রাইভেট হাসপাতাল নির্মাণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলন। নানা দাতব্য প্রতিষ্ঠানে মালেক ভাইয়ের দরাজ হস্তও ক্রমেই প্রসারিত হচ্ছে। এর পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশে মালেক-কামরুন দম্পতির ভ্রমণ কাহিনীর বর্ণনাও পাওয়া যাচ্ছে আজাদীর পাতায়। চট্টগ্রামের নানা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ডায়লগ-সভা-সেমিনারে মালেক ভাইয়ের অংশগ্রহণ এখন নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে। ২০১৮ সালে যখন আমাকে সরকার একুশে পদকে ভূষিত করলো, তখন আমাকে প্রদত্ত নাগরিক সংবর্ধনা সভায়ও সভাপতিত্ব করেছিলেন মালেক ভাই। ঐ সভায় প্রদত্ত তাঁর একটা বক্তব্য আমার মনে আজো গেঁথে রয়েছে,‘ডঃ মইনুল ইসলামের মত সরকারের সাহসী সমালোচনা করেও যদি একুশে পদক পাওয়া যায় তাহলে দালালির কী প্রয়োজন?’ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এসে যখন জানলাম মালেক ভাই একুশে পদকে ভূষিত হতে চলেছেন তখন এই কথাটা দিয়েই তাঁর কথাটা ফিরিয়ে দিতে চাই, ‘আজাদীতে ‘সেল্‌ফ সেন্সরশীপ’ চালু না করে সত্য কথাটা নির্ভয়ে বলার পরও যদি একুশে পদক পাওয়া যায় তাহলে সরকারের ভয়ে সম্পাদকদের কুঁকড়ে থাকার প্রয়োজন কী?’
মালেক ভাইকে একুশে পদকে ভূষিত করার মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের সাংবাদিকতা জগতের অকুতোভয় অভিভাবককে সম্মানিত করতে চলেছেন। সেজন্য মালেক ভাইকে অভিনন্দন, পাশাপাশি শেখ হাসিনাকেও অভিনন্দন।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধনেপথ্যচারী অভিভাবক প্রশান্তপাড়ের বাঙালির অভিনন্দন
পরবর্তী নিবন্ধমালেক ভাই ও দৈনিক আজাদী