একুশের ভাষা সৈনিক -উর্দুভাষী লেখক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান

কামরুল আনোয়ার চৌধুরী | বুধবার , ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:৩৪ পূর্বাহ্ণ

উর্দুভাষী লেখক ও গবেষক ড. সৈয়দ ইউসুফ হাসান আমাদের কাছে অপরিচিত, বর্তমানে বিস্মৃত একটি নাম। বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে উর্দুভাষী এই লেখকের ছিল গৌরবময় ভূমিকা। বাংলাদেশে (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) বসবাসকারী অন্যান্য উর্দুভাষী সম্প্রদায়ের মত পাকিস্তান সরকারের ভূমিকাকে সমর্থন না করে বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে ছিলেন এবং আন্দোলনে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বীরত্ব ও গৌরবের মহান সাক্ষী। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে তাঁকে যতটুকু সম্মান ও মর্যাদা দেবার দরকার ছিল আমরা তাঁকে তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি। তাই তিনি আমাদের কাছে অপরিচিত ও বিস্মৃত।
ড. ইউসুফ হাসানের জন্ম পাটনায়। তিনি আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষা সমাপ্ত করার পর ‘নয়া জমানা’ নামে একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে কাজে যোগ দেন। ১৯৫০ সালে তিনি পূর্ব বাংলায় (বাংলাদেশ) চলে আসতে মনস্থ করেন। এসে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন।
ইউসুফ হাসান পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক বিপ্লবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিজে একজন লেখক। তাই Writers Association নামে কবি লেখকদের একটি সংগঠন গড়ে তোলার জন্য সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন। এ সংগঠন প্রগতিশীল ও উঠতি কবি লেখকদের প্রেরণাদায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল । তিনি ছিলেন এ সংগঠনের জেনারেল সেক্রেটারী। শামীম ফুলওয়ারবী, খাজা মোহাম্মদ আলী, আরশাদ আফজলী, কমরুদ্দীন কমর, আরিফ হোসিয়ারপূরী, আনোয়ার হোসেন, আহসান আহমদ আসক প্রমুখ উর্দু কবি লেখকগণ Writers Association গড়ে তুলতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইউসুফ হাসান ‘রাফতার’ নামে একটি মাসিক ম্যাগাজিনের সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন। তাঁর সৃষ্টিশীল ও সাংগঠনিক কার্যাবলীর মাধ্যমে কবি জসীমউদ্দীন, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, শিল্পী জয়নুল আবেদীন ও লেখক শহীদুল্লা কায়সারের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যখন কেবলমাত্র উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নিচ্ছিল পূর্ব বাংলার বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিল। ইউসুফ হাসান তখন Writers Association পক্ষ থেকে পূর্ব পাকিস্তানবাসী (বাংলাদেশি)দের দাবি ন্যায্য ও গণতান্ত্রিক বলে পত্রিকায় মতামত প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন বাংলা ও উর্দু উভয় ভাষা রাষ্ট্রভাষা হওয়ার মর্যাদা রাখে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে পাকিস্তানের অপরাপর অংশ যেমন পশতু পাঞ্জাবী প্রভৃতি ভাষা রাষ্ট্রভাষা হবার জন্য মান ও যোগ্যতা রাখে। ইউসুফ হাসানের অভিমত পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর Pakistan Writers Association (পাকিস্তান কবি লেখক সংঘ) এর সেক্রেটারী জেনারেল আহমদ নাদিম কাশিমী জনাব হাসানের কাছে তাঁর মতামতের স্বপক্ষে ব্যাখ্যা দাবি করেন। ইউসুফ হাসান যথাযথ যুক্তি তর্ক সাপেক্ষে বুঝাতে সক্ষম হন যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা পূর্ব পাকিস্তান জনগণের নাগরিক ও গণতান্ত্রিক অধিকার। হাসানের যুক্তিতে সন্তুষ্ট হয়ে জনাব কাশেমী, ইউসুফ হাসানের অভিমত দেশব্যাপী বেতার মাধ্যমে প্রচার করেন।
ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির আমি একজন সদস্য ছিলাম। এ কমিটির মাধ্যমে একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়। প্রচারপত্রটি বাংলা ও উর্দু দুটি ভাষায় ছাপানো হয়েছিল। প্রচার পত্রের উর্দু ভাষায় লেখাটি ছিল আমারই লেখা। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর দিন সকাল বেলা ভাষা আন্দোলনের বিষয় নিয়ে আমি ড. শহীদুল্লাহর সাথে দেখা করলাম। এর পর আমি সভায় ও মিছিলে অংশ গ্রহণ করলাম। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ আহুত আমতলার সভায়ও আমি বক্তৃতা দিলাম। সভায় পরে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে যারা পুলিশী নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছিল তার মধ্যে ইউসুফ হাসানও ছিলেন। নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজের সামনে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিলে অংশগ্রহণ করায় পুলিশ তাঁেক গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। উর্দুভাষী সাব ডিভিশনাল অফিসার তাঁর প্রতি মহানুভূতিশীল ছিলেন বিধায় তিনি পরে ছাড়া পান। দীর্ঘ ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের পথ পরিক্রমায় অনেক বিশাল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন। ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু অংশ নেয়ার পর তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছিলেন। তিনি বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আতাউর রহমান, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদকে নিয়ে পূর্ব বাংলায় শান্তি কমিটি গঠন করেছিলেন। এতে আতাউর রহমান ছিলেন সভাপতি আর ইউসুফ হাসান ছিলেন জেনারেল সেক্রেটারী। ১৯৫৪ সালে চীনের রাজধানী পিকিং এ (বর্তমানে বেইজিং) এশিয় ও প্রশান্ত মাহসাগরীয় আঞ্চলের শান্তি সম্মেলন অনুুষ্ঠিত হয় । এতে পৃথিবীর ৩৭ টি রাষ্ট্র থেকে প্রতিনিধি ও পর্যবেক্ষক পাঠানো হয়। পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে ৩০ সদস্যের প্রতিনিধি পাঠানো হয়। তম্মধ্যে পশ্চিম (বাংলাদেশ) থেকে ৫ জন পাঠানো হয়। এ ৫ জন্য হলেন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, আতাউর রহমান খান, খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস, শেখ মুজিবুর রহমান ও ইউসুফ হাসান।
ইউসুফ হাসান সারা জীবন বামপন্থী রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। বামপন্থী রাজনীতির প্রতি অনুরাগের পথ ধরে তিনি একজন রিসার্চ স্কলার হিসেবে পিএইচডি করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্দু বিভাগের প্রধান ড. আন্দালিব সাদানীর তত্ত্বাবধানে Development in different Languages and under in Bengal গবেষণা চালাতে থাকেন। বেশ সমৃদ্ধ ও মানসম্পন্ন গবেষণা হলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নর মোনায়েম খান ইউসুফ হাসানের গবেষণার ফলাফল স্থগিত করে রাখে। ১৯৭১ সালে মোনায়েম খান যখন গভর্নরের পদ থেকে অপসারিত হন, ইউসুফ হাসান তাঁর থিসিস সমাপ্ত করেন। ইউসুফ হাসান তখন ডক্টরের ডিগ্রি অর্জন করেন। এ কথা জানালেন ড. ইউসুফ হাসানের পুত্র কাইফ হাসান।
ড. ইউসুফ হাসান বর্তমানে পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত । ঠিকমত কথাবার্তা বলতে তার একটু সমস্যা হয় কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি এখনো সজীব। ‘পুরানো দিনের কথা বলতে গেলে তিনি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠেন, স্মৃতি হাতড়ে কথা বলেন। অসুস্থতার সমস্যা তখন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।’ জানালেন তাঁর স্ত্রী নাছিম আরা।
ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে কি ঘটনা ঘটে ছিল তার স্মৃতিতে এখনো সজীব। নির্দ্বিধায় তিনি বলতে পারেন। ‘আমার বাবার জীবন কখনো বাধা বিঘ্নহীন ছিল না। পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কয়েকবার তাকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর প্রতি পাকিস্তান সরকারের রোষের প্রধান কারণ তিনি উর্দুভাষী হয়েও বাঙালিদের স্বার্থের পক্ষে কেন কথা বলেন।’ পিতার গর্বিত সন্তান জানালেন।
নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি বললেন ‘পাকিস্তান সরকারন আমাকে দুষ্কৃতিকারী, ভারতের চর আখ্যা দিয়েছে। দীর্ঘদিন আমার নাগরিকত্ব পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়েছে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান সরকার ভাষা আন্দোলন সমর্থন করার কারণে আমার পাসপোর্ট বাজেয়াপ্ত করেছিল। ১৯৫৮ সালে নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার বা ফিরে পাবার জন্য আমাকে ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়েছে।
তিনি জানান ‘আমি যেটা সঠিক বলে মনে হয়েছে তাই করেছি’। তার বর্ণিল রাজনৈতিক জীবনের মত বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিল ঐতিহাসিক। তাঁর ঐতিহাসিক ভূমিকা থাকা সত্ত্বে ও তিনি আমাদের দেশের মানুষের কাছে আজো অবহেলিত। রাজনীতিতে সক্রিয় থাকা এ ব্যক্তি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি অন্তরালে চলে যান। ঢাকা শহরের ঝঞ্ঝাটময় জীবন থেকে দূরে নিভৃত জীবন যাপন তিনি বেছে নিয়েছেন। কোন দ্বিধাদ্বন্দ্ব বাধাবিপত্তির পরোয়া না করে যা সঠিক তার পক্ষে কিভাবে দাঁড়ানো যায় তা তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা পাওয়া যায়। তাঁর জীবন সাহসিকতা ও সত্যবাদী আদর্শের জীবন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, অনুবাদক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমুক্তির অপেক্ষায় অপুর ছবি