একুশের গৌরবগাথা

মৃণালিনী চক্রবর্তী | সোমবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

৪৭ থেকে ৫২ পর্যন্ত বাঙালিদের জীবনে নানা মতানৈক্যের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের জন্ম হয়। এই মতানৈক্যে তিলে তিলে তীব্র হতে শুরু করে। তখন থেকে যখন বাঙালিকে মূল্যায়ন করতে ভুল করে পাকিস্তানিরা। ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়েছে বাঙালি বিজয় লাভও করেছে। তবুও শক্তিধরেরা শক্তির খেলা দেখাতে চেয়েছিল। তারা ইংরেজদের চেয়েও শক্তিমান বোঝাতে চেয়েছিল। হেরে যাবে ভাবেনি। বাঙালিরা আঞ্চলিকতায়, ধর্ম লোক রীতিতে, আলাদা বৈশিষ্ট্য হলেও তা নিজস্বতা।

ইংরেজরা শোষণের ক্ষেত্রে দখলদারিত্ব ও তাদের ভাষা বিশ্বময় স্থান করে নেওয়ার কৌশল নমুনা অঙ্কিত করেছিল। কিন্তু বাঙালির একান্ত ঔদার্যের শিল্পভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এদের গায়ে হাত পড়লে বাঙালি আর থেমে থাকে না। এটা বাঙালি বার বার বুঝিয়ে দিয়েছে। এটা বাঙালির একান্ত নিজস্ব অস্তিত্ব। তারা কৌশলে আঘাত করলেও। পাকিস্তানিরা সরাসরি আঘাত করেছে। ফলে বিরোধীতার প্রতিবাদের বীজ বপন শুরু হলো সেই থেকে।

ভাষার জন্য বিশ্বে একমাত্র বাঙালিরাই যুদ্ধ করেছিল। বাঙালির মুখের ভাষা তারা কেড়ে নিতে চায়। বাঙালি হারেনি তারা হারতে শিখেনি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির মুখের ভাষা ‘বাংলা ভাষা’ স্বাধীনতা অর্জন করে। শুধু বাঙালির ঘরে ঘরে নয় বিশ্বসমাজে বাংলা ভাষা ও বাঙালির পরিচয় অধিকার গৌরবময় স্থান করে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা নিজেদের ভাষা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রতিবাদ করে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে, গুলিতে রাজপথ তাজা রক্তে রঞ্জিত করে। এই ইতিহাস বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। সেই প্রতিশোধ প্রক্রিয়া থেকে জন্মএকাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির জীবনে প্রথম ভাষা স্বাধীনতার স্বাদ। এই একুশ একটি দেশের মানচিত্র, একটি সবুজ বিস্তীর্ণ মাঠের রক্তাক্তের নকশা তথ্য। এই একুশকে ঘিরেই একুশের বইমেলা, একুশের গান একুশের মঞ্চ একুশের কবিতা একুশের নাটক একুশের আলোচনা একুশের প্রভাত ফেরী একুশের পদক আরও কতো নামক অনুষ্ঠান আয়োজন হয়। একুশ সাহিত্যেরইতিহাসের প্রতিবাদজাগরণের দুঃখ প্রেম ও ভালোবাসার স্বচ্ছ পথ উন্মোচিত করেছে। প্রথম চট্টগ্রামে রচিত হয়েছে ভাষা আন্দোলনের একুশের শ্রেষ্ঠ কবিতা আজাদীর ঐতিহাসিক কোহিনুর প্রেস থেকে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর শব্দবুনন তত্ত্ব তথ্য আবৃত্তি রস সম্বলিত ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। একশত বিশ লাইনের বিখ্যাত কবিতা। তারপর বাংলাদেশের সকল কবি লেখকরা তাদের ভাব আবেগের প্রস্রবনে এই পথে পদার্পণ করেছেন এবং কষ্টের অর্জনের ভালোবাসার ফল্গুধারায় বিচরণ করেছেন। লিখেছেন আরো কত কবিতা এই পথের চলা আজীবন অনন্তকালের একুশ। শুধু তাই নয় প্রবন্ধ,গল্প,নাটক, কাব্যগাথায়, ছড়া কবিতা গানে, কথামালায় একুশ একটি গভীর বিস্তীর্ণ সাহিত্যের পাঠচক্রের পাহাড় সৃষ্টি করেছে। এর যাত্রা অনন্তকাল। একুশ যেমন গর্বের তেমনি সৃষ্টির প্রখরতার আলো। পুরো ফেব্রুয়ারি মাসটা ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদ প্রতিশোধ জাগরণের বিজয়ের মহিমান্বিত গুণগানে স্বদেশ প্রেমের উজ্জীবনে কথা কবিতা গানে নৃত্যে নাটকে বাংলার আনাচে কানাচে মাঠে ময়দানে গ্রামে গঞ্জে মঞ্চ সজ্জিত হয়।

এই উচ্চারণ শুধু বাংলাদেশ নয় পশ্চিমবঙ্গ ও পৃথিবীর সর্বত্র যেখানে বাঙালিরা আছে। এই দিকটাও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের একটি শ্রেষ্ঠ দিক। শুধু একুশ নিয়ে লেখা নিত্যনতুন পদচারণায় স্মৃতিচারণ। একুশের সাহিত্য বাংলা ও বাঙালিদের জীবনে নতুন সমৃদ্ধ সংযোজন।

তেমনি একুশ পালনেও বাঙালি সংস্কৃতিতে জাগরণের জোয়ার বইছে। সকল বয়েসীদের মিলন ক্ষেত্র তৈরি হয় একুশ মেলা একুশের বইমেলা। তাছাড়া গীতিকার সুরকার ও শিল্পীর সমন্বয়ে কত গান সৃষ্টি হয়েছে হচ্ছে। এই সুর ও সাহিত্যের ধারাটিও বাংলায় অপূর্বভাবে সমৃদ্ধ। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি কালজয়ী বিখ্যাত গান রচনা। যা ফেব্রুয়ারি মাসের জন্য বাঙালির মুখ্য একুশের গান হয়ে উঠেছে। তাছাড়া আরও কতো রচিত হয়েছে একুশ স্মরণে শহীদদের শ্রদ্ধায় লেখকদের নিঃসৃত ভাবগম্ভীর রচনা। যেমন ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘তারা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’, ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা।

এরকম কতো বিখ্যাত গান রচিত হয়েছে প্রেরণায় উদ্দীপনায় বাঙালি সমৃদ্ধ হয়েছে, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ হয়েছে, সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে, বাঙালি সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছেছে। এই একুশকে ঘিরে দেশাত্মবোধক ও প্রতিবাদী, জাগরণের, লোকগীতির, জারি গানের সমাহারও কম নয়। তেমনি জীবন্তিকা নাটকের স্বাচ্ছন্দ্য রূপরেখা ও অনেক।

তাই একুশলেখকদের মধ্যে একটি ধারা ভাব উৎস উম্মোচন করে বাংলা সাহিত্যের দিগন্ত বিস্তৃত করেছে।

চট্টগ্রামের প্রবীণ নবীন লেখকরা কেউ স্বদেশের ক্ষতবিক্ষত দুঃখ কষ্ট দেখে শুনে হাত তুলে রাখতে পারেন নি লেখনীর মধ্য দিয়ে ভাব ভাষা ব্যক্ত করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ভাষা আন্দোলনের শেষ একুশে ফেব্রুয়ারি। এই পুরো পাটাতনের লেখাগুলো একান্ত ‘একুশের ই সাহিত্য’ বলে আমার মনে হয়। তাই সম্বোধনই করলাম। এই মাসেই এই সাহিত্য চর্চার বড় আলোড়ন পড়ে। হয় একুশের বইমেলা, একুশের মঞ্চ সেখানে আলোচনায় গানে কবিতায় একুশের বিজয়গাথা গৌরব সৌরভ ছড়িয়ে যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীত শিল্পী; প্রাক্তন অধ্যাপক, লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধইসলামে ভাষা শহীদদের মর্যাদা ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা
পরবর্তী নিবন্ধতুরস্ক-সিরিয়ায় ৩ কোটি ডলার দিলেন বেনামী পাকিস্তানি