পূর্ব পাকিস্তানে আল্লাহ
ঢাকা এবং অন্যান্য শহরাঞ্চলের পুরোপুরি দখল নেয়ার পর পাকিস্তানী সেনাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়া হয়। উদ্দেশ্য, ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে গোটা পূর্ব পাকিস্তানকে কাফের মুক্ত করা। আমার গ্রামের বাড়িটি নতুনপাড়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে পূর্বদিকে। ক্যান্টনমেন্ট এবং স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র খ্যাত কালুরঘাট এলাকার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে। পাকসেনারা মাঝেমাঝেই চলে আসত এদিকে। একেকদিন একেক গ্রামে তাদের হানা দেয়ার খবর পাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ত। কিশোর যুবকরা প্রায় বাড়ি ছাড়া হয়ে দিনের বেলায় আত্মগোপনে থাকত। দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের কেউ পালাতে ভুল করলে চরমমূল্যও দিতে হত।
আমার চাচাদের দুই সন্তান পিঠাপিঠি। বড়জন তখন সফল ছাত্রজীবন শেষে ডাক্তার হয়ে প্র্যাকটিস করে। ছোটজনও মাধ্যমিক পাস দিয়ে বাড়িতে আছে। দিনের বেলা সবাই পালালেও এরা দুজন একটু সাহস করে প্রায় ঘরে থাকত। কোন কোন দিন গ্রামের কোন জায়গা থেকে অসুস্থ মানুষরা এসে সেবাও নিত। আর সকলে ভাবতো ডাক্তার মানুষ এদের তেমন ভয় নেই। তাছাড়া গ্রামে আমাদের বাড়িটির বেশ একটু গোছালো পরিবেশ। সামনে বিরাট দিঘি, উত্তর-দক্ষিণ লম্বালম্বি প্রায় গোটা বাড়িটা জুড়ে বিস্তৃত। সামনের দিক থেকে কেউ এলে প্রথমে বাড়ির বৈঠকখানা, সামনে বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণ। এটি পার হয়ে আবার ভেতরের উঠোন। সেটা পার হয়ে মূল থাকার ঘর। এর পেছনে সবার নিজ নিজ উঠোন সংলগ্ন পাক ঘর। মোটের উপর আগন্তুকদের জন্য এ বাড়ি গ্রামের অন্য বাড়ি থেকে বিশিষ্ট। ক্যান্টনমেন্ট এবং কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের কাছে হওয়ায় আমাদের গ্রাম সৈনিকদের নিয়মিত টহলের আওতার মধ্যে ছিল। তারা সাধারণত আমাদের বাড়ি এড়িয়ে চলাফেরা করত। এরমধ্যে একদিন একদল সেনা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। বাড়িতে বড় পুরুষ মানুষরা প্রায়ই নিকটবর্তী একটা মাদ্রাসাকেন্দ্রে দিন কাটাত। দিনের বেলায় বের প্রায় হতই না।
এদিন আমার দুই চাচাত ভাই’ই শুধু বাড়িতে। অন্যঘরেও পুরুষ বলতে কেউ ছিলনা। এরা দু’ভাই ঘরের উঠোনে থাকাতে সেনাদল তাদের দেখে ফেলে। তাই তারা আর লুকাতে চেষ্টা করেনি। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রথম দিকে সবার মধ্যে যুদ্ধ আসবে যুদ্ধ আসবে এরকম একটা ভাব ছিল। আমাদের বাড়িতে অনেক গ্রামের মত একটা পরিখা কাটা হয়েছিল। সেটি তখনও ভরাট করা হয়নি। সেনারা সেটা দেখে ফেলে এবং আমার চাচাত ভাইদের সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে। তারা আমতা আমতা করে কিছু বলতে গেলে কোমরের বেল্ট খুলে তাদের মারতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে তারা আল্লাহর কসম খোদার কসম ইত্যাকার কীরা কেটে অনুকম্পা ভিক্ষা করে। তাতে এদের মধ্যে একটু ভদ্রগোছের একজনের কৌতূহল হয়। সে সবাইকে শান্ত হতে বলে। এরমধ্যে আমার ভাইয়েরা আরও স্পষ্ট শব্দে ‘আল্লাহ বাঁচাও, আল্লাহ বাঁচাও’ আর্তরব তুলে। সিপাহীরা প্রায় সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে, তোমরা আল্লাহ বাঁচাও কখন শিখলে, কোথা থেকে শিখলে? তখন ভাইদের বড় জন বলে উঠে আমরা মুসলমান, আল্লাহ! আমাদের আল্লাহ! সেনারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তাদের সবার বিশ্বাস হয়নি। কালিমা পড়ার আদেশ দিয়ে তা আদায় করে নিয়ে মোটামুটি আশ্বস্ত হয় যে এটা মুসলমান বাড়ি। তখন তারা যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টো দিকে বের হয়ে যাবার জন্য রাস্তা দেখিয়ে দিতে বলে। বাসঘর, পাকঘর ইত্যাদি পার হয়ে ওরা পশ্চিম দিক দিয়ে বের হবার পথ পেল। তারপরও কয়েকটি ঘর তল্লাশি করে তারপর গেল।
এদিকে আর্মি আসছে শুনে বাড়ির মহিলারা পাকঘরে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। এদিন প্রায় একই সময়ে আর্মির আরও একটা ছোট দল আবারও একই পথে আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। আগের দলটির মতো তারাও পরিখার অস্তিত্ব দেখে পরস্পর বলাবলি শুরু করে ‘ইঁহা মুক্তি’ ট্রেঞ্চ বানিয়েছে। একটু দূরে আমার ভাই দুটিকে দেখে তাদের কাছে আসার নির্দেশ দেয়। ওরা ততক্ষণে আগের মারের ধকল কাটিয়ে উঠেছে। নতুনভাবে বিপদ আসতে পারে ভাবেনি। কাছে এলে জওয়ানরা তাদের বলল, এই পরিখা কেটেছ তোমরা। এখন এর পাড়ে দাঁড়াও। এখানেই তোমাদের কবর বানাবো। অশ্রাব্য নানা গালি দিতে দিতে তাদের দু’জনকে ট্রেঞ্চের পাড়ে দাঁড় করাল। দুইজন জওয়ান বন্দুকে গুলি ভরে ট্রিগার ঠিক করে নিল।
এদিকে পাকঘর থেকে আমার চাচি এবং অন্যান্য মহিলারা অবস্থা দেখে আর ঠিক থাকতে পারেনি। তারা সবাই সমস্বরে ‘ও আল্লারে, আল্লাহরে, আঁরার পুতরে মারি ফেলার’। নিজেদের ইজ্জত-আব্রুর কথাও তাদের মনে আসেনি। আল্লাহরে, আল্লাহরে বলে আর্তনাদ করতে করতে তারা একেবারে ট্রেঞ্চের কাছে চলে এসেছে। নিজেদের কাপড়চোপড় গুছাবার কথাও তখন তারা ভাবেনি। এক জওয়ান অন্যদের বলে উঠল, রুকো, এ তো ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ বলছে! ব্যাপারটা কি? ভয়ে মহিলাদের আল্লাহ ডাকা বেড়ে গেছে। সমস্ত ব্যাপারটায় জওয়ানরা হকচকিয়ে গেল। এখানে তো হিন্দুই থাকার কথা, ‘ওহ্ত সাব কাফির হ্যয়। ইঁহা আল্লাহ কাঁহা সে আয়া?’ এখানে আল্লাহ কোথা থেকে এল এটা তাদের বোধগম্য হচ্ছে না। কারণ, তারা তো জেনে এসেছে এখানে সব বিধর্মী থাকেন! কিন্তু, আল্লাহ কোথা থেকে এল? এমন বিশুদ্ধ উচ্চারণে মেয়েরা এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে ছোটরা আল্লাহ ডাকতে জানে কি করে। তবে কি এটা মুসলমান পাড়া?
আবার একই পরীক্ষা। ‘কালেমা বাতাও’ সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে যাওয়ার আশায় আমার ভাইয়েরা প্রায় সমস্বরে কালেমা পড়তে শুরু করেছে। জওয়ানরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। বন্দুক সরিয়ে নিয়ে এরকম সেইম সাইডের অবস্থার যেন অপ্রস্তুত হয়ে গেল।
বিমূঢ় বিস্ময়ে তারা দেখল পূর্ব পাকিস্তানে আল্লাহ আছেন! যারা তাদের শিখিয়েছে এখানে আল্লাহ নাই, আল্লাহ তাদের কি শাস্তি দিবেন সেটা তিনিই নির্ধারণ করবেন। কিন্তু, মুক্তিকামী বাঙালিরা নিজ মাতৃভূমিকে এদের করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার না করে থামেনি।
লেখক : শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ












