চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) গৃহীত একাধিক প্রকল্পের অনুমোদনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নিরসনে উদ্যোগ নিতে এক সপ্তাহ ধরে ঢাকায় অবস্থান করছেন নগরপিতা। এজন্য তিনি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিবের সঙ্গে বৈঠক করে তাদের প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বিপরীতে মেয়রকেও আশ্বস্ত করেছেন তারা। দিয়েছেন প্রতিশ্রুতিও। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বন্দরের ভারী যানের প্রভাবে নগরের নষ্ট সড়ক সংস্কার, বে টার্মিনালের সীমানা দেয়াল ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে স্লুইসগেটের মুখ বন্ধ করা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা, গৃহকর খাতে বন্দরের কাছে চসিকের পাওনা, পরিত্যক্ত জায়গায় চসিকের উদ্যোগে পার্ক নির্মাণ ও খেলার মাঠ তৈরি, বিমানবন্দর সড়ক সম্প্রসারণ প্রকল্পসহ চসিকের অন্যান্য প্রকল্প নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মেয়রের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, গত ১৬ অক্টোবর শনিবার ঢাকা পৌঁছান নগরপিতা রেজাউল করিম চৌধুরী। গতকাল পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করেন তিনি। আজ শনিবারও নগরে ফেরার সম্ভাবনা নেই। ঢাকায় অবস্থানকালে মেয়র স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেন। কথা বলেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানের সঙ্গে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গেও বৈঠক করেন নগরপিতা।
যেসব বিষয়ে আলোচনা : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে নৌ-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। বার বার সংস্কারের পরও চট্টগ্রাম বন্দরের কন্টেনারবাহী ভারী যানবাহনের চাপে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক নষ্ট হওয়ার বিষয় নৌ-প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আনেন মেয়র। তখন মন্ত্রী বন্দরের ভারী যানবাহন চলাচল করে এমন সড়কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলে চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে সংস্কার করে দেয়ার আশ্বাস দেন। এ জন্য যেসব সড়ক দিয়ে বন্দরের ভারী যানবাহন চলাচল করে তার তালিকা দিতে বলেন মেয়রকে। চট্টগ্রামে ফিরে আনুষ্ঠানিকভাবে তালিকা পাঠানো হবে বলেও জানান মেয়র।
এছাড়া নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রীকে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিত্যক্ত জায়গায় চসিকের পক্ষে পার্ক এবং খেলার মাঠ করে দেয়ার প্রস্তাব দেন মেয়র। এতে সম্মতি দিয়ে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিতে বলেন। চট্টগ্রাম বন্দরের কাছে গৃহকর বাবদ ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরের প্রথম কোয়ার্টার থেকে পরবর্তী করপুর্নমূল্যায়ন পর্যন্ত ৪২ কোটি টাকা বকেয়া পৌরকর পাবে চসিক। যা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রীর হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করলে মেয়রকে বন্দরের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন।
আলোচিত বে টার্মিনালের সীমানা দেয়াল ও রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে আউটার রিং রোড সংলগ্ন পাঁচটি স্লুইসগেটের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এতে ৩৬ ও ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের পানি নিষ্কাশনে সমস্যা হচ্ছে। এ বিষয়ে নৌ-প্রতিমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চাইলে সমাধানের আশ্বাস দেন মেয়রকে।
এদিকে একনেকে যাওয়ার অপেক্ষায় আছে ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতায় এয়ারপোর্ট রোডসহ বিভিন্ন সড়কসমূহ উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ শীর্ষক দুই হাজার ৪৯৯ কোটি ৯ লাখ ২৪ হাজার টাকার একটি প্রকল্প। বারইপাড়া নতুন খাল খনন প্রকল্পের সংশোধিত ডিপিপিও মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে কিছুদিনের মধ্যে। যান্ত্রিক শাখার ৪০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও কিছুদিন আগে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে
চসিক। আছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পও। এসব প্রকল্প নিয়েও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, পরিকল্পনা মন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবগণের সাথে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
মেয়রের একান্ত সচিব (সিনিয়র সহকারী সচিব) আবুল হাশেম বিষয়গুলো নিশ্চিত করে দৈনিক আজাদীকে বলেন, বন্দরের বকেয়া পৌরকর নিয়ে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে। মন্ত্রী বন্দরের সাথে আলাপ করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। বন্দরের কিছু পরিত্যক্ত জায়গায় জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত পার্ক হিসেবে ব্যবহার করা বা খালি মাঠ ডেভেলাপ করার প্রস্তাব দিয়েছেন মেয়র মহোদয়। তখন মন্ত্রী জায়গা চিহ্নিত করে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিতে বলেছেন। মন্ত্রী মহোদায় এটা বলেছেন, বন্দর থেকে প্রচুর গাড়ি বের হয়। গাড়িগুলো যেসব সড়ক দিয়ে যায় তার তালিকা দিলে বন্দর থেকে সংস্কার করে দেয়া হবে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং ইতোমধ্যে পাঠানো প্রকল্প নিয়ে কথা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চসিকের একাধিক কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে জানান, যে কোনো প্রকল্পের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও তদবির করতে হয়। সাধারণত চসিকের কর্মকর্তারা এ যোগাযোগ রক্ষা করেন। সেক্ষেত্রে অনেক সময় কাক্ষিত রেজাল্ট পাওয়া যায় না। তাই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে মেয়র যদি সরাসরি মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে কথা বলেন তাহলে অনেক জটিলতা দূর হয়ে যায়। সিটি মেয়রের উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং কর্পোরেশনের জন্যই তা ভাল হবে।
মেয়র যা বললেন : সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী দৈনিক আজাদীকে বলেন, সবার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীর সঙ্গে চট্টগ্রামের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কীনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, তিনি চট্টগ্রামের বিষয়ে খুব আন্তরিক। আমাদের নানা কর্মকাণ্ড এবং প্রকল্প নিয়ে কথা হয়েছে। মন্ত্রী নিজেই বলেছেন, ‘পোর্ট কানেকটিং রোড, মাঝিরঘাট রোড, মহেশখালে দ্রুততার সাথে কাজ চলছে’। তখন আমি জানিয়েছি, বৃষ্টির জন্য একটু সমস্যা হচ্ছে। বৃষ্টিতে কার্পেটিং কাজ করা যায় না।
পরিকল্পনা মন্ত্রীর সঙ্গে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ওনার সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছি। নানা বিষয়ে কথাবার্তা হয়েছে। ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প আমরা জমা দিয়েছি সেগুলো বাই প্রসেস অনুমোদন হবে, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে মেয়র বলেন, বন্দরে বড় বড় গাড়ি শহরের রাস্তা নষ্ট করছে। সিটি কর্পোরেশনের উপর চাপ আসছে। এসব নিয়ে আলোচনা করেছি।
বন্দরের উন্মুক্ত স্থানে চসিকের উদ্যোগে সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বলেন, আমি বলেছি, প্রতিটি ওয়ার্ডে কোনো খেলার মাঠ নাই। যেখানে ছেলে-মেয়েরা খেলতে পারে। কোনো উন্মুক্ত স্থান নেই, যেখানে লোকজন এসে একটু হাঁটবেন বা বিশ্রাম নিবেন। অনেক জায়গায় থাকলেও দখল হয়ে গেছে। এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে কি হবে? তাই বন্দরের মালিকানাধীন খালি জায়গা আমাদের দিলে আমরা মাঠ ও পার্ক করে দিব। তখন মন্ত্রী বলেছেন, এটা ভালো চিন্তা। প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিলে সহযোগিতা করব।
মেয়র বলেন, শুধু বন্দর নয়, রেলওয়েকে-ও প্রস্তাব দিয়েছি। আমি বলেছি, তাদের মালিকানাধীন কিছু খালি মাঠ আছে এবং কিছু অবৈধভাবে দখল করে ভূমিদস্যুরা ভোগ করছে। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে সেগুলো যেন আমাদের দেয়া হয়। দিলে আমরা সৌন্দর্যবর্ধন প্রকল্প বাস্তবায়ন করব। সেখানে পার্ক করে দিব, যাতে লোকজন সেখানে হাঁটতে পারেন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারেন। মাঠ করে দিব যাতে ছেলে-মেয়েরা খেলতে পারে। এমনিতেও তো শহরে উন্মুক্ত মাঠের সংকট আছে।
মেয়র বলেন, আমার প্রস্তাবে সবাই একমত হয়েছেন। আমরা বলেছি, খালি জায়গা সিটি কর্পোরেশনকে একেবারে দিয়ে ফেলার দরকার নাই। যাদের জায়গা তাদেরই থাকবে। আমরা শুধু কাজ করে দিব। আমার উদ্দেশ্য, আমরা প্রস্তুত করে দিলেও নগরবাসীই এর সুফল ভোগ করবেন।
এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, জোড় ডেবা নিয়ে প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে বন্দর বলেছে তাদের কোনো আপত্তি নাই। জোড় ডোবায় রেলওয়েরও জায়গা আছে। তাদের সাথেও কথা হচ্ছে।












