মো. ওসমান গণি, বর্তমানে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সহকারী কলেজ পরিদর্শক। শুরুতে দৈনিক ভিত্তিতে অফিস সহকারী হিসেবে শিক্ষাবোর্ডে কাজ শুরু করেন তিনি। পরে নিয়োগ পান সেকশান অফিসার পদে। সেকশান অফিসার পদে তার এই নিয়োগটাই জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে বলে বোর্ডের তদন্তে উঠে আসে।
নিয়োগ পেতে কক্সবাজার পৌরসভার একটি অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়েছিলেন তিনি। যা পরবর্তীতে বোর্ডের তদন্তে ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়। এখানেই শেষ নয়, অভিযোগ রয়েছে এরপরও একের পর এক জালিয়াতির ঘটনা ঘটিয়ে চলেছেন ওসমান গণি। চেক জালিয়াতির পাশাপাশি বাদ যায়নি মহামান্য হাইকোর্টের রিট জালিয়াতিও। তদন্তে সেসব জালিয়াতির প্রমাণও মিলেছে। এসব ঘটনায় বোর্ড কর্তৃপক্ষ তাকে দুইবার সাময়িক বরখাস্ত করে। লঘু শাস্তিও পেয়েছেন একটির ঘটনায়।
সর্বশেষ নিয়োগকালীন তার দেয়া কক্সবাজার পৌরসভার ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদটি ‘সঠিক’ প্রমাণে আবারো জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। ওসমান গণির স্বপক্ষে ১৯৯৫ সালে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান নুরুল আবছার স্বাক্ষরিত অভিজ্ঞতা সনদটি ‘সঠিক’ মর্মে এক দফায় প্রত্যয়ন দেন কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমান। মেয়র কর্তৃক গত ২০ অক্টোবর (২০২০ সালের) স্বাক্ষরিত এ প্রত্যয়নটি হাইকোর্ট বিভাগের সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো হয়। তবে এর ১৩ দিনের মাথায় (৩ নভেম্বর) ‘সঠিক’ হিসেবে দেয়া প্রত্যয়নটি অনিচ্ছাকৃত ভুলবশতঃ দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে তা পুনরায় বাতিল করেছেন মেয়র মুজিবুর রহমান। বাতিল সংক্রান্ত চিঠিটিও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবর পাঠানো হয়েছে। দুটি চিঠিরই অনুলিপি দেয়া হয়েছে শিক্ষাবোর্ডে। ওসমান গণি পৌরসভায় কর্মরত ছিলেন মর্মে এক দফায় প্রত্যয়ন দিয়ে পুনরায় তা বাতিল করে চিঠি দেয়ার বিষয়ে জানতে কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমানের মুঠোফোনে বেশ কয়দিন ধরে চেষ্টা চালানো হয়। মুঠোফোন নম্বরে সংযোগ না পাওয়ায় মেয়র মুজিবুর রহমানের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদে ওসমান গণির নিয়োগের বিষয়টি পুনরায় তদন্ত ও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। বিষয়টি তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক)। হাইকোর্টের নির্দেশনা ও দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পুনরায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। বোর্ডের সচিব প্রফেসর আব্দুল আলীম এ কমিটির আহ্বায়ক। আর সদস্য হিসেবে আছেন বোর্ডের উপ-বিদ্যালয় পরিদর্শক মো. আবুল বাসার ও সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (বর্তমানে সহকারী কর্মকর্তা) আবুল কাশেম মো. ফজলুল হক। তবে ১০ মাসেও কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। ফলে হাইকোর্ট ও দুদুকের নির্দেশনার প্রায় এক বছরেও ওসমান গণির বিরুদ্ধে কোনো ধরণের ব্যবস্থা নিতে পারেনি বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান ও শিক্ষাবোর্ডের সচিব প্রফেসর আব্দুল আলীমের দাবি- প্রতিবেদন প্রস্তুতের কাজ শেষ পর্যায়ে। কমিটির এক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় প্রতিবেদনটি তাঁরা জমা দিতে পারেন নি। কয়েকদিনের মধ্যেই এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া সম্ভব হবে বলেও জানান তিনি।
অভিজ্ঞতা সনদে যা আছে : সেকশান অফিসার পদে নিয়োগ পেতে ১৯৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর ইস্যু করা কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান নুরুল আবছার স্বাক্ষরিত একটি অভিজ্ঞতা সনদ জমা দেন ওসমান গণি। ওই সনদে ১৯৯১ সালের ১ নভেম্বর থেকে ১৯৯৫ সালের ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত ওসমান গণি অফিস সহকারী হিসেবে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে কক্সবাজার পৌরসভায় কর্মরত ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়। তবে তার শিক্ষা সনদের তথ্য উল্লেখ করে দুদকে প্রদত্ত অভিযোগে বলা হয়েছে- ওসমান গণি যে সময়ে কক্সবাজার পৌরসভায় দৈনিক মজুরি ভিত্তিক কর্মরত ছিলেন মর্মে দেখানো হয়েছে, ওই সময়ে তিনি চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি (ব্যাচেলর অব সায়েন্স) অধ্যয়নরত ছিলেন। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল-জুন মাসে অনুষ্ঠিত বিএসসি পরীক্ষায় (১৯৯২ সালের পরীক্ষা) অংশ নিয়ে তৃতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ‘চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি অধ্যয়নরত থাকাকালীন একজন ছাত্র একই সময়ে কক্সবাজারে অফিস সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন!’ এটি কোনোভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয় এবং বিষয়টি জালিয়াতি হিসেবে স্পষ্ট প্রতীয়মান বলে দাবি অভিযোগকারীর।
ওসমান গণির নিয়োগ, অভিযোগ ও তদন্ত :
‘ভুয়া’ অভিজ্ঞতা সনদ জমা দিয়ে ওসমান গণির সেকশান অফিসার পদে নিয়োগের বিষয়টি তদন্তে ২০০৪ সালের ২৭ নভেম্বর ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। বোর্ডের তৎকালীন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রফেসর এ, ওয়াই, এম ওবায়েদুল আকবরকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে সদস্য ছিলেন উপ-সচিব মো. নুরুন্নবী ও সহঃ পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. বেলায়েত হোসেন। ২০০৫ সালের ১১ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় ৩ সদস্যের এ কমিটি।
ওই তদন্ত প্রতিবেদন, দুদকে প্রদত্ত অভিযোগ ও হাইকোর্টে দায়েরকৃত রিট আবেদনের তথ্যানুযায়ী- ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই বিজ্ঞপ্তির আলোকে বোর্ডের সেকশান অফিসার পদে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন ওসমান গণি। প্রথম দফায় পর্যাপ্ত সংখ্যক আবেদনকারী না পাওয়ায় ১৯৯৬ সালের জুলাই মাসে বোর্ডের পক্ষ থেকে পুনরায় পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। উভয় বিজ্ঞপ্তিতে সেকশান অফিসার পদে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি এবং সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকুরিতে অন্তত চার বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। বিজ্ঞপ্তির আলোকে ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে আবেদনকারীদের লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের কাছ থেকে পরবর্তীতে মৌখিক সাক্ষাতকারের মাধ্যমে বিধি মোতাবেক সর্বমোট ৮ জনকে চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করে নিয়োগ দেয় বোর্ড কর্তৃপক্ষ। চূড়ান্তভাবে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ায় বোর্ড কর্তৃপক্ষ ওই সময় কোনো অপেক্ষমাণ তালিকা প্রস্তুত করেনি। ওই নিয়োগ কার্যক্রমে ওসমান গণি নিয়োগ পাননি। পরবর্তীতে পুনঃ আবেদনের প্রেক্ষিতে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে দৈনিক ভিত্তিক অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ পান ওসমান গণি।
দৈনিক ভিত্তিক অফিস সহকারী হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর আগের (১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত) নিয়োগ পরীক্ষার ভিত্তিতে সেকশান অফিসার পদে নিয়োগ দিতে ওসমান গণি পুনরায় আবেদন করেন। কোন অপেক্ষমাণ তালিকা করা না হলেও নিয়োগ পরীক্ষার চার বছর পর (২০০১ সালের ১৭ এপ্রিল) ওসমান গণিকে সেকশান অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওই নিয়োগের প্রেক্ষিতে সেকশান অফিসার হিসেবে যোগদানের পর ওসমান গণির আবেদনের সাথে সংযুক্ত কক্সবাজার পৌরসভা কর্তৃক ইস্যুকৃত অভিজ্ঞতা সনদটি ভুয়া মর্মে লিখিত অভিযোগ পায় শিক্ষাবোর্ড। ওই অভিযোগে সেকশান অফিসার পদে ওসমান গণির নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। অভিযোগের প্রেক্ষিতে একাধিক তদন্ত কমিটি করে শিক্ষাবোর্ড। তবে একটি কমিটি তদন্তে অপারগতা প্রকাশ করে বলে বোর্ড সূত্রে জানা যায়। পরবর্তীতে তিন সদস্যের এই কমিটি তদন্ত কার্যক্রম শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়।
যা আছে তদন্ত প্রতিবেদনে :
শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এ, ওয়াই, এম ওবায়েদুল আকবরের নেতৃত্বে গঠিত ৩ সদস্যের কমিটি ২০০৫ সালের ১১ জানুয়ারি তাদের প্রতিবেদন জমা দেয়। তদন্তকালীন কমিটি সরেজমিনে কক্সবাজার পৌরসভায় গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেন।
সেকশান অফিসার পদে নিয়োগ পেতে কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান নুরুল আবছার স্বাক্ষরিত যে অভিজ্ঞতা সনদটি ওসমান গণি জমা দিয়েছিলেন, তদন্তে সে সনদটি ভুয়া হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে। তদন্ত কমিটি কর্তৃক তথ্য প্রদানের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ২০০৫ সালের ২ জানুয়ারি কক্সবাজার পৌরসভার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বরাবর একটি চিঠি দেন।
চিঠিতে বলা হয়- ‘চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সেকশান অফিসার ওসমান গণির ব্যাপারে গঠিত তদন্ত কমিটি অদ্য (০২/০১/২০০৫ ইং) তারিখ অত্র পৌরসভায় উপস্থিত হয়। তদন্ত কমিটি কর্তৃক চাহিত কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা যায়, উক্ত ব্যক্তি (ওসমান গণি) কর্তৃক দাখিলীয় কাগজপত্র সঠিক নহে এবং আমার জানা মতে তিনি অত্র পৌরসভায় চাকুরি করেন নাই।’
এছাড়া কোনো অপেক্ষমাণ তালিকা না থাকা সত্ত্বেও নিয়োগ পরীক্ষার চার বছর পর ওই পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে একজন অনির্বাচিত আবেদনকারী হিসেবে ওসমান গণিকে নিয়োগ প্রদানের কার্যক্রম যুক্তিসঙ্গত হয়নি মর্মে প্রতিবেদনে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি।
প্রতিবেদন জমা হলেও ওসমান গণির বিরুদ্ধে ওই সময় শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি। বোর্ড সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন- যেদিন তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা হয়, সেদিনই আদালতের একটি আদেশ হাতে পায় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। ওসমান গণির এক রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে তদন্ত কার্যক্রমের উপর স্থগিতাদেশ দেয় আদালত। এর প্রেক্ষিতে ওসমান গণির বিরুদ্ধে ওই সময় কোনো ধরণের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি বোর্ড কর্তৃপক্ষ। তবে পরবর্তীতে ওসমান গণি রিট আবেদনটি প্রত্যাহার করে নিলেও এ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কোনো ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ রহস্যজনকভাবে নীরব ভূমিকা পালন করেছে বলে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের অভিযোগ।
চেক জালিয়াতি :
২০০৪ সালে কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থ বিদ্যা বিভাগের এক শিক্ষকের সম্মানি বাবদ চেক জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। চেকের মাধ্যমে ওই শিক্ষকের সম্মানি পরিশোধ করা হয়েছে মর্মে দেখায় বোর্ডের হিসাব বিভাগ। কিন্তু সম্মানি বাবদ কোনো চেক বা টাকা না পাওয়ার বিষয়টি বোর্ডকে অবহিত করেন শফিউল আলম নামের ওই শিক্ষক। পরে বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। ওই সময় ওসমান গণি বোর্ডের হিসাব বিভাগে কর্মরত ছিলেন। তদন্তে চেক জালিয়াতির ঘটনায় ওসমান গণির জড়িত থাকার প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি।
হাইকোর্টের রিট জালিয়াতি :
২০১৫ সালের এসএসসি ও এইচএসসি নির্বাচনী পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হাইকোর্টের রিট জালিয়াতির ঘটনা ঘটে। প্রলোভনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী প্রতি ৩০ হাজার টাকা করে হাতিয়ে নেয় বোর্ডের একটি চক্র। এসব শিক্ষার্থীকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হাইকোর্টের একাধিক রিট আদেশ শিক্ষাবোর্ডে পাঠায় চক্রটি। সন্দেহ হলে এসব রিট আদেশ যাচাই-বাছাই করতে হাইকোর্টে চিঠি দেয় শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। যাচাই-বাছাই করে এসব রিট আবেদন ও এ সংক্রান্ত আদেশ ভুয়া মর্মে হাইকোর্ট বিভাগ থেকে জানানো হয়। পরে এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। তদন্তে তৎকালীন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) হিসেবে কর্মরত ওসমান গণিসহ বোর্ডের ৩ কর্মকর্তা-কর্মচারীর এ জালিয়াতিতে জড়িত থাকার প্রমাণ পায় কমিটি।
দুই দফায় সাময়িক বরখাস্ত :
তদন্তে চেক জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ২০০৫ সালের ১৩ জানুয়ারি ওসমান গণিকে এক দফায় সাময়িক বরখাস্ত করে শিক্ষাবোর্ড। আর হাইকোর্টের রিট জালিয়াতিতে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ওসমান গণিকে আরেক দফায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
শাস্তিমূলক ব্যবস্থা :
হাইকোর্টের রিট জালিয়াতির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওসমান গণির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় শিক্ষাবোর্ড। তবে ওসমান গণির এক রিটের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ সময় এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেনি বোর্ড কর্তৃপক্ষ। পরবর্তীতে রিট প্রত্যাহার এবং এ ধরণের কার্যক্রমে আর জড়াবেন না মর্মে বোর্ডকে অঙ্গীকার নামা দেন ওসমান গণি। এর প্রেক্ষিতে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে ওসমান গণির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে লঘু দণ্ড দেয়া হয়। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর এ সংক্রান্ত আদেশে লঘু দণ্ড হিসেবে ওসমান গণিকে ‘টাইম স্কেলের নিম্ন ধাপে নামিয়ে দেয়া’ হয়। ওই সময় শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর শাহেদা ইসলাম। বোর্ডের সাবেক এই চেয়ারম্যানের দাবি- মহামান্য হাইকোর্টের রিট জালিয়াতির বিষয়টি অবশ্য গুরুতর অপরাধ এবং স্পর্শকাতর। এ অপরাধে জড়িতদের অবশ্যই কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু আমাকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে। আমার যোগদানের আগেই এই তদন্ত কমিটি গঠন হয়। রিপোর্টও জমা হয় আমার যোগদানের আগে। আমি যোগদানের পর ওই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ব্যবস্থা নিয়েছি। তদন্ত রিপোর্টের বাইরে যাওয়ার সুযোগ তো নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়- হাইকোর্টের রিট জালিয়াতির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ৭ কর্মদিবস সময় দিয়ে অভিযুক্তদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়। বিধি অনুযায়ী- ৭ কর্মদিবস সময় দিয়ে কারণ দর্শানো হলে অভিযুক্তদের অপরাধ প্রমাণিত হলেও গুরুদণ্ড প্রদানের সুযোগ নেই। গুরুদণ্ড দিতে হলে অভিযুক্তদের কারণ দর্শাতে অন্তত দশ কর্মদিবস সময় দেয়ার বিধান রয়েছে। তদন্ত কমিটির এমন ভুলের কারণেই গুরুতর এই অপরাধের সাথে জড়িত ওসমান গণিসহ অন্য দুজনকে গুরুদণ্ড দেয়া যায়নি বলে বোর্ড সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে। অবশ্য, এ ধরণের গুরুতর জালিয়াতিতে জড়িতদের কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত বলেই মনে করেন বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম। ভবিষ্যতে যাতে আর কেউ এ ধরণের জালিয়াতিতে জড়ানোর সাহস না করে।
তবে হাইকোর্টের রিট জালিয়াতির ঘটনায় লঘু দণ্ড দেয়া হলেও অন্যান্য জালিয়াতির ঘটনায় এর আগে তার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য পাওয়া যায়নি। এমনকি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক নির্দেশনার পরও তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের তথ্য মেলেনি। অধিকন্তু বিভিন্ন জালিয়াতিতে অভিযুক্ত ওসমান গণিকে সম্প্রতি সহকারী কলেজ পরিদর্শক হিসেবে পদায়নের মাধ্যমে বরং পুরস্কৃত করা হয়েছে বলে মনে করেন বোর্ড সশ্লিষ্টরা। কর্মচারীদের একাংশের দাবি- বোর্ডের বর্তমান শীর্ষ কর্মকর্তাদের দু’জনের বাড়ি ও ওসমান গণির বাড়ি একই এলাকায়। যার সুবাদে এই সময়ে এসে ওসমান গণিকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। আর তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণেও গড়িমসি করা হচ্ছে।
ব্যবস্থা গ্রহণে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা : ওসমান গণির বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে একাধিক দফায় শিক্ষাবোর্ডকে নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব (অফিস) মো. শামছুল আলমের স্বাক্ষরে প্রদত্ত এক চিঠিতে বলা হয়- চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. ওসমান গণি-এর বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ও আর্থিক বিধি লক্সঘনের অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৫/০৩/২০১২ তারিখের শাঃ ১০/১০(অভি)-১/২০০৭/২৪২ স্মারকমূলে পত্র দেয়া হয়। এমতাবস্থায় তার বিরুদ্ধে গৃহীত বিভাগীয় ব্যবস্থা মন্ত্রণালয়কে অবহিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয় চিঠিতে।
একাধিক জালিয়াতির ঘটনা তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও ওসমান গণির বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নিতে পারেনি শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ। কারণ শাস্তি ঠেকাতে শিক্ষাবোর্ডের বিরুদ্ধে ওসমান গণি এ পর্যন্ত অন্তত ৩টি রিট দায়ের করেছেন বলে বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।
অঙ্গীকার নামা : সাময়িক বরখাস্ত আদেশ প্রত্যাহার ও অভিযোগ থেকে অব্যাহতির বিনিময়ে বোর্ডের বিরুদ্ধে আদালতে দায়েরকৃত রিট প্রত্যাহারের প্রস্তাব দিয়ে আবেদন করে থাকেন ওসমান গণি। অন্তত দুই দফা জালিয়াতির ঘটনায় আদালতে রিট দায়েরের মাধ্যমে বোর্ড কর্তৃপক্ষকে পরবর্তীতে এমন প্রস্তাব দেয়ার তথ্য রয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় এমন অপরাধমূলক (জালিয়াতি) কর্মকাণ্ডে পুনরায় আর জড়াবেন না এবং সততা ও ন্যায়পরায়ণতার সাথে দায়িত্ব পালন করবেন মর্মে ওসমান গণি অঙ্গীকারনামাও দেন। কিন্তু জালিয়াতি তিনি ছাড়তে পারেন নি।
ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট ও দুদকের নির্দেশনা : নিয়োগকালীন অভিজ্ঞতা সনদ জালিয়াতি ও অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিয়োগের বিষয়টি তদন্তে প্রমাণিত হওয়ার পরও ওসমান গনির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ২০১৯ সালের শেষ দিকে নাসির উদ্দিন নামে বোর্ডের এক কর্মচারী হাইকোর্টে একটি রিট (রিট নং- ১৪৬৭৯/২০১৯) দায়ের করেন।
শুনানি শেষে ওসমান গণির নিয়োগের বিষয়টি পুনঃতদন্ত পূবর্ক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম. এনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর জারি করা রুলে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষকে ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিলের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিতে বলা হয়।
অপর দিকে, ওসমান গণির বিরুদ্ধে ভুয়া অভিজ্ঞতা সনদ দিয়ে সরকারি চাকুরি করা ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়টি অনুসন্ধানপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শিক্ষাবোর্ডকে চিঠি দেয় দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি দুদক প্রধান কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (অনুসন্ধান ও তদন্ত-২) মো. হাফিজুল ইসলামের স্বাক্ষরে বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর এ চিঠি দেয়া হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশনা ও দুদকের চিঠির প্রেক্ষিতে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি পুনরায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে শিক্ষাবোর্ড। কিন্তু প্রায় ১০ মাসেও কমিটি এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি।
এদিকে, আদালতের নির্দেশনার পর ওসমান গণি পৌরসভায় কর্মরত ছিলেন মর্মে এক দফায় প্রত্যয়ন দিলেও পরবর্তীতে ১৩ দিনের মাথায় সেটি পুনরায় বাতিল করেছেন কক্সবাজার পৌরসভার বর্তমান মেয়র মুজিবুর রহমান। এটিও ওসমান গণির জালিয়াতির আরেকটি চেষ্টা বলে দাবি করেছেন তার বিরুদ্ধে রিটকারী নাসির উদ্দিন। একই প্রতিষ্ঠান কয় ধরণের প্রত্যয়ন দিতে পারে, সে প্রশ্ন তুলে নাসির উদ্দিন বলেন- ‘একই ব্যক্তির জন্য কক্সবাজার পৌরসভার ৩/৪ ধরণের প্রত্যয়ন দেয়ার বিষয়টিতেও জালিয়াতি স্পষ্ট। জাল অভিজ্ঞতা সনদে নিয়োগ, চেক জালিয়াতি ও মহামান্য হাইকোর্টের রিট জালিয়াতিসহ তাঁর নানা জালিয়াতির বিষয় তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে।’ তিনি বলেন, এরপরও ওসমান গণির দৃশ্যমান চূড়ান্ত কোন শাস্তি হয়নি। এতে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’ এ কারণে বিষয়টি নিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে বাধ্য হয়েছেন বলে জানান নাসির উদ্দিন। এ বিষয়ে জানতে ওসমান গণির মোবাইলে একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।
আর ওসমান গণির বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় জানিয়ে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান প্রফেসর প্রদীপ চক্রবর্তী বলেছেন- কমিটি কাজ করছে। ব্যবস্থা গ্রহণে দীর্ঘ সময় লাগার কারণ হিসেবে বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে হবে। তদন্তের পাশাপাশি কমিটিকে দাফতরিক কাজও করতে হচ্ছে, যার কারণে রিপোর্ট দিতে সময় লাগছে।