১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা বিশ্বের ইতিহাসে একটি বর্বরোচিত ও নৃশংস ঘটনা। মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের দোসর তথা জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আল বদর ও আল শামস-এর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাঙালি জাতির চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে নৃশংস, জঘন্য ও বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে জাতিকে মেধাশূন্য করে দেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার পথকে রুদ্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।
বাংলা একাডেমি প্রকাশিত শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থে বুদ্ধিজীবীর সংজ্ঞায় বলা হয়: বুদ্ধিজীবী অর্থ লেখক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, কণ্ঠশিল্পী, সকল পর্যায়ের শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, চলচ্চিত্র ও নাটকের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, সমাজসেবী ও সংস্কৃতিসেবী। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সংকটকালে বৌদ্ধিক পরামর্শ দানের মাধ্যমে যথার্থ দিক নির্দেশনাকারী পণ্ডিতরাই বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত। বুদ্ধিজীবী শব্দটি বুঝাতে রাশিয়ায় উনিশ শতকের ষাটের দশকে প্রথম Intilligentsia শব্দটি ব্যবহৃত হয়। বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনে জনমত, রাজনীতি ও মুল্যবোধকে প্রভাবিত করতে পারেন।
একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালির অস্তিত্বকে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে মুছে ফেলার জন্য পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামক নীল নকশা অনুযায়ী নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অত্যাচার, নির্যাতন, নিপীড়ন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সৈনিকদের আক্রমণের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, শিক্ষক ও কর্মচারীদের আবাসস্থল, কলাভবন, শহিদ মিনার, রোকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ইকবাল হল, জগন্নাথ হল, মধুর ক্যান্টিন, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন অন্যান্য বাড়িঘর ও বসতি।
জগন্নাথ হলে ৩৬ জন ছাত্র, রোকেয়া হলের কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৬ জনকে হত্যার পর গণকবরে সমাধিস্থ করা হয়। পরিসংখ্যান বিভাগের রীডার এ এন এম মুনিরুজ্জামান, দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, ড. ফজলুর রহমানসহ ১১ জন শিক্ষক পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার শিকার হয়। অধ্যাপক ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব জগন্নাথ হলের প্রাক্তন প্রাধ্যক্ষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ছিলেন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সহকারী আবাসিক শিক্ষক ড. অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য শহীদ হন। হলের বাইরে থাকলেও গণহত্যার পর গোবিন্দ চন্দ্র দেবের মৃতদেহ জগন্নাথ হলের গণকবরে পাকিস্তানি বাহিনী অমার্জনীয় অবহেলায় সমাহিত করে। ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার কণ্ঠদেশে গুলি লাগে এবং শেষ পর্যন্ত তিনি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মরদেহের শেষকৃত্য সম্পাদন সম্ভব হয়নি।
কবি হেলাল হাফিজ ‘গণহত্যার ভয়াবহ রাত’ নিবন্ধে লেখেন, ‘পরদিন ২৭ মার্চ সকালে শুনলাম কারফিউ তুলে নেওয়া হয়েছে।….হাবিবুল্লাহর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আমার হলের দিকে রওনা দিলাম। কার্জন হলের পেছন থেকে ব্রিটিশ কাউন্সিল আর এস এম হলের মাঝখান দিয়ে উঠলাম ইকবাল হলের মাঠে। যেতে যেতে পথের পাশে আর ফুটপাতে দেখি গুলিতে ক্ষতবিক্ষত বেশ কয়েকটি লাশ পড়ে আছে। এই প্রথম ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার শিকার হওয়া হতভাগ্য বাঙালিদের লাশ আমার চোখে পড়ল। পরের দৃশ্য আরও বীভৎস ও মর্মান্তিক। হলের পাশে বিশাল খোলা মাঠ। মাঠের কোনায় পা দিয়েই দেখি ৪০-৫০টা মৃতদেহ পড়ে আছে। আমাদের ইকবাল হলের ছাত্র। কেউ কেউ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বোঝা গেল না। হলের আশেপাশের কোয়ার্টারে কয়েকজন শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের এবং তাঁদের বাসার কাজের লোকদেরও লাশ চোখে পড়ল। গুলিতে অনেকেরই দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। গেটের কাছে এসে দেখি আমাদের হলের দারোয়ান আর তাঁর ছেলের লাশ পড়ে আছে।
আমি দ্রুত আমার রুমের সামনে গেলাম। দরজা বাইরে থেকে তালা দেওয়া। তাই ঘাতকেরা ধরে নিয়েছিল, ভেতরে কেউ নেই। দরজা ভাঙেনি। অন্য যে রুমে ছেলেদের পেয়েছে, তাদের মাঠে এনে সারি বেঁধে গুলি করে মেরেছে।’ মার্কিন ইতিহাসবিদ স্ট্যানলি উলপার্টের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ছাত্র হলগুলোতে পাঞ্জাবি-বেলুচ বাহিনীর অভিযানে মার্কিন এম-২৪ ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছিল। ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলে ঘুমিয়ে থাকা ছাত্রদের ওপর ট্যাংক থেকে অন্তত পাঁচ মিনিট বিরতিহীনভাবে মর্টার শেল নিক্ষেপ করা হয়। সেনারা শেল নিক্ষেপ করে ছাত্রাবাস দুটির দরজা-জানালা উড়িয়ে দেয় এবং গোলা ছোড়ার পরও যে ছাত্র, শিক্ষক ও কেয়ার টেকার বেঁচে ছিলেন, তাঁদের সবাইকে সেনারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলে। এই হত্যাকাণ্ডের আগাগোড়া জুড়ে ছিল টিক্কা খানের বাহিনী।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে গণহত্যাকালীন ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তাঁদের লেখনী ধারণ করে এবং প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টাতেই পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের দোসররা তথা রাজাকার, আল বদর, আল শামস বাহিনী বাংলাদেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, চলচ্চিত্রকার, আইনজীবী, সাংবাদিক, গীতিকার ও সুরকারদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বর্বরোচিত ঘটনা। মিরপুর, নাখালপাড়া, মোহাম্মদপুর, রাজারবাগ, ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার প্রভৃতি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র ছিল।
পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের দ্বারা পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে শহিদ বুদ্ধিজীবীদের লাশ রেখে যায়। শহিদ এ সকল বুদ্ধিজীবীদের দেহজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ-হাত-পা বাাঁধা, কারো কারো শরীরে একাধিক গুলি, কাউকে কাউকে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন নিউজউইক এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা যায়, শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা মোট ১,০৭০ জন। বাংলাপিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী শহিদ বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা নিম্নরূপ: শিক্ষাবিদ- ৯৯১ জন, চিকিৎসক- ৪৯ জন, সাংবাদিক- ১৩ জন, আইনজীবী- ৪২ জন এবং অন্যান্য (সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী এবং প্রকৌশলী)- ১৬ জন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বেশ কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান।
বুদ্ধিজীবীদের হত্যার পশ্চাতে কারণ ছিল: পূর্ববাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ করার কাজে তাঁরা তৎপর ছিলেন। তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণকে আন্দোলিত করেছিলেন। এ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড স্পষ্টতই ছিল পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নীলনকশার বাস্তবায়ন। এ নীলনকশার লক্ষ্য ছিল বুদ্ধিজীবীদের নিশ্চিহ্ন করে বাঙালি জাতিকে নেতৃত্বহীন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দেউলিয়ায় পরিণত করা। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর গভর্নর হাউজে ফেলে যাওয়া তার ডায়েরীর পাতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের একটি তালিকা পাওয়া যায় যাঁদের অধিকাংশই ১৪ ডিসেম্বর নিহত হন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর সার্বিক নির্দেশনায় এ নীলনকশা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয় ব্রিগেডিয়ার বশির, লেফটেন্যান্ট কর্নেল হেজাজী, মেজর জহুর, মেজর আসলাম, ক্যাপ্টেন নাসির, ক্যাপ্টেন কাইউম প্রমুখ। রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনীর সশস্ত্র ক্যাডাররা এ হত্যাকাণ্ডে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল।
১৯৭১ সালে গণহত্যা সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ৭ জন জ্যৈষ্ঠ সেনা কর্মকর্তাকে ৬ ডিসেম্বর যুদ্ধকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সামরিক খেতাব ‘হিলাল-ই-জুররত’- এ ভূষিত হয়। তারা হলো: লে. জেনারেল টিক্কা খান, লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, লে. জেনারেল আবু বকর ওসমান মিঠ্ঠা, লে. জেনারেল গোলাম ওমর, লে. জেনারেল রহিম খান, ব্রিগেডিয়ার এস এ আনসারি এবং ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। জাতির মেধাবী সন্তানদের এ শূন্যতা কোনোদিন পূরণ হওয়ার নয়। একাত্তরের এসকল শহিদ বুদ্ধিজীবীদের আমরা যাতে ভুলে না যায়।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।