একাত্তরের খণ্ডচিত্র : ২

জিনাত আজম | শুক্রবার , ৫ জুলাই, ২০২৪ at ৭:০৭ পূর্বাহ্ণ

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র যেহেতু মোহরা থেকে বেশি দূরে নয়; সেজন্য দিনরাত শত্রুপক্ষের আক্রমণ জারি রইল। কিছু কিছু মর্টারশেল আমাদের বাড়ির দেয়ালে এসেও আঘাত করলো। এর মধ্যেই একদিন আমাদের দেউড়ি ঘরে বেশ কয়েকজন ইপিআর ও আর্মিরা এসে জমায়েত হলেন। একরাত থেকে তাঁরা পরদিনই ভারতের বর্ডার অভিমুখে রওনা হলেন।

আমাদের বাড়ি থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হলো। আজম সাহেবের চাচাত ভাই সেকান্দর হায়াত খান, হারুনুর রশীদ খান, আলী নেওয়াজ খান সহ সকলে তাদেরকে যথাসাধ্য খাবার সরবরাহ এবং অন্যান্য সহায়তা দিলো। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র স্থাপনের সাথেও জড়িত ছিলেন সেকান্দর, হারুণ এবং টুকু ভাইরা। এদিকে আমাদের বাড়ির সন্নিকটে কালুরঘাট ব্রীজের তলায় নদীর ধারে পাকবাহিনির ছাউনি। তাদের তৎপরতা অত্যন্ত বেড়ে গেছে। পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মুক্তির খোঁজ করছে। রাজাকারের দলের লোকেরা তাদের খবর দিচ্ছেকোন বাড়ি থেকে ছেলেরা মুক্তিবাহিনিতে যোগ দিয়েছে। তারা বার বার আমাদের বাড়িতেও আসছে। এই সব দেখে বড়রা সিদ্ধান্ত নিলেন এখান থেকে দ্রুত সরে যেতে হবে। সাব্যস্ত হলো রাউজানে আজম সাহেবের বড় আপা থাকেন, আপাতত আমরা সেখানেই যাবো। যাওয়ার প্রাক্কালে আমার আব্বাআম্মাও ছোট ভাইবোনদের নিয়ে হাজির হলেন। আব্বারা থাকতেন পাহাড়তলি ওয়্যারলেস কলোনীর পাশেই রেলওয়ে অফিসার্স কলোনীতে। ওয়্যারলেস কলোনীতে প্রচুর বিহারী বাস করে। যারা কোনোদিন আমাদের দিকে চোখ তুলে থাকাবার সাহসও করেনি। সেই তারাই প্রচণ্ড লুটপাট এবং বহু অফিসারদের পরিবারসহ হত্যা করলো নির্বিচারে। আমাদের বাসায়ও তার ব্যত্যয় হয়নি। আল্লাহর রহমত, আম্মারা জানে বেঁচেছেন। আসা অবধি আম্মা কেঁদেই যাচ্ছেন। আব্বাও বিমর্ষ। আমার বড় দুই ভাই, বড়দা ও মেজদা ঢাকা বুয়েট এবং ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এ বছরেই বের হয়েছেন। মেজদা বায়োকেমিষ্ট্রিতে অনার্স এবং বড় ভাই ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিংএ। তাঁরা দুজনেই ঢাকায়। তাঁদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। বিশেষ করে মেজভাই ড. কামাল চৌধুরী ঢাকা ভার্সিটিতেই জয়েন করাতে তার জন্য বেশি ভয় পাচ্ছিলেন সবাই। ওরা ছাত্রদের হলগুলোতে আক্রমণ করে। তল্লাশী চালায়। ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষকছাত্রদের উপর ওদের আক্রমণ বেশি ছিলো। এ কারণেই পরবর্তীতে বুদ্ধিজীবীদের নির্বিচারে হত্যা করে। আম্মারা নদী পথে আনোয়ারায় নিজ বাড়িতে চলে গেলেন। আমাকে অনেক জোর করলেও আমি সাথে গেলাম না। আমি গেলেও আজম সাহেব যাবেন না। অতএব, এটাই আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হলো।

ভাইদের খবর পেলাম এপ্রিল এর শেষে। তখন সারা দেশে মুক্তিবাহিনির তৎপরতা ছড়িয়ে পড়েছে। সামনাসামনি সমর ছাড়াও গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গায় চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে হানাদার বাহিনিকে নাকাল করে তুলেছে। আমাদের দেশের ছেলেদের সুবিধা ছিলো তারা পানির দেশের মানুষ। এবং নিজ দেশে যেখানেই যান দেশের মানুষ প্রাণপণে তাদের সহায়তা দেয়। অপরদিকে পাকিস্তানিরা পানিকে প্রচণ্ড ভয় পায়। অভ্যস্ত নয়। এবং মানুষের সহায়তা বঞ্চিত। রাজাকারআলবদররাই ছিলো তাদের দোসর। বড় দারা দুজনেই থাকতেন ঢাকার গ্রীন রোডের একটা ফ্ল্যাটে। একদিন ঐ এলাকায় পাঞ্জাবী বাহিনির উপর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। শুরু হয়ে গেলো মুক্তির তল্লাশি। বয়সে তরুণ দেখে দুভাইকেই ধরে নিয়ে গেলো আরও অনেকের সাথে। মেজদার জন্য সবাই ভয়ে ছিলো। যেহেতু ভার্সিটির শিক্ষক। সৌভাগ্যক্রমে তাদের কি মনে করে ওরা ছেড়ে দিলো।

আমরাও এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে রাউজানের পথে রওনা হই। আমার ভাসুরের (ডা. আলী আকবর খান) একটা ফিয়াই গাড়ি ছিলো। আমরা মেয়েরা সেই গাড়িতে আর ছেলেরা যেভাবে পারে। হেঁটে, রিক্‌শায়, ট্যাঙিতে ওঠাবসা করে। বড় আপার এখানে দুই পরিবার মিলে আমরা প্রায় ৩৫ জন। এতজনের তিনবেলার খাবার যোগাতে আমরা মেয়েরা রীতিমত হয়রান হয়ে যেতাম। তবুও সবাই একত্রে, এ এক অন্যরকম পরিবেশ। বিশেষ করে হানাদার বাহিনি, পাকিস্তানিরা না থাকলেও তার ভয় ছিলো সবার মনে প্রচণ্ড রকম। পাশের বাড়ির এক নারীর করুণ কান্না শুনতাম প্রতিদিন। তাঁর স্বামী চট্টগ্রাম শহর থেকে নিখোঁজ। পাকবাহিনির বুলেট খরচ করতে এক মুহূর্ত দেরি লাগতো না। যাকে সন্দেহ হতো তাকেই গুলি করে মারতো। বিশেষ করে কালুরঘাট ব্রীজের উপর লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে বুলেটে ঝাঁজরা করে লাশ নদীতে ফেলে দিতো। এভাবে তারা যে কত নিরীহ প্রাণ নিয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই।

যা হোক, রাউজানে আমরা মোটামুটি ছিলাম। সবার সাথে ছিলো ট্রানজিস্টার। সকালসন্ধ্যা বিবিসি বাংলা, স্বাধীন বাংলা বেতারই ছিলো সঙ্গী। আমাদের সংবাদবাহক এবং যুদ্ধের অনুপ্রেরণার রসদ বহনকারী। এর মধ্যে এই এলাকার অনেক যুবক দেশ ছেড়েছে। মুক্তিবাহিনিতে যোগ দিয়েছে। কেউ কেউ ভারতে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। কালেভদ্রে তাঁদের সংবাদ পাওয়া যেতো। অন্যরা যারা ছোট ছিলো তাদের রক্ষাকবচ ছিলো পুকুর। মিলিটারি শুনলেই বাড়ি সুনশান। ছেলেরা পুকুরের পানিতে নাক ভাসিয়ে ডুবে থাকতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

আমাদের বাড়িতে আমার শ্বশুর (বয়স প্রায় ৮০) মুসলিম লীগের অন্ধ সাপোর্টার। তার সাথে রীতিমত স্বাধীনতার পক্ষেবিপক্ষে নিয়ে তর্কযুদ্ধ লেগে যেতো অনেকের। ঐদিকে বড় দুলাভাই শামসুল ইসলাম চৌধুরী ছিলেন ঘোরতম আওয়ামী লীগ তথা মুক্তিযুদ্ধের সাপোর্টার। রেডিওতে খবর শুনেই শ্বশুরজামাই প্রচণ্ড তর্কে জড়িয়ে যেতেন। তাঁদেরকে থামানো রীতিমত কষ্টকর হয়ে পড়তো। কেউ কেউ দুই জনের বাহাস শুনে রীতিমত মজা পেতো। নতুন নতুন তর্কের রসদ যোগাতো।

রাউজানে সপ্তাহে দুইদিন হাট বসতো। এক হাটের নাম ছিলো ফকির হাট। বাড়ির ছেলেরা কবির মিঞাকে নিয়ে একদিন হাটে গেছে। ফিরলো খালি হাতে। রীতিমত উস্‌কোখুস্‌কোভাবে। বাজারের থলে ঝুড়ি কিছুই নেই সাথে। জানা গেলো বাজারের সবই ঠিকঠাক চলছিলো। ক্রেতা বিক্রেতারাও ছিলো সরগরম। এমনি সময়ে হঠাৎ গুলির শব্দ। কে যেন বলে উঠলো পাঞ্জাবী। আর শুরু হলো বাজার জুড়ে দুদ্দাড়, হুটোপুটি। মাছতরকারি, হাঁসমুরগি, চালডাল সব ওলটপালট একাকার। মিলিটারি হানা দিয়েছে। অতএব মাল ছেড়ে সবাই জান নিয়ে সটকে পড়তে ব্যস্ত। এখানেও যে লুটপাট হয়নি তা নয়। কারো মাছ, মুরগি নিয়ে কেউ সটকে পড়তে ব্যস্ত। পলকেই বাজার খালি।

কিছু পরে শোনা গেলো মিলিটারি নয়, রিকশার টায়ার ফেটেছিলো। সেই শব্দ! মানুষের মধ্যে স্বস্তি। কিন্তু এরই মাঝে অনেকেই ভালোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হলো।

এপ্রিলের শেষের দিকে পাক সরকার বারংবার দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি সহজ করার জন্য ঘোষণা দিচ্ছে মানুষকে। অফিস আদালতে জয়েন করার জন্য। আজম সাহেবের কাছেও খবর এলো। একদিন তিনি সেই উদ্দেশ্যেই রাউজান থেকে শহর অভিমুখে রওনা হলেনও বাসে করে। সত্তরঘাট ব্রীজের কাছে পাক মিলিটারি বাস থামিয়ে পথে নামালো সবাইকে। একে ওকে বুকে রাইফেলের গুতো দিয়ে জিজ্ঞেস করে মুক্তি হ্যায়? কিধার? রাইফেলের গুতো থেকে তিনিও বাদ গেলেন না। তবে কি মনে করে ওরা তাকে পুনরায় বাসে উঠতে দিলো। যাদের সন্দেহজনক মনে হলো তাদেরকে আটকে দিলো। তাদের কপালে কি হয়েছিলো সেটা বলাই বাহুল্য। ক্যাম্পে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন এবং অবশেষে মৃত্যু। এই ছিলো ওদের নিয়ম।

আমাদের রাউজানে প্রায় দেড়মাস কেটে গেলো। মোহরায় আমাদের বাড়ি প্রায় খালি। বিশেষ করে সেকান্দর হায়াত খান (ভাসুর), হারুনুর রশীদ খান (দেবর) নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে প্রায়ই পাকবাহিনি হানা দিতো আমাদের বাড়িতে। মাসের প্রথম সপ্তাহে তবুও সাহস করলাম বাড়িতে ফেরার জন্য। কারণ আমার শরীর ভালো যাচ্ছিলো না। আতিকের জন্মের তারিখ ডাক্তার নির্বাচন করেছিলো মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। অনেক সাহস করে সেই দাদার গাড়িতেই ফিরলাম আমরা বাড়িতে মোহরায়। আমরা বাড়ি ছেড়ে যাবার পর আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মসজিদের ইমাম মাওলানা হাবিবুর রহমান সাহেব সপরিবারে। সেদিন হাটহাজারী অঙিজেন এলাকা পার হয়ে কালুরঘাট এলাকায় আসতেই চোখে পড়লো খান সেনাদের সহিংসতার প্রতিমূর্তি যেন সমস্ত কালুরঘাট এলাকা। মৌলভীবাজার, কামাল বাজার, মোহরার পুরো এলাকার রাস্তাজুড়ে কেবলি অগ্নিদগ্ধ এলাকা। সমস্ত দোকানপাট পুড়ে ছাইয়ের স্তুপে ভাঙাচোরা, পোড়াদগ্ধ বিবর্ণ অবকাঠামো নিয়ে দণ্ডায়মান। কি জমজমাট এলাকার এই দূরবস্থা। দেখেই সবার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে কেবলি এক দীর্ঘশ্বাস বের হলো। আমরা সবাই মূক হয়ে কেবলি তাকিয়ে থাকলাম। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে? হাবিবুর রহমান সাহেবরা মাসখানেক ছিলেন।

আমাদের বাড়িঘর জনমানুষহীন থাকলেও মোটামুটি অক্ষতই ছিলো। আমরা আসার সপ্তাহ খানেক পর আমার প্রসব বেদনা শুরু হলো রাতে। পুরো রাত কারফিউ। নাই ডাক্তারনার্সওষুধ কিছুই। এভাবেই রাত পার করলাম প্রচণ্ড কাতরতার সাথে। ভোর হবার আগেই কারফিউর সময় পার হতেই ডাকা হলো গ্রামের এক ধাত্রীকে। সুবেহ সাদেকের সময় ১৩ মে বৃহস্পতিবার আতিক জন্ম নিলো খুব সহজভাবেই। সবই আল্লাহ্‌র মেহেরবানী। ধাত্রীকে দেয়া হলো ২০ টাকা এবং খাবার। এতেই সে খুশি। তখনকার বিশ টাকা সম্ভবত এখনকার ৫০০ টাকার সমান। ধাত্রী মা খোশচিত্তে বিদায় নিলেন। আমি মাঝে মাঝে উনাকে সাহায্য করতাম। পরবর্তীকালে আতিক ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পেলে, ওই টাকা দিয়ে আমি উনাকে থামিব্লাউজওড়না কিনে উপহার দিয়েছিলাম। খুব খুশি হয়েছিলেন। (ক্রমশ)

লেখক : রম্যসাহিত্যিক, সভানেত্রী, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রিয় নবীর (সা.) প্রাণের শহর মদিনা মুনাওয়ারা
পরবর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা