জন্মগতভাবে মানুষ যেহেতু সামাজিক জীব তাই তাকে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে হয়। ঘরে ও বাইরে সকলের সাথে ভালো-মন্দ সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনা ভাগাভাগি করে নিতে হয়। এই ভাগাভাগিতে যদি কিছুটা কম বেশি হয়ে থাকে তাহলেই বিপত্তি ঘটে। তবুও মানুষ আপনজনের সান্নিধ্য খুঁজে। নতুন নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলে। রক্তের বন্ধনের পাশাপাশি আত্মার সম্পর্ক গুলোকে আঁকড়িয়ে ধরে একাকিত্ব দূর করার চেষ্টা করে। জীবনের একটা সময় জুড়ে মোটামুটি আপন পর সকলকেই সাথে নিয়ে এগোতে থাকে। বিপদ আপদ আসলে কেউ না কেউ কাছে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়।
সব সময় পাশে ও সাথে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। প্রতিটি মানুষের জীবনে বিশেষ করে জন্মের শুরু থেকে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আদর ভালোবাসায় সুন্দর শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো পার হয়। দিনে দিনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ব্যস্ততাও বাড়তে থাকে। তখন থেকে সময়ের পরিক্রমায় কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক মন মানসিকতা নিজের মধ্যে গড়তে থাকে। পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে বাহিরের জগতে বিচরণ করার সময় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বুঝতে থাকে। ধাপে ধাপে নিজের একটি নিজস্ব একান্ত অস্তিত্ব নিয়ে জীবন সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর ফলে অনেকের সাথে সম্পর্কে চিড় ধরে ও অনেক সম্পর্কে ভাটা দেখা যায়। আবার অনেক সম্পর্ক নতুন করে গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে মানুষ নিজের স্বার্থে সম্পর্কগুলো টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সামাজিক জীব হিসাবে মানুষ কখনো একাকী জীবন চালাতে পারে না। নিজেকে ভালো রাখার জন্যই ও নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে তারা আগামী দিনগুলো নিয়ে চিন্তিত হয়ে যায়।
পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কিছু কিছু মানুষের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেই মানুষগুলোই রক্তের সম্পর্ক ছাড়িয়ে আত্মার সম্পর্ক নিয়ে এক নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখে। তবুও মানুষ এক সময় একা হয়ে যায়। জীবনের তাগিদে অথবা জীবনের প্রয়োজনে মানুষ এক সময় একাকী জীবন চলতে থাকে। বিশেষ করে যখন ছেলেমেয়েরা জীবন ও জীবিকার তাগিদে এক একজন এক এক জায়গায় চলে যায়। তখনই মানুষ নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে এই সমস্যাটি প্রকট আকার ধারণ করে। তখন এক নিঃসঙ্গ একাকী জীবন তাকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। কথা বলার কেউ থাকে না। বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যের অভাব বোধ করেন। এই অভাব পূরণের জন্য মানুষ সময় অসময়ে আত্মীয়স্বজনের কাছে ছুটে যায়। আবার কখনো কখনো আত্মীয়-স্বজনকেই কাছে টানে।
যান্ত্রিকতা ও ব্যস্ততার কারণে যখন নিজের দিকে তাকানোর সময় ও সুযোগ তেমন হয় না ঠিক তখনই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের একাকিত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যারা এক সময় খুব ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন তারাও সময় কাল ভেদে একা হয়ে যায়। অলস সময়ের গহ্বরে হাবুডুবু খেতে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার কোন ধরনের প্রাণের স্পন্দন নিয়ে আসে না। নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব কাটানোর জন্য মানুষ অনেক ধরনের উপায় অবলম্বন করে থাকে। মাঝে মাঝে আত্মীয় বন্ধু পাড়া প্রতিবেশীদের বাড়িতে বেড়াতে যায়। হয়তো দুই তিন দিন থেকে আসে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা বিভিন্নভাবে উপায় বের করে। সময় ও সুযোগ নিয়ে পর্যটন এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। সাধ ও সাধ্যের মধ্যে থেকে সময়কে নিজের মত করে ব্যয় করে। সম্প্রতি জাপানের একটি প্রবীণ ক্লাবে ৩০ জন বাচ্চাকে ভাড়া করে আনা হয়। এই প্রবীণ মানুষগুলোকে গান কবিতা ছড়া গল্প গুজবে হাসি খুশীতে প্রাণবন্ত করে রাখা হচ্ছে এই বাচ্চাদের কাজ।
উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের জন্য অনেক সুযোগ সুবিধা আছে। আরও একটি খবরে জানা যায়; জাপানের একজন ব্যক্তি অন্যদের একাকিত্ব দূর করার জন্য বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশ সাড়া জাগিয়েছে। যেকোনো বয়সের মানুষের সাথে গল্প গুজব করে আনন্দ বিনোদন দিয়ে থাকে। আবার কখনো কখনো বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করে একটা সুন্দর সময় উপহার দেয়। তার এই ইতিবাচক ডাকে সাড়া দিয়ে অনেক মানুষ এগিয়ে এসেছে। এমন একটা সুন্দর ও সুস্থ বিনোদনের জন্য উক্ত ব্যক্তি প্রতি ঘণ্টার পারিশ্রমিক বেঁধে দেয়। মূলত বেকারত্ব থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই ধরনের একটি উপায় গ্রহণ করে। কিন্তু তার এই অভিনবত্ব অনেক মানুষকে মুগ্ধ করে। অর্থের বিনিময়ে একটি ইতিবাচক ভুমিকা পালন করে জীবনকে অর্থবহ করার এই উদাহরণটি প্রশংসনীয়। যান্ত্রিক ব্যস্ততায় এইটি একটা সতর্কবার্তা। একদিন হয়তো অনেক মানুষকে একাকিত্ব জীবন অতিবাহিত করতে হতে পারে। তাই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের ভিতকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমার আপনার সকলের।
বর্তমানে একাকিত্ব একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যান্ত্রিক ব্যস্ততায় সেই ছোট্টকাল থেকে সামাজিক মূল্যবোধের শিক্ষার ঘাটতি থেকেই একাকিত্ব মানুষের মাঝে অসহায়ত্ব সৃষ্টি করছে। বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবারের সংখ্যা খুব বেশি চোখে পড়ে না। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে মূলত দায়িত্ববোধের শিক্ষা বৃদ্ধি পায়। রক্তের সম্পর্কের দাম রক্তে পরিশোধ করার মনমানসিকতা গড়ে উঠে। একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যরা সামাজিক দায়িত্ববোধের শিক্ষা থেকে সমাজ ও দেশের জন্য নিজেকে গড়ে উঠে। অর্থাৎ ইতিবাচক ভুমিকা তাকে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষ করতে বাধা দিয়ে থাকে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় বাস্তবতা ও জীবিকার তাগিদে একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারে তিন চার জনের সংসারের সদস্যরাও বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন।
যে যার ব্যস্ততায় সন্তানের লেখাপড়ার প্রতিও তেমন সময় দিতে পারে না। গৃহশিক্ষক ও কোচিং নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবারের প্রতিটি সদস্য নিজের মত করে মানসিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। এভাবেই দিন দিন এককেন্দ্রিক মনমানসিকতায় আত্নীয় বন্ধু পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে একটা দূরত্ব বাড়তে থাকে। নিজেদের সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলার উপযুক্ত সময় বের করতে বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে সন্তানরা যখন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের কারণে ঘর থেকে বের হয় তখন থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্নে সেই দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে। বিয়ে শাদির পর আবার সেই পরিবারটি ভেঙে আরো কয়েকটি পরিবার সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় পরিবারের বয়স্কদের জন্য সময় অতিবাহিত করা অনেক কষ্টকর হয়ে পড়ে। মা-বাবা উভয়ে চাকরিজীবী হলে বাচ্চাদের জন্যও সমস্যা আরো বেশি হয়। কীভাবে বাচ্চাদের দেখাশোনা ও সেবাযত্ন করবে এই চিন্তা পেশাজীবনে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে।
অনেক উচ্চ শিক্ষিত ও যোগ্য মহিলাকে শুধু সন্তানের নিরাপত্তার কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। সন্তান যখন ব্যস্ত হয়ে যায় সেই মা বিষণ্নতা ও হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিন কাটে। যে সন্তানের জন্য এক সময় সব কিছু ছেড়ে দেন সেই সন্তান একদিন জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য সংসার গড়ে তোলে। পুরুষদের ক্ষেত্রে চাকরি জীবনের ব্যস্ততার পরে অবসর গ্রহণের পর একাকিত্ব মারাত্মক আকার ধারণ করে। অবসর গ্রহণের পর যখন সংসারের সদস্যদের খুব বেশি প্রয়োজন তখন অধিকাংশ পরিবারের সন্তান নিজের জীবন যুদ্ধ নিয়ে হিমশিম খেতে থাকে। কেউ কাউকে সময় দেওয়ার মত সুযোগ করে উঠতে পারে না। চক্রাকারে একই ঘটনাগুলো পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের ক্ষেত্রে বিভেদ সৃষ্টি করে। এভাবেই দূরত্ব ও একাকিত্ব মানুষের মাঝে অসহায়ত্ব সৃষ্টি করে। বিভিন্ন মানসিক সমস্যা থেকে শারীরিক সমস্যা দেখা যায়। জীবন সংগ্রামের দীপ্ত মানুষগুলো বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যার কারণে ঘর বন্দী জীবন কাটায়। একাকিত্ব তখন আরো বেশি দূর্বিষহ হয়ে উঠে। ব্যস্ত জীবনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে এসে জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত মানুষের মাঝে জীবনের অর্থটুকু অনেকটা অর্থহীন হয়ে যায়।
লেখক: কলামিস্ট; অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।