মাত্র ৫ দিনের ব্যবধানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ক্রুড অয়েলবাহী দ্বিতীয় জাহাজটিতেও বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। শুক্রবার গভীর রাতে আগুনে জাহাজটির একজন নাবিক প্রাণ হারিয়েছে। জাহাজটিতে থাকা বাকি ৪৮ জনকে উদ্ধার করেছে কোস্টগার্ড। দেশের জ্বালানি তেল লাইটারিং কাজে নিয়োজিত দুটি অয়েল ট্যাংকার বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডে অচল হয়ে পড়াকে নাশকতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে কোনো চক্র বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের দুটি জাহাজকে টার্গেট করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আজ রোববার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান এবং পরিচালকসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা চট্টগ্রাম আসছেন। গতকাল শনিবার সকালে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কমডোর মাহমুদুল মালেক সংবাদ সম্মেলনে ঘটনার পেছনে নাশকতা থাকতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে দেশের জ্বালানি সেক্টরের শীর্ষ কর্মকর্তারা গতকাল বিকালে জুম মিটিংয়ে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। সেখানেও এমটি বাংলার সৌরভে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা স্বাভাবিক নয় বলে আলোচিত হয়েছে। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদার ভ্যাসেল থেকে ক্রুড অয়েল খালাসের জন্য বিএসসি একটি ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার ট্যাংকার ভাড়া নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ঘটনা তদন্তে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিএসসি।
সূত্রে জানা যায়, দেশের জ্বালানি তেল সেক্টরের প্রায় পুরোটা আমদানি–নির্ভর। বর্তমানে দেশে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে পরিশোধিত অপরিশোধিত অবস্থায় এসব তেল আমদানি করা হয়। বিদেশ থেকে আনা এই তেলের বেশিরভাগ আসে বড় বড় অয়েল ট্যাংকারে। এসব ট্যাংকার চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারে না। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী ট্যাংকার থেকে বিএসসির জাহাজ এমটি বাংলার জ্যোতি ও এমটি বাংলার সৌরভ জ্বালানি তেল লাইটারিং করে গুপ্তাখাল জেটিতে এনে জ্বালানি তেলের প্রধান ডিপোতে খালাস করে। দেশে কেবলমাত্র দুটি অয়েল ট্যাংকার বহির্নোঙর থেকে তেল খালাস ও পরিবহন করে। বিপিসি ও বিএসসির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় তেল খালাস ও পরিবহন করা হয়।
এমটি বাংলার জ্যোতিতে গত ৩০ সেপ্টেম্বর সকালে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় গত শুক্রবার রাত ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে দ্বিতীয় জাহাজ বাংলার সৌরভেও একইভাবে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, দুটি ঘটনায় দৃশ্যমান কিছু পার্থক্য রয়েছে। বাংলার জ্যোতিতে আবদ্ধ জায়গায় কাজ করার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। আর বাংলার সৌরভে একসাথে চারটি পয়েন্টে আগুন দেখা দেয় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। ওই সময় জাহাজে কোনো মেরামত কাজ চলছিল না।
গভীর রাতের বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের পর নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ আগুন নিভানোর কাজ করে। সাগর উত্তাল থাকায় আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয় জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, তীব্র বাতাসে ঠিকভাবে কাজ করা যাচ্ছিল না। প্রায় চার ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে। নৌবাহিনীর ফায়ার ফাইটিং টিমের পাশাপাশি কোস্টগার্ডের বিসিজিটি প্রমত্ত এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের কাণ্ডারি–৩, ৪, ৮ এবং ১০ আগুন নিভানোর কাজে যোগ দেয়। এছাড়া কোস্টগার্ডের বিসিজিএস শ্যামল বাংলার চারটি উদ্ধারকারী টিম এবং তিনটি মেটাল শার্ক নাবিকদের উদ্ধারে অভিযান পরিচালনা করে। বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের সময় জাহাজটির ক্যাপ্টেনসহ নাবিকদের অনেকে সাগরে ঝাঁপ দেন। কোস্টগার্ডের উদ্ধারকারী দল ৪৮ নাবিককে উদ্ধার করে। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাদেক মিয়া নামে এক নাবিককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঠানো হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
১৯৮৭ সালে ডেনমার্ক থেকে কেনা বাংলার সৌরভের আয়ুষ্কাল ফুরিয়েছে আগে। বিএসসি ৩৭ বছরের পুরনো জাহাজটিকে সংস্কার করে পরিচালনা করে আসছিল। বাংলার জ্যোতির মতো এটিও শুধু বহির্নোঙর থেকে বন্দরের ডলফিন জেটিতে জ্বালানি তেল পরিবহন করত। শুক্রবার রাতের দুর্ঘটনায় জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে জাহাজে থাকা প্রায় ৮৫ কোটি টাকা দামের ক্রুড অয়েল অক্ষত রয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতি টন ৬শ ডলার দরে আমদানিকৃত ক্রুড অয়েলগুলো বহির্নোঙরে অবস্থানকারী মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগ্যাসি থেকে খালাস করে বাংলার সৌরভ বন্দরের ডলফিন জেটিতে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল। আগুনে জাহাজটির ব্যাপক ক্ষতি হলেও হ্যাজ অক্ষত রয়েছে জানিয়ে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলেছে, সাগর উত্তাল, তাই বাইরের কাউকে জাহাজটির কাছাকাছি যেতে দেওয়া হচ্ছে না। তবে দূর থেকে যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে জাহাজটির সামনের অংশ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত দেখা গেছে। এই জাহাজটি আর চালানো যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে।
বিএসসির এমডির সংবাদ সম্মেলন : এমটি বাংলার সৌরভের দুর্ঘটনা নিয়ে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বিএসসি কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক বলেন, কোনো বিস্ফোরণ থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। এরপরও জাহাজটির এক সঙ্গে চার স্থানে আগুন জ্বলে উঠেছে। গ্যাস ফর্ম কিংবা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেনি। তিনি বলেন, বাংলার জ্যোতিতে আগুন লাগার পর নাশকতার কথা মাথায় রেখেই তদন্তকারীরা অগ্রসর হচ্ছিলেন। সেই সঙ্গে ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে বাংলার সৌরভে ফায়ার ড্রিল করা হয়। এই জাহাজটিতে কোনো মেরামতের কাজও চলছিল না।
তিনি জানান, গত রাতে হঠাৎ জাহাজের সামনের দিকে প্রায় একসঙ্গে চার জায়গায় স্ফুলিঙ্গ দেখতে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন উদ্ধার হওয়া ক্রুরা। সে সময় জাহাজের কাছ থেকে একটি স্পিডবোট সরে যেতে দেখা যায় বলে জানান তারা। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করার জন্য এই নাশকতা হতে পারে। এরপরও সবকিছু তদন্তের পর জানা যাবে। এ ঘটনা তদন্তে আট সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
কমডোর মাহমুদুল বলেন, জাহাজে অগ্নিকাণ্ডের সময় সমুদ্র উত্তাল ছিল। বাতাসের গতিবেগ বেশি থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কষ্টকর হয়ে পড়েছিল। অল্প সময়ের মধ্যে নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সাতটি টাগবোট একযোগে অপারেশন পরিচালনা করে। পরবর্তী সময়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে।
তিনি বলেন, ব্যাক টু ব্যাক (পরপর) এ ধরনের দুটি ঘটনা জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে এটি কোনো নাশকতা কিনা তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। তিনি জানান, বাংলার সৌরভে ১১ হাজার ৫৫ টন ক্রুড অয়েল ছিল এবং ৪৮ জন নাবিক ছিলেন।
তিনি বলেন, আগুনের পর কেউ কেউ আত্মরক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সবাইকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়া জাহাজের স্টুয়ার্ড সাদেক মিয়া (৬০) মারা গেছেন। উদ্ধারের পর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।
বিএসসির তদন্ত কমিটি : বিএসসির মালিকানাধীন জাহাজ বাংলার সৌরভে বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় আট সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবরে রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। কমিটিকে সৃষ্ট দুর্ঘটনার কারণ, দুর্ঘটনার ফলে সংঘটিত ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ এবং অনুরূপ দুর্ঘটনা রোধকল্পে ভবিষ্যতে করণীয় বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল বিএসসির সচিব আবু সাফায়াৎ মুহাম্মদ শাহেদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক আদেশে তদন্ত কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়।
তদন্ত কমিটিতে বিএসসির নির্বাহী পরিচালক (প্রযুক্তি) ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফকে প্রধান করা হয়েছে। সদস্য সচিব করা হয়েছে বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (ডিপিএ অ্যান্ড সিএসও) মঈন উদ্দিন আহাম্মদ মজুমদারকে। এছাড়া বিপিসির প্রতিনিধি, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের প্রতিনিধি, বিএসসি আঞ্চলিক কার্যালয় ঢাকার পরামর্শক (মেরিন সুপার–ডেক), বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (মেরিন ওয়ার্কশপ), বিএসসির মহাব্যবস্থাপক (কার্গো সুপারভিশন অ্যান্ড অপারেশন) এবং বিএসসির মহাব্যবস্থাপককে (জাহাজ মেরামত) কমিটির সদস্য করা হয়েছে।
জ্বালানি পরিবহনে বিকল্প চিন্তা : বহির্নোঙর থেকে গুপ্তাখাল জেটিতে তেল পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব বিএসসির। রাষ্ট্রায়ত্ত দুটি সংস্থা বিএসসি ও বিপিসির মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় তেল পরিবহনের দায়িত্ব বিএসসির। বিএসসির দুটি অয়েল ট্যাংকার অচল হয়ে গেছে। এতে করে ৯৮ হাজার টন তেলের মধ্যে খালাসের বাকি প্রায় ৩০ হাজার টন ক্রুড অয়েল নিয়ে বহির্নোঙরে অপেক্ষায় আছে মাদার ভ্যাসেল এমটি ওমেরা লিগ্যাসি। এই তেল বিএসসিকে খালাস করে এনে দিতে হবে। কিন্তু বিএসসির কাছে আর কোনো অয়েল ট্যাংকার নেই। এখন বিকল্প হিসেবে বিএসসি ২৫ হাজার টন ধারণক্ষমতার একটি অয়েল ট্যাংকার ভাড়া করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। তবে ভাড়া করা জাহাজ কবে নাগাদ বহির্নোঙরে পৌঁছাবে বা কবে তেল খালাস করবে সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। নতুন জাহাজ না আসা পর্যন্ত মাদার ভ্যাসেলটি নোঙর করা থাকবে। এর ফলে বিপিসিকে লাখ লাখ ডলার বাড়তি গচ্ছা দিতে হবে।
অবশ্য বিপিসির নিয়ন্ত্রণাধীন পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানির নিকট মোট ৯৬টি ছোট ট্যাংকার রয়েছে। এক হাজার টন থেকে দুই হাজার টন ধারণক্ষমতার এসব ট্যাংকার দিয়ে আপাতত ক্রুড অয়েলগুলো খালাস করা যায় কিনা তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে বিএসসি এবং বিপিসিকে আলোচনা করে বিষয়টি ঠিক করতে হবে।