আমাদের দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো কৃষি ও শিল্প। এক্ষেত্রে একটি দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকটাই মুখ্য বিষয়। দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন নানা ঝুঁকি প্রকট আকার ধারণ করে। এর মধ্যে মূল্যম্ফীতি অন্যতম একটি ঝুঁকি। সেক্ষেত্রে পণ্যদ্রব্যাদি আমদানির ফলে এলসি দায় মেটাতে ডলার বিক্রি বৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ কমে যায়। এর ফলে মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়। এতে কমে যায় স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও জীবনযাত্রার মান। বিশেষ করে আমাদের শিল্প উৎপাদনের অধিকাংশ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আমদানির দ্রব্যাদির মূল্য বেশির ভাগই ডলারের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়। সে কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই যদি আমদানি পণ্য দেশে উৎপাদন করা সম্ভব হতো। এতে আমদানির উপর চাপ কমতো এবং ডলারের চাহিদাও তুলনামূলক কম হতো। ফলে রেমিট্যান্স ও রফতানি কম হলেও সঙ্কট তেমন প্রকট হতো না। এতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য তুলনামূলকভাবে সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে রাখা সম্ভব হতো।
আমাদের দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায় কারণে অকারণে। কোনো একটি অজুহাত পেলেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়িয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান (রোজায়, ঈদে ও পুজায় ইত্যাদি) ও জাতীয় বাজেট এবং দিবসে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা যেন এক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উল্লেখ্য যে, বিদেশে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও দিবসে সাধারণত জনগণের সুবিধার্থে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের দাম হ্রাস করার প্রবণতা অনেক বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে এর চিত্র উল্টো। বিশেষ করে করোনা মহামারী কারণে বিশ্ব যখন তাল–মাতাল অবস্থা। একদিকে যেমন শত শত প্রতিষ্ঠান করোনাকালে বন্ধ হয়ে গেছে। অন্যদিকে হাজার হাজার মানুষ চাকুরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে অনেক পরিবার সংসার পরিচালনার জন্য আয়ের সাথে ব্যয়ের কোনো সামঞ্জস্য নেই বিধায় সঞ্চিত সঞ্চয় খরচ করছে। আবার অনেক পরিবার ঋণ করে সংসার পরিচালনা করতে হচ্ছে। এতে অনেক সাধারণ পরিবার ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। তাছাড়া সাধারণ মানুষের আয় না বাড়লেও বাড়তি দামে পণ্যদ্রব্য ক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। এ কারণে অনেক পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে স্থায়ীভাবে জীবন–যাপন করছে। এছাড়াও করোনাকালে কোনো কোনো দেশের অর্থনীতির চাকা মোটেই সচল ছিল না। এর ফলে বিশ্বে সকল দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশেও সে ধারা অব্যাহত রয়েছে। তাছাড়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ মোকাবিলা করতে আমেরিকাসহ পশ্চিমাবিশ্ব নির্বিচারে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু তাৎক্ষণিক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে উন্নত বিশ্বের বাজারে। তবে এ বিষয়গুলোর সঙ্গে গ্যাস, তেল ও বিদ্যুতের সংকট কিংবা রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবও বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে অনেকাংশে কঠিন করে তুলেছে। এক্ষেত্রে চলমান যুদ্ধের কারণে তেল আমদানিতেও বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অযাচিতভাবে একশ্রেণি অসাধু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
আমাদের দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের মূল্য সাধ্যের মধ্যে রাখতে হলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্যে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমাতে হবে। এ জন্য আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে। দেশের প্রয়োজনীয় নিত্য পণ্যের কাঁচামাল উৎপাদনের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চরম ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে হলে মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি রক্ষণশীল হতে হবে। পণ্যদ্রব্যাদির মূল্য যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে মানুষের আয় বৃদ্ধি পায়নি। এক্ষেত্রে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষের সন্তানদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিয়মিত খাদ্য গ্রহণেও কিছুটা কাটছাঁট করতে হচ্ছে। দেশে খাদ্য উৎপাদন বিশেষ করে কৃষিপণ্য উৎপাদন পর্যাপ্ত বাড়লেও এর সুফল জনগণ পায় না। শুধুমাত্র আধুনিক স্টোরেজ পদ্ধতি ও মানসম্পন্ন বাজার ব্যবস্থা না থাকার কারণে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীরা এ সুবিধাগুলো সহজে ভোগ করছে। এর আগে বৃহৎ ব্যবসা–প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেরাই পণ্যদ্রব্য আমদানি করতে পারতো। এর ফলে খুচরা বাজারের জন্য অনেক বিকল্প সরবরাহকারী ছিল। দেশের সিন্ডিকেটের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে চাল থেকে শুরু করে ব্রয়লার মুরগি, ডিম, আদা–রসুন, চিনি ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যাদি বাড়তি দামে ক্রেতাদের ক্রয় করতে হয়। এমনকি মাছ ও মাংসের (গরু, মহিষ ও খাসি) দাম ক্রেতাদের নাগালের বাইরে। শুধু তাই না, শাক–সবজির দামও উর্ধ্বগতিতে। উল্লেখ্য যে, ভারতে চিনি থেকে শুরু করে সকল পণ্যদ্রব্যের দাম তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশের চেয়ে দাম অনেক কম। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এছাড়া দেশে যে সকল পণ্যের দাম সবচেয়ে বেশি সে সকল পণ্যদ্রব্যাদি ক্রয় থেকে বিরত থাকবে হবে এবং অতি প্রয়োজন ছাড়া পণ্যদ্রব্য ক্রয় না করাই শ্রেয়। যাতে গুটিকয়েক স্টকহোল্ডাদের মধ্যে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ না থাকে। সে দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। বাজার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন যে, মূল্য স্বাভাবিক করতে সরকারের পক্ষ থেকে নানা মুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাও কোনো সুফল আসছে না বরং সমাজের একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বছরের ব্যবধানে প্রায় সব পণ্যের মূল্য দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়েছে। কিন্তু বছরের পর বছর অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকলেও কার্যকর অর্থে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে প্রতিবছরই ক্রেতাকে জিম্মি করে সিন্ডিকেট চক্রটি নিত্যপণ্যের কৃত্রিম মূল্য বাড়িয়ে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এদিকে গত বছরের আগষ্ট মাসে জ্বালানি তেলের দাম এক ধাক্কায় ৪২ থেকে ৫২ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। যা একটি দেশের জন্য কল্পনাতীত বলা যায়। এর কারণে পণ্য পরিবহণ, গণপরিবহণের ভাড়া এবং সব ধরনের সেবার দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি পায়। এছাড়া ৩ মাসের ব্যবধানে বিদ্যুতের দাম তিন দফায় ৫ শতাংশ করে ১৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। আর দুই দফায় বিভিন্ন খাতে গ্যাসের দাম বেড়েছে প্রায় শতভাগ। তাছাড়া গত এক বছরের ব্যবধানে নিত্য ব্যবহার্য পণ্য ও সুপেয় পানিসহ সরকারি–বেসরকারি সব ধরনের সেবার দাম বৃদ্ধি করেছে। বাজার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মনিটরিং না থাকার কারণে সহজেই অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বৃদ্ধি করে ভোক্তার পকেট খালি করছে। এখন পর্যন্ত কোনো ধরনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা বারবার ক্রেতাদের জিম্মি করে অতি সহজে অতি মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে।
বিশেষ করে এখনই সরকারকে যুগোপযোগী ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থাৎ দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান যেমন–টিসিবি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাছাড়া কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজারে দ্রব্যমূল্যের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটানো দুষ্কৃতকারীদের মূলোতপাট করতে হবে। এক্ষেত্রে বাজার তদারকি ব্যবস্থা নতুনভাবে আরও ঢেলে সাজিয়ে অভিযান পরিচালনা করতে হবে। উল্লেখ্য যে, দেশের কর্তা ব্যক্তিদের অভিমত যে স্টকহোল্ডাদের বেশি চাপ প্রয়োগ করলে পণ্যদ্রব্যের বাজার স্থবির করে দিতে পারে। এতে আমাদের দেশের সাধারণ জনগণ অসুবিধার মধ্যে পড়বে। তবে কি আমরা কালোবাজারী, অতিরিক্ত মুনাফাভোগী এবং সিন্ডিকেট চক্রের কাছে অসহায়। দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে অবৈধভাবে অধিকহারে পণ্য মজুত করতে না পারে। সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। এখন সময় এসেছে ক্ষুদ্র আমদানিকারকদের নতুন করে পণ্যদ্রব্য আমদানি করে ব্যবসার সুযোগ করে দেয়া। এমনকি আমদানি নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। দেশে সংরক্ষণের অভাবে বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্যদ্রব্য নষ্ট হয়। তবে পচনশীল খাদ্যদ্রব্য যথাযথ সংরক্ষণের জন্য উপজেলাভিত্তিক আরও বেশি হিমাগার স্থাপন করতে হবে। ফলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চাপ কমাতে এটি অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে সরকারের পাশাপাশি আমাদেরও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। এক্ষেত্রে অপচয় রোধ করার পাশাপাশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা মোতাবেক এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। মূলত আমরা যদি আমাদের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদনে সচেষ্ট হই। তবে একদিকে যেমন আমদানির প্রবণতা কমে আসবে, ঠিক তেমনি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যও নস্যাৎ হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সামগ্রিক বিষয় আমাদের হাতে থাকে না বটে। কিন্তু আমরা যদি সচেতন হই। তবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম উর্ধ্বগতি থেকে নিম্নগামী হতে বাধ্য।
লেখক: গ্রন্থাগার বিভাগের প্রধান, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম