রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা বনগ্রাম এলাকায় নিজের দুই সন্তান নিয়ে থাকেন প্রতিবন্ধী স্বপ্না দাশ। দুই পা নেই, হারিয়েছেন স্বামীকেও। সংসারে অভাব তার নিত্য সঙ্গী। তবুও থেমে নেই স্বপ্নার জীবন যুদ্ধ। সড়কের পাশে ঝুঁকি নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে সবজি বিক্রি করে চালান সংসার। প্রতিবছর বেগম রোকেয়া দিবস আসে যায়। নারী উন্নয়নে নেয়া হয় কত কার্যক্রম। কিন্তু স্বপ্নার খবর রাখেনি কেউ। এই নিয়ে স্বপ্নার মনে অবশ্য কোনো আক্ষেপও নেই। তিনি কারো করুণা নয় বরং বেঁচে থাকতে চান আত্মনির্ভরশীল হয়েই।
শুক্রবার সকাল ১০টা। প্রতিদিনের মত চট্টগ্রাম–কাপ্তাই সড়কের রাঙ্গুনিয়ার লিচু বাগান বনগ্রাম মূল সড়কের পাশে বিভিন্ন শাকসবজি নিয়ে বসে আছেন স্বপ্না দাশ। এসময় কথা হলে তিনি জানান, কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৮ সালের মে মাসে চন্দ্রঘোনা কুষ্ঠ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। স্বপ্নার বাড়ি রাউজান উপজেলার নোয়াপাড়া মাস্টারদা সূর্য সেন পল্লীতে। হাসপাতালে চিকিৎসা চলছিল ভালোমতোই। কিন্তু নিয়তি পক্ষে ছিল না। কুষ্ঠরোগের কারণে ক্ষত দেখা দেওয়ায় ২০০৪ সালে চিকিৎসকের পরামর্শে তার দুই পা কেটে ফেলতে হয়। এর মধ্যেই ভালোবেসে ফেলেন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক কুষ্ঠ রোগী জ্যোতিষ চাকমাকে। ১৯৯৯ সালে তাদের বিয়ে হয়। এ দম্পতির ছেলে আকাশ চাকমা পড়াশোনা করেছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। পরে বাসচালকের সহকারীর কাজ নেয়। মেয়ে পূর্ণিমা চাকমা চন্দ্রঘোনা বি এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী।
জীবন সংগ্রামী এই নারী বলেন, বিয়ের পর থেকে হুইলচেয়ারে করে স্বামীর সঙ্গে বনগ্রাম এলাকায় কাঁচাবাজারে শাকসবজি বিক্রি করতেন স্বপ্না। ২০২০ সালের ১১ এপ্রিল হঠাৎ স্বামী মারা গেলে দুই সন্তান নিয়ে বিপদে পড়ে যান তিনি। এরপর অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়ে চলছিল তার জীবন। পরে স্বামীর পথ অনুসরণ করে হুইল চেয়ারে বসে একাই সবজি বিক্রি শুরু করেন তিনি।
সবজি বিক্রি করে কেমন চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে সবজি বিক্রি করে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা আয় হতো। এখন বিক্রেতা বেড়ে যাওয়ায় প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। সময়মতো পাইকারদের কাছ থেকে পণ্য আনতে পারেন না। অন্যদিকে বাজারে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় আগের মত বেচাবিক্রিও হচ্ছে না। আয়ের সঙ্গে সংসারের ব্যয়ের হিসাব মিলছে না। ছেলেও ঠিকমতো কাজ করতে পারছে না। মেয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বাসা ভাড়ার টাকা দিতে পারেননি চার মাস। বিদ্যুৎ বিলও বাকি। টানাটানির সংসারে অসহায় হয়ে পড়েছেন। প্রতিদিন সবজি বিক্রি করে যে টাকা
আয় হয়, তা দিয়ে কষ্টের সংসার কোনোরকম চলছে বলে জানান তিনি।
স্বপ্না জানান, ছেলেকে না পারলেও মেয়েকে লেখাপড়া করাবেন। এ জন্য নিজের সবটুকু সামর্থ্য দিয়েই হুইলচেয়ারে বসে হলেও সবজি বিক্রি করছেন। তবে নিজের দুপায়ের চিকিৎসা অর্থের অভাবে ঠিকমতো হচ্ছে না। কুষ্ঠ হাসপাতাল বন্ধের উপক্রম হওয়ায় তারও ব্যয়বহুল চিকিৎসা অনেকটা বন্ধ।
চন্দ্রঘোমা–কদমতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইদ্রিছ আজগর বলেন, স্বপ্না সবাইকে জানান দিয়েছেন, পা না থাকলেও পরিশ্রম করে বেঁচে থাকা যায়। তাকে সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান স্বজন কুমার তালুকদার বলেন, স্বপ্না দুই পা হারানোয় ভিক্ষাবৃত্তি করে চলতে পারতেন। এমন সংগ্রামী নারীদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাকে যেন সরকারি–বেসরকারি সহযোগিতা করা যায়, সেই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।












