একুশে আমার অহংকার। একুশে মানে মাথা নত না করা। মাথা নত না করার শিক্ষাটা পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকেই। উনি আজ থেকে শতবর্ষ আগে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২৩ সালে পাস করেন।
একুশের সঙ্গে আমাদের পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫২ সাল। বাংলার দামাল ছেলেরা মাতৃভাষার জন্যে শহীদ হলেন। তাঁদের রক্তে রঞ্জিত হলো রাজপথ। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের উদ্দেশ্যে প্রথম কবিতাটা লেখেন কবি মাহবুব–উল আলম চৌধুরী। তিনি চট্টগ্রামের মানুষ। কবিতার নাম– ‘কাঁদতে
আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ঢাকায় গোলাগুলি এবং প্রাণহানির কথা জানতে পেরে পরদিন লালদীঘির মাঠে প্রতিবাদ সভার ডাক দেয়া হলো। এই কবিতাটি সেখানে পাঠ করা হবে। এবং সম্ভব হলে এই কবিতাটি ছাপিয়ে বিলি করা হবে।
সেই সময় আমরা কোহিনূর প্রেসের দোতলায় থাকতাম। আমার বাবা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ কিংবা জেল–জরিমানার ঝুঁকির কথা জেনেও কবিতাটা আমাদের প্রেসে ছেপেছিলেন। যা পরদিন লালদীঘি মাঠে পঠিত হয়। বিলি করা হয়েছিল ছাপানো কপি। এর জন্য পুলিশ হানা দিয়েছিল
কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে। প্রেসের ম্যানেজার ছিলেন আমার দাদা সম্পর্কের দবির আহমদ চৌধুরী। তিনি বললেন, আমার সাহেব এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না। আমি কিছুই না বুঝে কবিতাটা ছেপেছি। আপনারা নিলে আমাকে নিতে পারেন। পুলিশ তখন তাকেই ধরে নিয়ে গেল। পরে মামলা হলো। দবির সাহেবের সাজা হলো। ছয় মাস জেল খাটার পর ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসলে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
যে মেশিনে কবিতাটি ছাপা হয়েছিল, সেটি কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে সংরক্ষণ করা আছে। এ ইতিহাস আমি আগেও বলেছি। এবার অন্য এক প্রসঙ্গে যাব।
আজাদী প্রকাশিত হয় ১৯৬০ সালে। বাবা মারা যান ১৯৬২ সালে। এরপর পত্রিকার দায়িত্ব পড়ে আমার ওপর। জনাব খালেদ সাহেবকে সম্পাদক করে পত্রিকা চালু রাখলাম।
১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের ব্যবসা বাণিজ্যের মূল ঘাঁটি ছিল করাচি। সব বড় বড় ব্যবসায়ী করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যবসা পরিচালনা করতেন। এমনকি চন্দ্রঘোনার কর্ণফুলি পেপার মিলের কাগজ প্রথমে করাচি যেত এবং সেখান থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হত।
যেহেতু তখন করাচি ব্যবসার কেন্দ্রস্থল – এবং সব বড় বড় কোম্পানি ও বহুজাতিক সংস্থার প্রধান কার্যালয় ছিল করাচিতে। তাই দৈনিক পত্রিকার মূল ভিত্তি বিজ্ঞাপনও আসত সেখান থেকেই।
সে সময় করাচি থেকে এজেন্সি যে বিজ্ঞাপন পাঠাতো – তা আসত পিআইএ’র বিমানে। এ বিজ্ঞাপন পেতে যেমন দেরি হত, বিল পেতেও দেরি হত। কারণ বিল যেত বিমানে, চেক আসত রেজিস্ট্রার্ড ডাকে। ব্যাংকে চেক জমা দেওয়ার পর কালেকশনে যেত। অর্থাৎ চেক কালেকশনেই সময় লেগে যেত ১/২ মাস। তাই ঠিক করলাম করাচিতে একটি ব্যাংক হিসাব খুলতে হবে। এটা করলে টাকাটাও তাড়াতাড়ি পাওয়া যাবে।
এর জন্য ১৯৬২ সালে করাচি গেলাম। করাচিতে আমাদের অফিস দেখাশোনা করতেন মঈনুদ্দীন কাউলাস নামে এক ভদ্রলোক। উনি আমাকে সেই সময়কার সব চাইতে বড় ব্যাংক– হাবিব ব্যাংকে নিয়ে গেলেন। ব্যাংক হিসাব খোলার ফরম ছিল। সব পূরণ করার পর যথারীতি আমি যেভাবে বাংলায় দস্তখত করি সেটা করে দিলাম।
অনেকক্ষণ পর সেই দরখাস্ত ফেরত আসলো। বলা হলো– বাংলায় দস্তখত চলবে না। হয় উর্দু, না হয় ইংরেজিতে করতে হবে। আমিও বাংলা ছাড়া করবো না। প্রায় ৮/১০ ব্রাঞ্চে গেলাম। সকলেরই এক কথা – হয় ইংরেজি, না হয় উর্দু।
শেষে একজন বললেন, শহর কেন্দ্র থেকে একটু দূরে আছে ইউনাইটেড ব্যাংক। সেখানে একজন বাঙালি অফিসার আছেন। উনি হয়ত আপনাকে কিছু সাহায্য করতে পারেন।
খোঁজাখুঁজির পর সেই বাঙালি অফিসারকে পেলাম। উনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানালেন, হিসাব খোলার জন্য বাংলায় স্বাক্ষর করা ফরম উনারা নেবেন। সম্ভবত উনি উনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বুঝিয়েছেন – আমি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানি না।
যাক, আমার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে – তাই আমি ধন্য।
তবে দুঃখের বিষয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর করাচি গিয়ে সেই অ্যাকাউন্টের খবর নিলাম। সেখানে প্রায় ২০/৩০ হাজার টাকা ছিল বলে মনে হয়। ব্যাংক জানাল, বাংলদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই আমার অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে তাদের স্টেট ব্যাংক সব টাকা নিয়ে গেছে। এগুলো ফেরত পাওয়ার কোনো আশা নেই।
বিশ্বাস করুন, এই কথা শোনার পর কোনো দুঃখ হয়নি। কারণ তখন মনে হয়েছে, বাংলার দামাল ছেলে রফিক, জব্বার, বরকত বুকের রক্ত দিয়েছে মায়ের ভাষার জন্যে। আমি কেন দুঃখ করব বাংলায় দস্তখত করে ব্যাংক হিসাব খুলে কয়েক হাজার টাকা হারানোর জন্য।
ধন্য আমার মায়ের ভাষা। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যই আজীবন চেষ্টা করেছি। এ ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্যই আমৃত্যু চেষ্টা করে যাব। এ ভাষায় কথা বলতে আমি গর্ববোধ করি। একুশে আমার অহংকার। একুশে মানে মাথা নত না করা।
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক আজাদী