জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সাত দিন ধরে লড়লেন গাউসুল আজম, কিন্তু হার মানতে হলো অগ্নিনির্বাপক বাহিনীর এই কর্মীকে। এসএসসি পাস করে ‘ফায়ার ফাইটার’ হিসেবে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সে যোগ দিয়েছিলেন সাতক্ষীরার গাউসুল। ইচ্ছা ছিল পদোন্নতি নিয়ে ‘লিডার’ হওয়ার, সেজন্য পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু সেই স্বপ্নের অকাল মৃত্যু ঘটল। গত ৪ জুন রাতে বিএম কন্টেনার ডিপোতে আগুন লাগলে তা নেভাতে সহকর্মীদের সঙ্গে সীতাকুণ্ড ফায়ার স্টেশন থেকে ছুটে গিয়েছিলেন গাউসুল (২২)। সেখানে বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ হলে চট্টগ্রাম সিএমএইচে নেওয়া হয়েছিল তাকে। অবস্থার অবনতি দেখে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে ঢাকায় এনে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ট্রিটমেন্ট ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে। খবর বিডিনিউজের।
দেহের ৮০ ভাগজুড়ে আগুনের জখম নিয়ে আইসিইউতে ছিলেন গাউসুল। সেখানেই গতকাল ভোররাতে জীবন থেকে বিদায় নেন তিনি। শুরু থেকেই তার অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল বলে জানিয়েছেন বার্ন ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।
দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে গাউসুল আজমের মরদেহ নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন তার মামাত ভাই রাসেল হোসেন, ভগ্নিপতি মিজানুর রহমান ও সহকর্মীরা। টানা সাত দিন সবকিছু ভুলে গিয়ে গাউসুল আজমের পাশে থেকেছেন মিজানুর। শ্যালকের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তিনি।
গাউসুলের পরিবার বলতে আছে তার বৃদ্ধ বাবা-মা, বোন-ভগ্নিপতি, স্ত্রী কাকলী খাতুন এবং ৬ মাস বয়সী সন্তান। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন গাউসুল। শেষ গোসলের পর গাউসুলের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গ থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে নেওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে লাশ নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হন স্বজনরা।
গাউসুলের বাড়ি সাতক্ষীরার মাগুরা গ্রামে হলেও তার পরিবার এখন যশোরের মনিরামপুরে থাকেন। লাশ সেখানেই দাফন হবে বলে পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন।
মামাত ভাই রাসেল জানান, গাউসুলের স্বপ্ন ছিল একদিন তিনি ফায়ার ফাইটার থেকে লিডার হবেন। সেজন্য তিনি নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুতও করছিলেন। পরিবারের হাল ধরতে এসএসসি পাসের পরই গাউসুলকে চাকরিতে ঢুকতে হয়েছিল জানিয়ে রাসেল বলেন, ও ছাড়া কেউ তো নাই ইনকাম করার। গাউসুল এসএসসি পাসের পর চাকরিতে ঢুইকা পদোন্নতির জন্য আবার উন্মুক্ততে ভর্তি হইয়া ইন্টার পাস করছে। কারণ ও চাইছিল লিডার হইবে। লিডার হওয়ার জন্য ইন্টার পাশ করা লাগে।
মর্গে সামনে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের ওয়ারহাউজ ইন্সপেক্টর ইউনুস আলী জানান, লিডার হওয়ার জন্য শুধু এইচএসসি পাস করলেই হয় না, ১৪-১৫ বছরের অভিজ্ঞতাও লাগে। তিনি বলেন, আমরা ভাবছিলাম সুস্থ হয়ে যাবে। সেজন্য গাউসুলের ওয়াইফকেও নিয়ে আসি নাই আমরা। ওয়াইফ আসলে ছোট বাচ্চাসহ তার কন্ডিশনটা খারাপ হয়ে যাবে। ভাবছিলাম রিকভারি করলে নিয়ে আসব, কিন্তু সে তো আর হলো না।
মাত্র দেড় বছর আগেই বিয়ে করেছিলেন গাউসুল। এই বছরই সন্তানের মুখ দেখেন তিনি। চাকরিতে থাকলে লিডার হওয়ার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ গাউসুলের ছিল। কিন্তু বিএম ডিপোতে আগুনে তা আর হলো না। ওই কন্টেনার ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন কর্মী সেদিনই নিহত হন। এক ঘটনায় এত প্রাণহানি আর কখনও এই বাহিনীতে ঘটেনি। অভিযোগ রয়েছে, ডিপোতে যে রাসায়নিক রয়েছে, তা সেখানকার কর্তৃপক্ষ না জানানোয় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের প্রাণ সংকটে পড়ে।
ইউনুস বলেন, এই ব্লাস্ট যদি ঢাকায় হইতো, তাইলে আপনার সামনে আজ আমি হয়ত দাঁড়াতে পারতাম না। ওটা রিমোট এরিয়া হওয়ায় ওখানে অফিসাররা কম থাকে। আর ঘটনার দিন ওখানের অফিসার ইনচার্জ ট্রেনিংয়ে ছিলেন। যদি উনি থাকতেন, সবার আগে হয়ত উনি মারা যেতেন, কিন্তু আল্লাহ তাকে বাঁচাইছে। তারপরও তো লিডার মারা গেছে ২ জন।
তিনি আরও বলেন, কন্টেনার ব্লাস্ট হওয়ার কারণে আশেপাশে যা ছিল, সব শরীরে ঢুকছে। কংক্রিট, লোহার টুকরা, কাঠের টুকরা, সব ঢুকছে। আর কেমিকেলের ধোঁয়া ইনহেল করলে তো ভেতরটা এমনি পুড়ে যায়।
ইউনুস জানান, গাউসুলের চিকিৎসার ব্যয় বহন করেছে সরকার, কিন্তু এখন দাফন-কাফনের সমস্ত ব্যয় বহন করছে ফায়ার সার্ভিস। তবে তিনি বলেন, বিএম ডিপো থেকে প্রাণ হারানো ফায়ার ফাইটারদের পরিবারপ্রতি ১৫ লাখ টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও তা পাওয়া যায়নি।