একটি মাছেই হওয়া যায় কোটিপতি, যদি…

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার | সোমবার , ১১ মার্চ, ২০২৪ at ৮:০৬ পূর্বাহ্ণ

সাগরের সোনা’ নামে পরিচিত কালো পোয়া। বাজারে এক মণ ওজনের একটি কালো পোয়ার দাম প্রায় ১ কোটি টাকা। আর এই ধরনের মাত্র একটি মাছ পেলেই রাতারাতি ভাগ্য বদলে যায় জেলেদের। এয়ার ব্লাডার বা বায়ুথলি এ মাছটিকে করেছে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান। কালো পোয়া ইংরেজিতে লার্জফিন ক্রোকার বা ব্ল্যাক ক্রোকার নামে পরিচিত।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান জানান, এয়ার ব্লাডার বা বায়ুথলির কারণেই এ মাছটি অত্যধিক মূল্যবান। এই মাছের বায়ুথলি (এয়ার ব্লাডার) দিয়ে বিশেষ ধরনের সার্জিক্যাল সুতা তৈরি হয়। এই মাছের চামড়া দিয়ে তৈরি হয় জেলাটিন। জেলাটিন হল একটি প্রোটিন যেটি পোপা মাছের বায়ুথলি ছাড়াও গরু ও শূকরের কোলাজেন থেকে তৈরি হয়। এটি সাধারণত ক্যাপসুল, প্রসাধনী, মলম এবং খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জেলাটিন গ্রহণ করলে শরীরে কোলাজেনের উৎপাদন বাড়তে পারে। কোলাজেন এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান যেটি তরুণাস্থি, হাড় ও ত্বক তৈরি করে।

তিনি বলেন, এই মাছ আকারে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা ও ওজনে ৪৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। স্ত্রী মাছের চেয়ে পুরুষ মাছের বায়ুথলির দাম হয় অনেক বেশি। এ মাছের পাখনা এবং আঁশও রপ্তানি হয়। ড. শফিক বলেন, সাধারণত ছোট পোপা মাছে বায়ুথলি পাওয়া যায় না। ওজনে বড় হলেই কেবল বায়ুথলি পাওয়া যায় এবং দামে বিক্রি করা যায়। এ মাছের আকার যত বড় হয়, এর ভেতরের বায়ুথলিও তত বড় হয়। আকারের উপর ভিত্তি করে জ্যামিতিক হারে বাড়ে এর মূল্য। এ মাছের বায়ুথলি বাংলাদেশ থেকে সাধারণত হংকং, থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে রপ্তানি করা হয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ওয়াহিদুল আলম বলেন, কালো পোয়া মাছটি ইংরেজিতে ব্ল্যাক পমফ্রেট নামে পরিচিত। এর বৈজ্ঞানিক নাম জনিকাস ম্যাক্রোপথেরাস। মাছটি ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় পাওয়া যায়। বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী, সোনাদিয়া ও সেন্টমার্টিনের আশেপাশে মাছটির বিচরণ লক্ষ্য করা যায়।

কক্সবাজার শহরের ফিশারীঘাটস্থ মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির পরিচালক জুলফিকার আলী বলেন, গত ৪ মার্চ টেকনাফে একটি ১৮ কেজি ওজনের কালো পোয়া ধরা পড়ে, যেটির বায়ুথলি বিক্রি হয়েছে ২ লাখ ৪ হাজার টাকায়। আর মাছটি যদি ওজনে এক মণ হত, তবে এর বায়ুথলির দাম হত কমপক্ষে এক কোটি টাকা।

এর আগে গতবছর ২২ ডিসেম্বর কক্সবাজারের মহেশখালীর উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরে এক জালে ধরা পড়ে ৬ থেকে ১০ কেজি ওজনের ১৫৯টি কালো পোপা। ধলঘাটা ইউনিয়নের সরিতলা এলাকার মোজাম্মেল বহাদ্দারের ট্রলারে মাছগুলো ধরা পড়লে কূলে আনার পর মাছগুলোর দাম ২ কোটি টাকা হাঁকা হয়। ৯ অক্টোবর সেন্টমার্টিনের উপকূলবর্তী বঙ্গোপসাগরে স্থানীয় আবদুল গণির ট্রলারে ১১৫ কেজি ওজনের ১০টি কালো পোপা মাছ ধরা পড়ে। আবদুল গণির জালে ২০২২ সালের নভেম্বর মাসেও ৫৭ কেজি ওজনের দুইটি পোপা মাছ ধরা পড়েছিল, যা ১৭ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। তার আগে ২০২০ সালের নভেম্বরেও একটি কালো পোপা ধরা পড়েছিল, যেটি বিক্রি হয় ৬ লাখ টাকায়। আর ২০১৮ সালের ১৪ নভেম্বরেও ৩৪ কেজি ওজনের একটি পোপা মাছ ধরা পড়ে। গতবছর ১৪ জুলাই টেকনাফের সাবরাং এর উপকূলবর্তী সাগরে ধরা পড়ে ৩০ কেজি ওজনের একটি কালো পোপা। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিবপাড়ার সৈয়দ আহমদের ট্রলারে সেই পোপা মাছটি ধরা পড়ার পর কয়েক হাত ঘুরে সেটি ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে সেন্টমার্টিনে ২৩ কেজি ১০০ গ্রাম ওজনের, ২৪ কেজি ৯০০ গ্রাম ওজনের ও ৩০ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৩টি পোপা মাছ ধরা পড়ে। একই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর শাহপরীর দ্বীপের মোহাম্মদ ইসমাঈলের ফিশিং ট্রলারের জালে একটি ৩৩ কেজি ওজনের পোপা মাছ ধরা পড়ে। এরআগে একই বছরের ১৯ এপ্রিল টেকনাফের মিস্ত্রিপাড়ায় ধরা পড়ে ২৭ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের কালো পোপা। ২০২১ সালের ১৩ নভেম্বর টেকনাফে এফবি সালেহ আহমদ ফিশিং ট্রলারে ধরা পড়ে ৩২ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের একটি কালো পোপা মাছ। এরআগে একই বছরের ৮ মার্চ শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিম পাড়াসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে ৩৬ কেজি ৭০০ গ্রাম ওজনের একটি রূপালি পোপা বা সিলভার পমফ্রেট ধরা পড়ে, যেটি ২ লাখ ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক ড. জুলফিকার আলী বলেন, বঙ্গোপসাগরে অন্তত ১৫ প্রজাতির পোপা মাছ শনাক্ত হয়েছে। এরমধ্যে কালো পোয়া মাছটি আকারে সবচেয়ে বড় হয়। এই মাছটি সংরক্ষণের মাধ্যমে দেশের সুনীল অর্থনীতিতে নতুন দুয়ার খুলতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহাঁটতে গিয়ে খুন বৃদ্ধা, দুই যুবকের মৃত্যুদণ্ড
পরবর্তী নিবন্ধঅধিগ্রহণের ভূমিতে দখলের প্রতিযোগিতা