চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে এই সড়ক দিয়ে যাতায়াতকারীরা আতংকের মধ্যে থাকেন। দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অপ্রশস্ত সড়ক, বিপজ্জনক বাঁক, বেপরোয়া গতি, ওভারটেকিং, অপ্রশিক্ষিত চালক, লবণ পানিতে মহাসড়ক পিচ্ছিল, গাড়ির এলইডি হেডলাইটের আলো, মহাসড়কে নিষিদ্ধ ছোট যানবাহন চলাচল, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত ওজন নিয়ে চলাচল ও সড়কে দুই পাশে অসমান অংশসহ কয়েকটি কারণে এই সড়কে দুর্ঘটনা ঘটছে বেশি। বিশেষ করে মধ্যরাত ও ভোরের দিকে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে।
জানা যায়, গত ৫ এপ্রিল ভোরে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে সদর ইউনিয়নের ফয়েজ শফি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে ওভারটেক করতে গিয়ে রড বোঝাই একটি ট্রাক সড়কের পাশে একটি ধাক্কা দেয়। এতে চালক ও সহকারী আহত হন। গত ৭ এপ্রিল মহাসড়কের আমিরাবাদ ইউনিয়নের বার আউলিয়া কলেজ গেট এলাকায় দুটি কাভার্ডভ্যানের মুখোমুখি সংঘর্ষে এক চালক গুরতর আহত হয়েছেন। গত ১৮ এপ্রিল একই ইউনিয়নের তজু মুন্সির গ্যারেজ এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের সাথে মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে মোহাম্মদ নুরু ছালাম (৪২) নামে এক চালক গুরতর আহত হয়েছেন। গত ২০ এপ্রিল দিনগত রাতে মহাসড়কের চুনতি জাঙ্গালিয়া এলাকায় যাত্রীবাহী বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সাথে ধাক্কা দেয়। এতে ৩ জন ঘটনাস্থলে নিহত ও ১০ জন আহত হয়েছেন। এছাড়া গত ২১ এপ্রিল দিনগত রাত ২টার দিকে একই এলাকায় যাত্রীবাহী বাসের সাথে সিমেন্ট বোঝাই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে মো. রিয়াদ (২৫) নামে বাসে সুপারভাইজার আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা জানায়, গত দুই মাসে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়া অংশে ছোট–বড় প্রায় অর্ধশত দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে অনেকে হতাহত হয়েছেন। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্তকরণসহ দুর্ঘটনা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ কামনা করেছেন সচেতন মহল।
ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক : চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে রয়েছে বহু ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। এর মধ্যে শুধু লোহাগাড়ায় রয়েছে প্রায় ১৫টি বাঁক। একদিকে অপ্রশস্ত সড়ক, অন্যদিকে মহাসড়কে ঘন ঘন বাঁকের কারণেও প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনা ঘটছে। এছাড়া সড়কের দুই পাশে রয়েছে অনেকগুলো হাট বাজার। এই হাটবাজারে যানজটের কারণে বিভিন্ন সময় মহাসড়কের সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়া সদর বটতলী স্টেশন, পদুয়া তেওয়ারীহাট, আধুনগর খানহাট বাজার ও চুনতি বাজার এলাকায় প্রায় সময় যানজট লেগেই থাকে।
মূল সড়কের সাথে দুই পাশের দূরত্ব বৃদ্ধি : চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক প্রতিবছর সংস্কারের ফলে মূল সড়কের সাথে দু’পাশের দূরত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূল সড়ক সংস্কারের পর দু’পাশের অসমান অংশ মাটি দিয়ে ভরাট করে দেয়ার কথা বলে আসছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কাজের বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। ফলে মহাসড়কের দু’পাশে অসমান অংশ হয়ে উঠেছে বিপদজ্জনক। যার কারণে প্রায় সময় ঘটছে দূর্ঘটনা। জানা যায়, মহাসড়কের মূল অংশের সাথে দু’পাশের অসমান অংশের দূরত্ব দেড় থেকে দুই ফুট পর্যন্ত উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার অনেকস্থানে দূরত্ব আরো বেশী। মূল সড়কে উঠা–নামার দু’পাশের অসমান অংশই হয়ে উঠেছে বিপদজ্জনক। মোটরসাইকেল, সিএনজি অটোরিক্সা, ব্যাটারিচালিত রিক্সাসহ মালবোঝাই ভারী যানবাহনও মূল সড়কের দু’পাশের অসমান অংশের কারণে দূর্ঘটনার শিকার হয়। হচ্ছে।
লবণ পানিতে সড়ক পিচ্ছিল : লবনবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত পানিতে পিচ্ছিল হচ্ছে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক। ফলে বিপদজনক এই মহাসড়কে প্রতিদিন ঘটছে দূর্ঘটনা। লবনবাহী গাড়িতে জিইওট্যাক্স (মোটা তেরপাল) ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা সঠিকভাবে মানছেন না। এতে লবনবাহী ট্রাক থেকে নিঃসৃত হচ্ছে পানি। জানা যায়, এ মৌসুমে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী, উখিয়া, কুতুবদিয়া, চকরিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় লবন উৎপাদিত হয়। নৌপথ ও স্থল পথে এসব লবন দেশের বিভিন্নস্থানে প্রেরণ করা হয়। চট্টগ্রামের মাঝিরঘাট ও পটিয়া ইন্দ্রপুল এলাকায় লবন পরিশোধনাগার রয়েছে। এসব স্থান ছাড়াও ঢাকা, নোয়াখালী, ঝালকাটি, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে লবন পরিশোধনাগার রয়েছে। নৌপথে পরিবহণ খরচ বেশী হওয়ায় মূলত: সড়ক পথে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানে করেই এসবস্থানে লবন পরিবহন করা হয়। নিয়মানুযায়ী লবনবাহী গাড়িতে জিইওট্যাক্স ব্যবহার না করার ফলে পুরো রাস্তায় পানি চুয়ে পড়ে। এছাড়া মহাসড়ক হয়ে বিভিন্ন স্থানে পরিবহণের সময় কাঁচা মাটি পড়ে আস্তরণ সৃষ্টি হয়। রাতে লবন নিঃসৃত পানি ও কাঁচা মাটি রাস্তায় আঠাল আস্তরণ সৃষ্টি করে। ফলে চলমান গাড়ি ব্রেক কষলেই আঠাল আস্তরণের স্পর্শে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এতে দূর্ঘটনার সৃষ্টি হয়। প্রতিদিন মহাসড়কের কোথাও না কোথাও সড়ক দূর্ঘটনা ঘটছে। হচ্ছে প্রাণহানী। আবার অনেকে আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করছেন। এছাড়া লবনবাহী গাড়ি থেকে নিঃসৃত পানির কারণে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
এলইডি হেডলাইটের আলো : মহাসড়কে চলাচল করা ছোট–বড় প্রায় গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে এলইডি লাইট। এই লাইটের আলো চোখে পড়লে সামনে আর কিছু দেখা যায় না। চোখ দিয়ে কিছুক্ষণ ঝাপসা দেখা যায়। যার ফলে সন্ধ্যার পর থেকে মহাসড়কে গাড়ি চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। মহাসড়কে দূর্ঘটনার বিভিন্ন কারণের মধ্যে এটিও অন্যতম।
দুর্ঘটনা প্রবণ এলাকা জাঙ্গালিয়া : চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে সবচেয়ে বেশি দূর্ঘটনা ঘটে লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়া এলাকায়। এটি সড়ক দূর্ঘটনার হট স্পট হিসেবে পরিচিত। ওইস্থানে সড়কের দুই পাশে ঘন বনাঞ্চল, ঝুঁকিপুর্ণ বাঁক ও ঢালু রাস্তার কারণে প্রায় সময় দূর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজার আসেন পর্যটকরা। দূর–দূরান্ত থেকে আসা চালকদের এই সড়কের ব্যাপারে অভিজ্ঞতা না থাকাও দূর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।
নিরাপদ সড়ক চাই লোহাগাড়া উপজেলা শাখার সভাপতি মোজাহিদ হোসাইন সাগর জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক চারলেন বা ছয়লেনে এখনো উন্নীত না হওয়া, বিপদজনক অসংখ্য বাঁক, লবণের পানির কারনে সড়কের পিচ্ছিলতা, মূল সড়কের সাথে দু’পাশের দূরত্ব বৃদ্ধি, বেপরোয়া গতি ও চালকের অদক্ষতা কারণে প্রতিনিয়ত দূর্ঘটনা ঘটছে। মহাসড়কে দূর্ঘটনা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত সেমিনার, র্যালি, লিফলেট বিতরণ করে আসছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও প্রচারনা চালিয়ে যাচ্ছি। তাছাড়া সড়কের বিপদজনক স্থান গুলোতে জনসচেতন মূলক বিলবোর্ড লাগানোর পদক্ষেপ নিচ্ছি।
দোহাজারী হাইওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) খান মুহাম্মদ এরফান জানান, অতিরিক্ত গরমে চালকের মেজাজ খিটখিটে হওয়া, অপ্রশস্ত মহাসড়ক, বিপদজনক বাঁক, বাঁকের আগে–পরে গতিরোধক না থাকা, ওভারটেকিং, অপ্রশিক্ষিত চালক, বেপরোয়া গতি, লবন পানি, রোড সাইন না থাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা চালকদের এই সড়ক সম্পর্কে ধারণা না থাকা ইত্যাদি কারণে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে দূর্ঘটনা ঘটে থাকে। হাইওয়ে থানার উদ্যোগে প্রতি মাসে চালক ও সহকারিদের নিয়ে সচেতনতামূলক সভার আয়োজন চলমান আছে। এছাড়া দূর্ঘটনারোধে বিভিন্ন সময় চালকদের মাঝে সচেতনামূলক লিফলেট বিতরণ করা হয়।
চট্টগ্রাম সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ–সহকারী প্রকৌশলী আবু হানিফ জানান, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করার কাজ চলমান রয়েছে। দোহাজারী, লোহাগাড়া ও চকরিয়ায় বাইপাস হওয়ার কথা থাকায় ওইসব স্থানে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ করে অর্থ অপচয় করতে চাচ্ছি না। তবে মৌলভীর দোকান থেকে সাতকানিয়া রাস্তার মাথায় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্ত হয়ে আসতেছে। মহাসড়কের লোহাগাড়া অংশে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক আছে, সেগুলো সোজা করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেটা পাশ হয়নি। বাঁকের অংশে সড়ক প্রশস্তকরণের কাজ চলমান আছে। এছাড়া মূল সড়কের সাথে দুই পাশের দূরত্ব বৃদ্ধির কিছু কিছু স্থানে মাটি দ্বারা ভরাট করা হয়েছিল। কিন্তু বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে ওইসব মাটি চলে গেছে। মাটির ব্যবস্থা করতে পারলে পুনরায় ওইসব স্থানে ভরাট করে দেয়া হবে।