একটি ব্যাকটেরিয়া চিংড়ি পোনার উৎপাদন কমিয়েছে ৮০ ভাগ

আহমদ গিয়াস, কক্সবাজার

ছয় বছর ধরে বাগদার হ্যাচারিতে বিপর্যয় দেশে চিংড়ি উৎপাদনও নেমেছে অর্ধেকে | শনিবার , ২৯ জুন, ২০২৪ at ৪:১৭ পূর্বাহ্ণ

একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে গত ৬ বছরে দেশের বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিসমূহের উৎপাদন কমেছে অন্তত ৮০ ভাগ। এর প্রভাবে দেশে চিংড়ি উৎপাদনও কমে প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের কাছে ধর্ণা দিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে দাবি করছেন হ্যাচারি মালিকরা।

বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি মালিকদের সংগঠন শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (শেব) সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে কক্সবাজার শহরতলীর কলাতলী সাগরপাড়ে দেশের প্রথম বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি গড়ে ওঠে। পরে কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত অন্তত ৪৫টি হ্যাচারি গড়ে ওঠে। এসব হ্যাচারি থেকে দেশে পোনা উৎপাদন হতো ২ হাজার কোটি থেকে ২২শ কোটি পর্যন্ত। এরপর গত এক যুগে কক্সবাজারে ১০টি হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেলেও সাতক্ষীরাসহ দেশের অন্যান্যস্থানে আরো ৩৫টি হ্যাচারি গড়ে ওঠে। কিন্তু হ্যাচারি বাড়লেও দেশে পোনা উৎপাদন বাড়েনি, বরং কমেছে আশংকাজনক হারে। বিশেষ করে গত ৬ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে উৎপাদন কমতে কমতে চলতি বছর ৩শ কোটিতে এসে ঠেকেছে, যা গত ২ দশকের সর্বনিম্ন। লুমিনিসেন্স নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে দেশের বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিসমূহের এই করুণ দশা বলে জানান হ্যাচারি মালিকরা।

দেশের হ্যাচারি জগতের অন্যতম পথিকৃত নিরিবিলি হ্যাচারির মহাব্যবস্থাপক সুজন বড়ুয়া বলেন, আমরা পাঁচ ধাপে ফিল্টার করে সমুদ্র থেকে হ্যাচারিতে পানি তুলি। স্যান্ড ফিল্টার, র‌্যাপিড স্যান্ড ফিল্টার, ইউভি (আল্ট্রা ভায়োলেট) ফিল্টার, কার্টিজ ফিল্টার ও ব্যাগ ফিল্টার নামের এই পাঁচ ধাপের ফিল্টার প্রক্রিয়ার পর পানি পরীক্ষা করে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসমুক্ত পাওয়া গেলেই কেবল সেই পানিতে আমরা মাদার চিংড়ি তুলি এবং ডিম ফোটাই। কিন্তু ডিম ফোটার পর পানিতে লুমিনিসেন্স ব্যাকটেরিয়ার আবির্ভাব ঘটে আর তখন কোটি কোটি পোনা আমরা ড্রেনে ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।

এতে হ্যাচারি মালিকরা প্রতিবছরই লোকসান গুণছে জানিয়ে তিনি দাবি করেন, কক্সবাজারে এমন কোনো হ্যাচারি নেই যারা লাভে আছে। একটি ব্যাকটেরিয়ার কারণে হ্যাচারিগুলো গত ৬ বছর ধরে প্রতিবছরই দেড় দুই কোটি টাকার লোকসান গুণছে। নিদেনপক্ষে ৫০ লাখ টাকার লোকসান গুণেনি এমন কোনো হ্যাচারি কক্সবাজারে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কক্সবাজারের বিশিষ্ট হ্যাচারি পোনা উৎপাদন বিশেষজ্ঞ ও মেরিন বায়োলিস্ট পলাশ খন্দকার বলেন, আমরা সকল প্রটোকল মেনে হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন করে আসছি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে লুমিনিসেন্স ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ এতই বেড়েছে যে, তা প্রতিরোধে আমরা কিছুই করতে পারছি না। এনিয়ে আমাদের গবেষণার সুযোগ নেই। তাই আমরা সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর সাহায্য চাচ্ছি।

কক্সবাজার শহরের কলাতলী মেরিন ড্রাইভের সোনালী হ্যাচারির পরিচালক মো. আলমগীর (ক্যারাটে আলমগীর) বলেন, আমরা দেশের হ্যাচারি মালিকরা গত ৬ বছর ধরে একটি ব্যাকটেরিয়ার কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) সহ সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের কাছে ধর্ণা দিয়েও আমরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না।

শ্রিম্প হ্যাচারি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (শেব) মহাসচিব নজিবুল ইসলাম বলেন, আমরা পাঁচ ধাপে ফিল্টার করে সমুদ্র থেকে হ্যাচারিতে পানি তুলি। কিন্তু বায়ুর তাপমাত্রা যখন ৩০ ডিগ্রির ওপরে ওঠে যায়, তখন সেই পানিতে লুমিনিসেন্স ব্যাকটেরিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায় এবং আমরা অসহায় হড়ে পড়ি। তিনি জানান, কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সমুদ্র তীরবর্তী পানিতেই কেবল মাদার থেকে পোনা ফোটানো যায়। ফলে কক্সবাজার ছাড়া দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদন হয় না বললেই চলে। ওরা কক্সবাজার থেকেই পোনা ফুটিয়ে নিয়ে যায়।

লুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়া হল আলোক উৎপাদনকারী ব্যাকটেরিয়া, যা মূলত সমুদ্রের পানি, সামুদ্রিক পলি, পচনশীল মাছের পৃষ্ঠে এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের অন্ত্রে থাকে। এই লুমিনেসেন্ট ব্যাকটেরিয়ার কারণে কক্সবাজারের বাগদা চিংড়ি পোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারিসমূহে উৎপাদন কমে যাওয়ায় দেশের চিংড়ি সেক্টরেও সংকটে পড়েছে। কক্সবাজার ও সাতক্ষীরাসহ দেশের উপকূলীয় এলাকার প্রায় এক লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে। কিন্তু পোনা সংকটে প্রতিবছরই চিংড়ি চাষ ও উৎপাদন কমছে। ফলে কমছে রপ্তানিও।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফিশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) তথ্যমতে, ২০১৪১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৪৪ হাজার ২৭৮ টন চিংড়ি রপ্তানি করে। ২০১৫১৬ অর্থবছরে রপ্তানি করে ৪০ হাজার ২৭৬ হাজার টন চিংড়ি, ২০১৬১৭ অর্থবছর ৩৯ হাজার ৭০৬ টন, ২০১৮১৯ অর্থবছরে তা আরো কমে ৩৩ হাজার ৩০৬ টনে নেমে আসে। এরপরের বছর ২০১৯২০ অর্থবছরে রপ্তানী হয় ৩০ হাজার ৩৬ টন, ২০২১২২ অর্থবছরে ২৪ হাজার ১০৪ টন, ২০২২২৩ অর্থবছরে চার হাজার টন কমে হয় ১৯ হাজার ৯০৪ টন, আর চলতি অর্থ বছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে নয় হাজার ৭১ টন চিংড়ি, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তিন হাজার টন কম।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) এর কক্সবাজারস্থ সামুদ্রিক ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের প্রধান ড. শফিকুর রহমান বলেন, কক্সবাজারের হ্যাচারিতে কর্মরত বিদেশি বিশেষজ্ঞরা স্থানীয়দের কাছে প্রযুক্তি হস্তান্তর করছে না। হ্যাচারি মালিকরাও যথাযথ প্রটোকল মেনে হ্যাচারিতে মাদার তুলছে না। ফলে তাদের সমস্যা হচ্ছে।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. তৌহিদ রশীদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশবিরোধী চুক্তি আড়াল করতে নানা কাণ্ড সামনে আনা হচ্ছে : রিজভী
পরবর্তী নিবন্ধভারত বিরোধীরা ফের ভুল পথে যাচ্ছে : কাদের