বেশ কয়েকদিন ধরে বিশ্বের গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম একটি বিয়ের খবরের দখলে। ভারতীয় ধনকুবের, বিশ্বের অন্যতম ধনী মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে অনন্ত আম্বানির প্রাক্বিবাহ সংবর্ধনার জমকালো আয়োজনের ছবি, ভিডিও এবং রকমারি আলোচনা চারদিক দখল করে রেখেছে। টাকা থাকলে যে কিভাবে ওড়ানো (নাকি পোড়ানো) যায় তা মুকেশ আম্বানি সাহেব দেখিয়ে দিলেন। ৫০–৬০ কোটি রূপি খরচ করে উড়িয়ে আনা হয়েছে মাত্র একজন শিল্পীকে। ৫–১০ কোটি টাকার শিল্পী এবং সেলিব্রেটি ডজনে ডজনে। কোটি কোটি রূপি ঢেলে দেওয়া হয়েছে সেলিব্রেটিদের জমায়েত করতে। বিশ্ব বাণিজ্যের অতি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের জড়ো করা হয়েছে। করা হয়েছে সম্মানিত। মুকেশ আম্বানি এবং তার পুত্র অনন্ত আম্বানির অতিথি আপ্যায়ন থেকে শুরু করে সবকিছু খুবই ভালো লেগেছে। চালচলনে সাধারণ হয়ে উনি অসাধারণ হওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে আমার মনে হচ্ছিল। কিন্তু এত এত টাকা ওড়ানোর চাকচিক্যের মাঝে উনার সাধারণ থাকার চেষ্টা কি আর শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয়েছে?
মজার ব্যাপার হলো, তাবত দুনিয়ার, এমনকি ভূটানের রাজা–রানি কিংবা আফগানিস্তানের ক্রিকেট তারকাকে নিমন্ত্রণ করলেও প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের একজন মানুষকেও ওই আসরে ডাকা হয়নি। ১৮ কোটি মানুষের এদেশের একজন মানুষও কি নেই, যাকে তিন দিনব্যাপী জমকালো ওই অনুষ্ঠানের যোগ্য মনে করা যায়!
১ হাজার কোটি রূপি নাকি খরচ হয়েছে তিন দিনে। তথ্যটা যাছাই করার সুযোগ আমার মতো চুনোপুঁটির নেই। তবে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ যেখানে প্রতি রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যায়, সেই বিবর্ণ পৃথিবীর জন্য ১ হাজার কোটি রূপি কিন্তু কম টাকা নয়। বিশ্বের কথা বাদ দিলেও যে ভারতে এমন তাক লাগানো আসর বসল সেই ভারতেই কোটি কোটি মানুষ অন্ন–বস্ত্রের অভাবে রয়েছে। স্কুলে যেতে পারে না বহু শিশু, চিকিৎসা করাতে পারেন না বহু মা। কত অভুক্ত মানুষের হাহাকার যে প্রতিদিন বাতাস ভারী করে তার ইয়ত্তা নেই। সেই বিরস ভুবনে ১ হাজার কোটি রূপি চিকচিক্য না আনলেও অনেক স্বস্তি আনতে পারত।
আম্বানি পরিবারের এমন আসরের পর অনেকেই টাটা পরিবার নিয়ে কথা বলছেন। কিন্তু আমি ভালোভাবেই জানি, দুই পরিবার দুই ধাঁচের। টাটা পরিবারের সাথে আম্বানি পরিবারের মিল কোনো সূচকেই মিলানো যাবে না। মিলানো ঠিক হবে না। টাটা পরিবারের বর্তমান কর্ণধার রতন টাটা মাটি ও মানুষের কল্যাণে বিভিন্ন সময়ে ১০২ বিলিয়ন ডলার দান করেছেন, যা আম্বানির বর্তমান মোট সম্পদের সমান। রতন টাটাজি একটি অ্যাপার্টমেন্টে বসবাস করেন। অপরদিকে আম্বানির বম্বে শহরের বাড়িটা পৃথিবীর দ্বিতীয় ব্যয়বহুল বাড়ি। ৪.৬ বিলিয়ন ডলারের চেয়ে বেশি দামের বাড়িতে ইংল্যান্ডের রানি বসবাস করেন, বামিংহাম প্যালেস। অ্যান্টিলিয়া নামের মুকেশ আম্বানির বাড়িটি বাইরে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার, চোখ ফেরাতে পারছিলাম না।
অপরদিকে টাটার বেশ কিছু কার্যক্রম কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমি নিজেকে এখনো সৌভাগ্যবান মনে করি যে, রতন টাটাজির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। কুশল বিনিময় হয়েছিল। ভারতের জামসেদপুরে টাটানগরসহ কয়েকটি স্থানে টাটার অতিথি হিসেবে ঘুরতে গিয়েছিলাম বছর কয়েক আগে। দেখেছিলাম টাটার স্টিল মিল, গাড়ি তৈরির কারখানা, পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং কয়লা খনিসহ নানা কিছু। তাদের দ্বারা উপকৃত শত–সহস্ত্র মানুষ দেখেছি। শুনেছি স্থানীয় উপজাতিসহ হাজার হাজার মানুষের কাছে টাটাজির ‘ভগবান’ হয়ে ওঠার কাহিনী।
বিদায়ের আগের দিন রতন টাটাজির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি আমাকে জেআরডি টাটার সিগনেচার করা চমৎকার একটি টাটা (টাটার টাইটান কোম্পানির নিজস্ব প্রোডাক্ট) ঘড়ি উপহার দিয়েছিলেন। উপহারটি হাতে তুলে দেওয়ার সময় তার বিনয় আমাকে সম্মোহিত করেছিল, যা আজও আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। ঘড়িটি তিনি যখন আমাকে দিচ্ছিলেন তখন তার নিজের হাতের ঘড়িটির দিকেও তাকিয়েছিলাম। সেটিও টাইটান। অপরদিকে মুকেশ আম্বানি কিংবা অনন্ত আম্বানির হাতে ১৬ কোটি টাকা দামের ঘড়ি!
রতন টাটাজির কাছ থেকে উপহার পাওয়া ঘড়িটি একদিনও আমি হাতে দিইনি। যত্ন করে তুলে রেখেছি। আমি মনে করি এমন এক মহামানবের স্মৃতিধন্য ঘড়ি হাতে দিয়ে সময় দেখার জন্য নয়, জীবনের শিক্ষা নেওয়ার জন্য বেশি জরুরি।
টাটাজির চেয়ে অনেক বেশি সম্পদ হয়তো আম্বানির হবে। কারণ তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী নীতা আম্বানির জন্মদিনে বিমান উপহার দেন। ছেলের বিয়েতে দুনিয়ার তাবত সেলিব্রেটিদের জড়ো করেন। অপরদিকে টাটা তার আয়ের বেশিরভাগই মানুষের কল্যাণে বিলিয়ে দেন। এই পার্থক্যই দুই ধনকুবেরকে দুই জগতের বাসিন্দা বানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং আম্বানির চাকচিক্য আর টাটার বর্ণাঢ্য বিষয়কে এক করা উচিত হবে না।
শুভকামনা অনন্ত–রাধিকার জন্য।