আমাদের চেতনাকে দেশপ্রেমের নতুন শপথে উজ্জীবিত করতে সময়ের আবর্তনে এসে পড়েছে ১৬ ডিসেম্বর । এ দিনটিতে আমরা নতুনভাবে উজ্জীবিত হই, দীপ্ত হই। এতদঅঞ্চলের বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি রাষ্ট্র। সহস্র কণিকা রক্ত, লক্ষ কোটি অশ্রুজল, অসংখ্য হাহাকার আর আর্তনাদের নৈবদ্যে পাওয়া আমাদের প্রিয় এ দেশ। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত ছোট একটি শব্দ ‘বাংলাদেশ’– দেখে গর্বে, আনন্দে উদ্বেলিত হই। ৭১’র আগে মানচিত্রে লেখা থাকত ‘পূর্ব পাকিস্তান’ শব্দটি। আমরা অর্জন করেছি লাল সবুজে মেশানো একটি স্বতন্ত্র পতাকা আর আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে পেয়েছি হাজার বছরের বাঙালির সারস্বত সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ ফসল বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমার ভালোবাসি’ এ অসাধারণ সঙ্গীতটি। এই সঙ্গীতের সবচাইতে প্রিয় পংক্তি ‘ও মা তোর বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন জলে ভাসি, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ আমাকে প্রাণিত করে। আমাদের শিক্ষা জীবনে স্কুল কলেজের প্রাত্যহিক সমাবেশে গাওয়া হতো ‘পাক সারজামিন সাদবাদ’ এ সঙ্গীতটি । প্রাণ খুলে গাইতে পারতাম না। গানটির মর্মকথা বুঝতে পারতাম না।
আমাদের এ অর্জন যে ঐতিহাসিক ঘটনার অনিবার্য পরিণতি তার নাম অমর একুশে। আমাদের আত্ম পরিচয়ের যে অভিজ্ঞান দিয়েছিল একুশ সে চিহ্ন ধরে আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম একাত্তরে। ভাষার জন্য, ন্যায়ের জন্য, সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের যে শিক্ষা দিয়েছিল একুশ তার চরম অভিব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফলশ্রুতিতে আমাদের বিজয়। বিজয় শব্দটি উচ্চারিত হওয়া মাত্র আমি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে আবেগ আপ্লুত হই। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ, শ্বাসরুদ্ধকারী পরিবেশ। ১৯৭১ এর ৮ ফেব্রুয়ারিতে আমি প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছিলাম গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েড কলেজ (বর্তমান হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ)। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা হলো। এপ্রিল মাসের ২৬ তারিখ আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। কিছুদিন স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পাক সেনা বাহিনী আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে ঘর–বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। অনেককে গুলি করে হত্যা করা হয়। অবস্থা যখন ভয়াবহ তখন কয়েকজন হিতৈষীর সহযোগিতায় আমরা শহরে ফিরে এলাম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া হলো। কলেজে যোগদান করলাম। তবে ছাত্র সংখ্যা শূন্যের কোঠায়। দীর্ঘ ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধে হারিয়েছি অনেক প্রিয় মুখ যাঁদেরকে জীবনের পথপ্রদর্শক হিসাবে পেয়েছিলাম। চট্টগ্রাম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দসহ অনেক আত্মীয়–স্বজনকে হারিয়েছি। গভীর শ্রদ্ধায় গৌরবে স্মরণ করি তাঁদের। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সংঘটিত হয়েছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আর যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করলাম তাঁরা আমাদের হিরণ্ময় সন্তান। বিজয় দিবসে তাঁদের স্মরণ করি গভীর শ্রদ্ধায়। আমরা কিসের জন্য যুদ্ধ করেছিলাম? আমাদের খুঁজে নিতে হবে সেই ইতিহাস এবং তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে সঠিক তথ্য যাতে তারা বিভ্রান্ত না হয়। ১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকে এ অঞ্চলের বাঙালিদের উপর যে অত্যাচার, অবিচার বঞ্চনা এবং শোষণ চলছিলো তা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিলো বাঙালিরা। হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুই অঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যাদের সাথে একমাত্র ধর্মীয় ঐক্য ছাড়া অন্য কোনো মিল নেই এমন জনগোষ্ঠিকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা যে কত ভুল ছিল তা পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই বাঙালিরা উপলব্ধি করতে লাগল। প্রথম আঘাতটি আসল ভাষার উপর। বাংলার দামাল ছাত্ররা মেনে নিতে পারল না এ অযৌক্তিক দাবি যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। পরের ঘটনাবলী প্রায় সকলের জানা। ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৯’র গণ আন্দোলন, ৭০’র নির্বাচন এবং ৭১’র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা বিজয় লাভ করলাম। আদর্শের বিজয় হলো।
২০২৪ এর ১৬ ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তি হবে। কালের বিবেচনায় ৫৩ বছর কম সময় নয়। এখন সময় এসেছে আত্ম বিশ্লেষণের। আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছুতে পেরেছি কিনা। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রের চিত্র কেমন? বিজয় অর্জন করা যেমন কঠিন তেমনি তাকে ধরে রাখাটিও সহজ নয়। বিজয়কে অর্থবহ করার জন্য সকল মানুষকে কায়মনোবাক্যে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হতে হবে। তাই দেশকে স্বদেশ ভাববার যে প্রক্রিয়ার কথা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন সেখানে আমাদের পৌঁছতে হবে। তাঁর মতে, ‘দেশে জন্মালেই দেশ আপন হয় না! নিজের সমস্ত ধন–প্রাণ–মন দিয়ে দেশকে যখনই আপন বলে জানতে পারব তখনই দেশ আমাদের স্বদেশ হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘মানুষ আপন দেশকে সৃষ্টি করে। আমাদের দেশে মানুষ জন্মাচ্ছে মাত্র, দেশকে সৃষ্টি করে তুলছে না। দেশের অনিষ্টে তাদের মধ্যে অনিষ্টবোধ জাগে না। দেশকে সৃষ্টি করার দ্বারাই দেশকে লাভ করার সাধনা আমাদের ধরিয়ে দিতে হবে।’
স্বদেশবোধের ভাবনায় আমাদের উজ্জীবিত হতে হবে। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি বেড়েছে। দেশের মঙ্গলের জন্য কেউ ভাবছে না। যেনতেনভাবে অর্থ উপার্জন করে নিজেরও পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানোই যেন জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়েছে। তবে প্রাপ্তি যে একবারে নেই তাও নয়। গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে, জনগণ রাজনৈতিক সচেতন হয়েছে, অধিকার সচেতন হয়েছে, নির্বাচনের সময় অধিক সংখ্যক ভোটার ভোটাধিকার প্রয়োগ করছে, শিক্ষার ক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি বেড়েছে। বিভিন্ন পেশায় পুরুষের পাশাপাশি নারী যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। রাজনীতিতেও নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
আমাদের তরুণরা যত বেশি সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চা এবং খেলাধুলায় লিপ্ত থাকবে ততই অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পাবে। স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাবে দেশ। আমাদের স্বপ্ন অনেক।
লক্ষ মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় আমাদের অর্জন হয়েছে তা অটুট রাখতে হবে। তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম থাকবে, তারা দেশকে ভালোবাসবে, তাদের চিন্তা চেতনা দিয়ে দেশের সমস্যা নিরসন করবে। বিজয়ের ৫৩ বছর পূর্তিতে আমাদের অঙ্গীকার – বিশ্বকবির সোনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ, জীবনানন্দের রূপসী বাংলাকে বিশ্বের দরবারে একটি সুশিক্ষিত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে পরিচিত করা। আমরা যেন বলতে পারি ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, তুমি বিশ্বের বিষ্ময়, আমার অহংকার’।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।