চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে একনেকে পাস হওয়া একটি সড়ক প্রকল্প বাতিল চেয়ে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও দুই দপ্তরে আবেদন করেছেন এলাকাবাসী। আবেদনে অভিযোগ করা হয়েছে, ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ড্রাইডক কোম্পানি থেকে ৬ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা নিয়ে বিগত সরকারকে ব্যবহার করে সরকারি ৫৮৪ কোটি টাকার অপরিকল্পিত এবং অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্তে একটি আবেদনপত্র পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও অর্থ বিভাগের সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সচিব ও সড়ক ভবনের প্রধান প্রকৌশলীর কাছে পাঠানো হয়।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান। একনেক প্রকল্পটির নাম ছিল ‘চাতরী (চৌমুহনী) সিইউএফএল–কর্ণফুলী ড্রাইডক (মেরিন একাডেমি) ফকিরনিরহাট (এন ১২৯) জাতীয় মহাসড়ক যথাযথ স্থান–মান প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ’।
কর্ণফুলী–আনোয়ারা উপজেলার এলাকাবাসীর পক্ষে মোহাম্মদ হারুন চৌধুরী, ইনামুল হোসেন, আব্দুল শুক্কুর, মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও এএম মোহাম্মদ নূর উদ্দিন নামে পাঁচ ব্যক্তি এই আবেদনটি করেন। এতে ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ডকইয়ার্ড কোম্পানিকে ট্রান্সপোর্ট সু্িবধা দিতে দুরভিসন্ধিমূলকভাবে সরকারের ৫৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। আবেদনকারীরা জানিয়েছেন, দুই উপজেলার অধিকাংশ মানুষের অগোচরে ২০২৩ সালের শেষের দিকে তড়িঘড়ি করে আওয়ামী সরকার সমীক্ষাহীনভাবে প্রকল্পটি একনেকে পাস করে।
মন্ত্রণালয়ে পাঠানো আবেদনে বলা হয়, সড়ক ও জনপদ বিভাগ (সওজ) এ প্রকল্প বাস্তবায়নে নানা কাজ শুরু করেছে। এতে কর্ণফুলী উপজেলার জুলধা, বড়উঠান ও শিকলবাহা ইউনিয়নসহ আনোয়ারার বরুমছড়া ইউনিয়নে সওজের সার্ভেয়ার এসে রাস্তা বর্ধিতকরণ ও জমি অধিগ্রহণের কথা বললে এলাকাবাসী বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারেন। তা না হলে তাদের বাপ–দাদার ভিটার উপর দিয়ে যে তথাকথিত মেরিন সড়ক হচ্ছে তা কেউ জানতেন না।
এলাকার লোকজনের দাবি, তাদের ৫শ বছরের পুরনো জনবসতি। যে জায়গা দিয়ে এই সড়কের প্ল্যান ও অধিগ্রহণ ম্যাপ সেই জায়গা রয়েছে হাজার হাজার পাকা, সেমিপাকা ও দ্বিতল ঘরবাড়ি, হাসপাতাল, খামার, বাজার, স্কুল, মাজার, মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। সড়কটি করলে এসব স্থাপনাসহ ২০ হাজার মানুষ তাদের ঘরবাড়ি হারাবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে অন্য এলাকায় গিয়ে তাদের নতুন করে বসতি স্থাপন করা কঠিন। এ প্রকল্প কিভাবে কারা পাস করিয়েছেন তার খোঁজ নিতে গেলে জানা যায়, সাবেক এক উপজেলা চেয়ারম্যান এবং এক ঠিকাদার কর্ণফুলী নদী তীর সংলগ্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি ড্রাইডক কোম্পানি থেকে ৬ কোটি টাকার আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন বলে আবেদনে উল্লেখ করেন।
ওই ড্রাইডক কোম্পানিকে ট্রান্সপোর্ট সুবিধা দিতে সরকারি ৫৮৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পটি গোপনে একনেকে পাস করিয়েছেন। যেখানে সাবেক ভূমিমন্ত্রী ও সড়ক সেতু সচিবকে ব্যবহার করেছেন। সড়ক সচিব ও সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বাড়ি যেহেতু কর্ণফুলী–আনোয়ারায়, সেটাকে কাজে লাগিয়েছেন ওই চেয়ারম্যান ও ড্রাইডক কোম্পানির লোকজন। তদন্ত করলে আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন।
আবেদনকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এই প্রকল্পের মাধ্যমে একজন বিশেষ ব্যক্তিকে সুবিধা দিতে সরকারের ৫৮৪ কোটি টাকা জলে ফেলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। অথচ অনেক আগেই প্রায় তিন কোটি ব্যয়ে মেরিন একাডেমি নামক আরেকটি সড়ক নির্মিত হয়েছে। সে সড়কেও গাড়ি অপ্রতুল। বিপরীতে টানেল সংযোগ সড়কে ৪ ও ৬ লেনের রাস্তা সচল হচ্ছে।
এলাকার যোগাযোগের জন্য দুটি সড়ক থাকলেও অতি লোভী কিছু মানুষ সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে লুটপাট করার উদ্দেশ্যে একনেকে প্রকল্পটি পাস করানোর ব্যবস্থা করেন। এ প্রকল্পে তারা জায়গা অধিগ্রহণ করে সড়কটি আনোয়ারার চাতরী (চৌমুহনী) হয়ে সিইউএফএল দিয়ে কর্ণফুলী ড্রাইডক পর্যন্ত কৌশলে বর্ধিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের মধ্যমেয়াদি প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল মহাসড়ক নেটওয়ার্কের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ। কিন্তু এ প্রকল্পে তার কিছুই নেই। প্রকল্পটিকে অন্তঃসারশূন্য বলে মন্তব্য করে আবেদনে অভিযোগ করা হয়, প্রকল্পটির কাজ শুরু না হতেই সড়ক বিভাগের কিছু প্রকৌশলী ও সার্ভেয়ার অধিগ্রহণের প্রস্তাবিত জমির দাগে নয়–ছয় করে প্রতিবেদন দিয়ে রাতারাতি গ্রামের নিরীহ লোকজন থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এ সড়ক নির্মাণ করলে সাধারণ জনগণ তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা, এমনকি জনগণের কষ্টার্জিত ট্যাঙের টাকা কারো ব্যক্তি স্বার্থে ব্যয় করা যুক্তিযুক্ত কিনা, তা অধিকতর তদন্ত ও সমীক্ষা করা আবশ্যক বলে মনে করেছেন এলাকাবাসী। পাশাপাশি টানেল অভিমুখে ৪ ও ৬ লেনের এতগুলো সড়ক থাকার পরও কেন সড়ক প্রশস্তকরণের নামে পশু খামার ও বাড়িঘরের উপর দিয়ে নতুন সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা পড়েছে তাও খতিয়ে দেখার দাবি জানানো হয়েছে। সাধারণ মানুষের বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন করে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ডেইরি জোনকে কেউ যেন ধ্বংস করতে না পারে সেজন্য দ্রুত প্রকল্পটি বাতিল করারও আবেদন জানিয়েছেন আবেদনকারীরা।
এ ধরনের প্রকল্প বিষয়ে গত ৪ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, যেহেতু এখন জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করা হয়েছে, সংসদ সদস্যরাও নেই। তাই এই প্রকল্পের আর কার্যকারিতা নেই। প্রকল্পটি বাতিল করা হতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেওয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ ও অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।