একটি পুণ্যময় দিন

ড. আনন্দ বিকাশ চাকমা | বৃহস্পতিবার , ৪ মে, ২০২৩ at ৬:০৪ পূর্বাহ্ণ

জাতিসংঘ ঘোষিত ‘ভেসাক ডে’। বিশ্বের বৌদ্ধদের নিকট অতিশয় পুণ্যময় দিন। বঙ্গাব্দ গণনায় এটি বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। এ তিথির সাথে গৌতম বুদ্ধের জীবনী, বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতির নিবিড় যোগ। কারণ আজ থেকে ২৫৮৫ বছর পূর্বে সিদ্ধার্থ গৌতম এদিন মানবের মুক্তির দূত হয়ে মর্ত্যভূমিতে পদার্পণ করেছেন। বর্তমান নেপালের লুম্বিনীর এক মনোরম উদ্যানে তাঁর জন্মলাভ। তিনি কপিলাবাস্তুর রাজা শুদ্ধোধন ও মায়াদেবীর সংসারে রাজপুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু সিদ্ধার্থ গৌতম রাজশ্বৈচর্য পরিত্যাগ করে সকল মানবের দুঃখ মোচনের সংকল্প নিয়ে তপস্যায় আত্মনিয়োগ করেন। তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় ছয় বৎসর যাবত কঠোর ধ্যান সাধনা করে তিনি শেষ পর্যন্ত গয়ার বোধিবৃক্ষ তলে অন্তিম তপস্যায় বসে যেদিন সাধনায় সিদ্ধি লাভ করে জগৎপূজ্য গৌতম বুদ্ধ হিসেবে আবির্ভূত হন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটিও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা। অতঃপর সর্বজীব ও মানবের কল্যাণার্থে দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তৎকালীন উত্তর ও পূর্ব ভারতে তাঁর সত্য, শান্তি, অহিংসা ও মৈত্রীময় ধর্মবাণী প্রচার করে যেই দিন কুশীনগরের শালবনে ভবচক্র নিরোধ করে নশ্বর দেহত্যাগ করে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হন সেই দিনটিও ছিল বৈশাখী পূর্ণিমা তিথি। সুতরাং তাবৎ বিশ্বের বৌদ্ধদের নিকট বৈশাখের পূর্ণিমা দিনটি অতিশয় পবিত্র ও পুণ্যময়। অত্রাঞ্চলে বিশেষ করে বঙ্গভারতে এটি বুদ্ধপূর্ণিমা হিসেবে সমাদৃত।

জাতিসংঘ সদর দপ্তরে প্রতিবছর বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসটি পালিত হয় ‘বেশাখ ডে’ হিসেবে। বিশ্ব সংস্থার জন্য এটি বৈশ্বিক ছুটির দিনও। জাতিসংঘ পৃথিবী নামক গ্রহে মানবজাতির শান্তি ও অগ্রগতিতে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের অবদানকে স্বীকৃতি দিয়ে বুদ্ধের জন্মজয়ন্তীকে আন্তজার্তিক ‘ভেসাক ডে’ হিসেবে পালন করে আসছে ২০০০ সাল থেকে। এটি বিশ্ববৌদ্ধদের জন্য পরম শ্লাঘনীয় ও মর্যাদাপূর্ণ ঘটনা। জাতিসংঘের ভেসাক ডে পালনের বৈশ্বিক তাৎপর্য আছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৬.৬ ভাগ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে সংখ্যা হিসেবে যা ৫০৬ মিলিয়নের অধিক। ভারতীয় উপমহাদেশে আবির্ভাব হলেও পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশেই এখন বৌদ্ধ ধর্ম পালিত হয় যার মধ্যে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সবার্ধিক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বসবাস। ২০১৪ সালে জাপানে বিশ্ব বৌদ্ধদের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তখন পাঁচটি মহাদেশের ৩৩টি দেশের শীর্ষ বৌদ্ধ নেতারা একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের ঐক্যের পেছনে মূলসূত্র ছিল বুদ্ধের প্রতি অগাধ বিশ্বাস এবং তা ধারণ ও অনুশীলনের প্রেরণা। গত কয়েক বছরে বৌদ্ধধর্ম আরব ভূখণ্ডেও প্রবেশ করেছে। এভাবে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ধর্মদর্শন হিসেবে এই বিশ্বায়নের যুগেও বৌদ্ধ ধর্মের গৌরব অক্ষুণ্ন ও অটুট রয়েছে এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম ধর্মসম্প্রদায় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর কারণ বুদ্ধের কালজয়ী মহান শিক্ষা ও উপদেশ। মানবশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের জীবনী ও তাঁর সমগ্র শিক্ষাবলী ত্রিপিটক নামে গ্রন্থিত আছে যা এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ। ত্রিপিটকের মূল গ্রন্থসম্ভার পালিতে রচিত হলেও বিশ্বের বহুভাষায় অনূদিত হয়ে তা এখন বহুজনের অধ্যয়নযোগ্য। আজ থেকে আড়াই হাজার বছরের অধিককাল আগে বুদ্ধ ভারতবর্ষে পরিব্রাজন করে সর্ব মানবের কল্যাণে যে অহিংসা, করুণা, মৈত্রী ও মানবতার বাণী প্রচার করেছেন আজও মানুষ আপন আপন চিত্তের শান্তির জন্য তার শরণ বা আশ্রয় নিচ্ছে– ‘বুদ্ধং শরণ গচ্ছামি’ বলে। মানুষের জীবনে সর্বগ্রাসী দুঃখসত্যকে চিহ্নিত করে তিনি জীবনদুঃখের অবসানের পথ নির্দেশ করেছেন আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণের মাধ্যমে। বুদ্ধের মতে পৃথিবীর প্রত্যেক ঘটনা বা কার্যের পিছনে কারণ আছে এবং প্রতিনিয়ত কারণ কার্যতে ও কার্য কারণে রূপান্তরিত হয়। বুদ্ধ কার্যকারণের এ নীতিকে প্রতীত্যসমূৎপাদ নাম দিয়ে অনুপূঙ্খভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এ নীতি হলো বুদ্ধ ধর্ম ও দর্শনের মেরুদণ্ড বা চাবিকাঠি। বুদ্ধের মতে মানবজীবন পঞ্চস্কন্ধের আধার। আর পঞ্চস্কন্ধই দুঃখময়। তিনি মনুষ্য জীবনে দুঃখের রহস্য উন্মোচন করে তা নিরোধ বা বিনাশের জন্য এ নীতি প্রয়োগ ও অনুশীলনের কথা বলেছেন যার জন্য প্রয়োজন চিত্তের স্থিরতা ও একাগ্রতা। চিত্তকে সমাহিত করার জন্য প্রয়োজন গভীর চিন্তামগ্নতা, অবিরাম তপস্যা, যুক্তি ও প্রজ্ঞানির্ভরতা। এজন্য তাঁর শিক্ষা হলো কোনো কিছুকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করা। তিনি জবরদস্তি করে স্বীয় মত অপরের ওপর আরোপের নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। এসে দেখে বাছবিচার করেই তবে তাঁর ধর্ম অনুসরণের কথা বলেছেন। স্থান, জাতিধর্মবর্ণশ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। তাঁর প্রচারিত ধর্ম ও প্রতিষ্ঠিত সংঘের দুয়ার সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। তিনি পার্থিব সংসারে সুখী জীবন যাপনের জন্য মানুষকে পঞ্চশীলাবলম্বন করে বিনয়ী হবার শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষের হৃদয়মন জয় করার জন্য অটল অহিংসার পথ অনুসরণের উপদেশ দিয়েছেন। তাঁর অমরবাণী ‘অক্বোধেন জীনে কোধং অসাধুং সাধুনা জীনে।’ অর্থাৎ ক্রোধ বা হিংসা দিয়ে নয় অক্রোধ বা অহিংসার দ্বারা মনুষ্যত্বকে জয় করতে বলেছেন। অসাধুকে সাধুতা দিয়ে জয়ের কথা বলেছেন। কৃপণকে ত্যাগের মহিমা দিয়ে জয়ের নির্দেশনা দিয়েছেন। পৃথিবীতে রাজশ্বৈর্য ত্যাগ করে অনাড়ম্বর, অনাগরিক জীবন বেছে নিয়ে সিদ্ধার্থ গৌতম যে ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা জগতে অদ্বিতীয়। অহিংসা, অক্রোধ ও ক্ষমাগুণের শক্তির কথা ঘোষণা করেছেন। তাঁর মৈত্রী বা ভালোবাসা শুধু মানবের হিতে নয় বরং সর্বজীবের প্রতি প্রসারিত করেছেন। এজন্য বানর, হাতি, হরিণ, সর্পরাজ সকল প্রাণীই বুদ্ধের প্রতি সুপ্রসন্ন ছিলেন। বুদ্ধের অহিংসা নীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করে ভারতীয় সম্রাট অশোক, কনিষ্ক খ্যাতির চূড়ায় আরোহন করেছেন। এ দুজন সম্রাটের আমলে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষের সীমানা ছাড়িয়ে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমান বিশ্বে সর্বোচ্চ বৌদ্ধ জনসংখ্যার দেশের মধ্যে অধিকাংশই দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে। যেমনকম্পোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, ভূটান, শ্রীলংকা, লাওস, মঙ্গোলিয়া, জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। চীনে বিশ্বের মোট বৌদ্ধ জনসংখ্যার অর্ধেক ২৫৪ মিলিয়ন বসবাস করে অন্যদিকে ভারতে রয়েছে ১০ মিলিয়ন বৌদ্ধ। এভাবে বুদ্ধের বাণী আজ বিশ্বের বহু দেশের, বহু জাতির, বহু মানুষের আত্মমুক্তির মন্ত্র হিসেবে সমাদৃত। প্রতিবছর বুদ্ধের জন্মজয়ন্তী তথা বুদ্ধ পূর্ণিমা ও ‘ভেসাক ডে’ কোটি মানুষের অন্তরে অপার আনন্দের বার্তা নিয়ে উপস্থিত হয়। এদিন মানুষ গভীর শ্রদ্ধাভরে বুদ্ধকে স্মরণ করে এবং যথাযোগ্য ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে দিবসটি পালন করে। গৌতম বুদ্ধ মাতৃজঠর থেকে পৃথিবীপৃষ্ঠে পদাপর্ণের পরপর তাঁর পবিত্র পদতলে প্রসফূটিত সপ্তপদ্মের প্রতীককে স্মরণ। বুদ্ধের অনন্ত গুণরাশিকে স্মরণ করে বুদ্ধপূজা ও অর্ঘ্যপ্রদান। কঠোর তপস্যারত অবস্থায় সুজাতার পায়েস ভোজনের স্মৃতির মাহাত্ম্যকে অনুধাবন করে এদিন বৌদ্ধরা বিহারে সমবেত পূণ্যার্থীদের নিকট সুস্বাদু পায়েস পরিবেশন করেন। লক্ষকড়ি মূল্যের স্বর্ণপাত্রে পরিবেশিত পায়েস ভোজনের পর ধ্যানী সিদ্ধার্থ গয়ার যে বৃক্ষতলে বসে তপস্যা করে বুদ্ধত্ব লাভ করেছেন সেই বোধিবৃক্ষেও ভক্তরা এদিন জলসিঞ্চন ও পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। এছাড়া বুদ্ধের মহান জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহে আয়োজন করা হয় বর্ণিল শোভাযাত্রা। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বুদ্ধের জীবন, ধর্ম ও দর্শন নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় জ্ঞানগর্ভ আলোচনা সভা। জাপানে বুদ্ধের জন্মজয়ন্তীকে ঘিরে উদযাপিত হয় বৃহত্তম পুষ্পোৎসব ‘হানামাতসুরি’। এসময় বুদ্ধের প্রতিকৃতিকে পুষ্পজাত বিশেষ রস দিয়ে স্নান করানো হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় জনসাধারণের মাঝে বিনামূল্যে খাবার পরিবেশন করা হয় এবং প্রজ্বলন করা হয় পদ্মফুলাকৃতির প্রদীপ। চীনদেশে আতশবাজি ও ফানুস উড়িয়ে জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। আমাদের দেশের বৌদ্ধ বিহারসমূহে বৌদ্ধরা সমেবত হয়ে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বুদ্ধ পূর্ণিমা পালন করে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বুদ্ধপূর্ণিমাতে দিবসটির মাহাত্ম্য তুলে ধরে বিশেষ বাণী দেন। উভয়ে যথাক্রমে বঙ্গভবন ও গণভবনে বৌদ্ধ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। অশান্ত বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বুদ্ধের অমৃতময় উপদেশের কথা স্মরণ করেন। এভাবে একদা স্যার এডউইন আর্নল্ডের ‘লাইট অব এশিয়া’ খ্যাত গৌতম বুদ্ধের জন্মদিবস এখন ‘ওয়ার্ল্ড ভেসাক ডে’ হিসেবে পালিত হয়। বুদ্ধের অহিংসা, মৈত্রী ও শান্তির বাণীর মাহাত্ম্য আজ জগতের পরম আরাধ্য। প্রতিবছর বুদ্ধ পূর্ণিমা ও ‘ভেসাক ডে’ আমাদের সেকথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধবুদ্ধ পূর্ণিমা : মানব মুক্তির পবিত্র দিন