ছেলেবেলায় বার্ষিক পরীক্ষা শেষে শীতের ছুটিতে নানাবাড়ি যাওয়া হত সোমাদের। বছরে একবারই বেড়ানোর সুযোগ। অন্যান্য শহর, গ্রাম থেকে খালাতো ভাই বোনেরা এসে যেত দু’একদিনের ব্যবধানে। দিনরাত খাওয়া–দাওয়া, পাড়া বেড়ানো, হাহাহিহি। কি ভাবনাহীন সেই নানা রঙের দিনগুলি! নিদেনপক্ষে তিনটি সপ্তাহ এভাবে কেটে যেত। তিন কামরার একটা টিনের ঘরে এতো লোকের স্থান সংকুলান কেমন করে হত ভাবলে আজও অবাক হতে হয়। অবশ্য উঠোনের অন্য দুই প্রান্তে দু’কামরা বিশিষ্ট আরও দুটি ঘর ছিল। এক কোনায় প্রশস্ত হেঁসেল। রাঁধা–বাড়া, পিঁড়ি পেতে খাওয়া–সব চলে খড় বিছালিতে ছাওয়া এই ঘরে। এ বাড়ির কর্তার আয় উপার্জনের খবর কোনোকালে কেউ রাখেনি। কেমন করে প্রতি বেলায় ত্রিশের অধিক মানুষের ভাতের হাঁড়ি চুলোয় চাপত কে জানে! এখনকার মতো ঘরে বসে বসে মুঠোফোন বা টেলিভিশন টিপে সময় কাটানোর রেওয়াজ সেকালে ছিল না। নিশুতি রাতের আগে ঘরে ফেরার কথা মনেই হত না। ঘরগুলো ছোট হলেও আঙিনা ছিল বৃহৎ। ছেলে বুড়ো সকলের দিবারাত্রির মিলনকেন্দ্র। সূর্য ওঠার আগে থেকে শুরু, চন্দ্র অস্তাচলে যাওয়া অবধি জমজমাট উঠোন সভা। এখন অবশ্য সেই উঠোন ছোট হতে হতে নাই হতে চলেছে।
সেবার নানাবাড়ি যাওয়ার দিন কয় পর। এক সকালে ঘুম ভেঙে সোমারা দেখে উঠোন জলে থৈ থৈ। কি ব্যাপার! রাতে কি বৃষ্টি পড়েছিল? এই ভরা মাঘে বৃষ্টি আসবে কোথা থেকে! সোনাঝরা রোদে ঝকমক করছে চারিধার। কিন্তু উঠোনের পানি ধীরে ধীরে বাড়ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হাঁটুপানি। উল্লসিত বালক বালিকারা কাগজের নৌকা ভাসায় দাওয়ার সিঁড়িতে বসে। বড়দের মাথায় হাত। এ–ঘর ও–ঘর করতে পারছে না। আলাপ আলোচনা করা যাচ্ছে না। ঘরভিটায় পানি ঢুকল বলে। অগত্যা হাঁটু পানি ডিঙিয়েই দু’একজন ঘরের বার হন, এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করেন। হঠাৎ পানি বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে বের হন। পুকুরের দিকটায় গিয়ে বোঝা যায় ফুলে উঠছে পুকুরের পানি। শান বাঁধানো ঘাট, পুকুর পাড় ডুবে একাকার। উঠোনের ফুলগাছ, রান্নার জন্য জমিয়ে রাখা শুকনো পাতা, খড়–বিচালি, দুইমুখো মাটির চুলা, শিশুদের খেলাঘর, খেলনা গাড়ি, হাঁসমোরগের খোঁয়াড় কিছুই আর দেখা যায় না। হেঁসেল টইটম্বুর। শৌচাগার, নর্দমার ভেদাভেদও নিশ্চিহ্ন।
কিন্তু পুকুরের পানি ফুলছে কেন? ধারে কাছে নদী নেই, জোয়ার ভাটার সঙ্গে এ–বাড়ির অধিবাসীদের কোনো পরিচয়ই ঘটেনি। এতক্ষণ হৈ হট্টগোলে ওরা খেয়ালই করেনি পাশের বাড়ি থেকে একটা কর্কশ শব্দ ভেসে আসছে। পানি ভেঙে সুপুরি পাতার ঘেরা দেওয়া সীমানার কাছে গিয়ে উঁকি মেরে দেখে ও–বাড়ির উঠোন খটখটে। বউ ঝিয়েরা, ছেলেমেয়েরা যে যার কাজে ছোটাছুটি করে আর দশটা দিনের মতোই ব্যস্ত সময় পার করছে। অথচ এ বাড়ির জীবনযাত্রা থমকে গেছে। একজন সাহস করে দুই পা এগিয়ে সীমানা পার হয়। ওই পারে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে আবিষ্কার করে উঠোনের এক কোনে বড় নল লাগানো এক যন্ত্র বসানো। নলটা সোজা নেমে গেছে ওদের নিজেদের পুকুরে, আর যন্ত্রের হা করা মুখটা দিয়ে গল গল করে পানি গিয়ে পড়ছে এ–বাড়ির পুকুরে।
নিরীহ গোবেচারা মানুষটি প্রতিবেশীর কাছে জানতে চান কেন তারা এমন করছে? ও–বাড়ির গৃহকর্তা স্থানীয় প্রভাবশালী জোতদার। দুর্বল প্রতিবেশীর প্রশ্নের জবাবে হেসে হেসে বলেন– ‘আমাদের পুকুর কাটানো চলছেতো,তাই কয়েকদিনের জন্য পানিগুলো তোমাদের পুকুরে গচ্ছিত রাখছি। পুকুর কাটা শেষ হলেই আবার পানিগুলো ফেরত নিয়ে আসবো। মাত্রতো কয়েকটা দিন’! প্রসঙ্গক্রমে গতকাল বিকেলে বাড়ির চলৎশক্তিহীন বুড়ো কর্তার সঙ্গে কথা হয়েছিল, এবং তাঁর সম্মতি নিয়েছিল বলেও জানিয়ে দেন তিনি। ভুলোমনের সেই বৃদ্ধ দিন কয়েকের জন্য তাঁর পুকুরে পানি জমিয়ে রাখার অনুমতি দিয়েছিলেন বটে। প্রতিবেশী কথা দিয়েছিলেন পুকুর ভরে গেলে উঠোনে পানি ঢোকার আগেই পানি প্রবাহ থামিয়ে দেওয়া হবে, প্রয়োজনে পাশের খালে বা অন্য কোন প্রতিবেশীর বাড়ির দিকে নলের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হবে। ধূর্ত প্রতিবেশী তাঁর কথা রাখেননি। তিলোত্তমা নগরী চট্টগ্রামের নানান স্থানে জলাবদ্ধ নাগরিকদের মতো করেই ক’টা দিন পার করে দেয় এ বাড়ির এতগুলো মানুষ। সোমাদের মতো অতিথি পাখিরা বেড়ানো সংক্ষিপ্ত করে পালিয়ে বাঁচে। গৃহবাসী মুখ বুজে সয়ে যায়। কারণ তাদের পালাবার পথ নেই।
যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তখন চিঠি। মায়ের কাছে আসা পত্র মারফত সোমা জানতে পায় উঠোনের পানি সরতে কয়েকদিন লেগেছিল, শুকোতে লেগে যায় আরও কয়েকদিন। তবে পুকুরের পানি আর ব্যবহার করা যায় না। কাকচক্ষুর মতো টলটলে পানি ছিল তাদের পুকুরে। বইয়ের পাতার মতো সে পুকুর ভরা ছিল মাছে। সোমার আজও মনে পড়ে, বাড়িতে বিশেষ অতিথি এলে বড় মামা জেলেদের খবর দিতেন। বিশাল আকৃতির এক জাল ফেলা হত। একসঙ্গে অন্তত ডজন খানেক জেলে নামতেন পুকুরে। জালটাকে টেনে টেনে তীরে নিয়ে আসা হলে কলবল করে উঠত শত শত রূপোলি মাছ। সোমাদের মতো শৌখিন মৎস শিকারীরা যখন–তখন বড়শি ফেলে তেলাপিয়া, সরপুঁটি, মৃগেলও ধরে নিয়ে আসতো। বড় মামী রেঁধে দিতেন তেল মশলা মাখিয়ে। সোমা তার মায়ের কাছে শুনেছে, তাঁদের ছেলেবেলায় ঘরের দাওয়ায় বসে পুকুরে লম্বা সুতোর ছিপ ছেড়ে দিয়ে মাছ ধরতেন তাঁর নানা। নাতি নাতনিরা তাঁকে ঘিরে বসে থাকতো আর আটা, বিস্কুট ইত্যাদি দিয়ে মাছ ধরার টোপ বানিয়ে দিত। একাজের জন্য পুরস্কৃত হত শিশুরা; কখনও কুল, কখনও পেয়ারা। দৈবাৎ ছোট মাছ উঠে এলে নানা তাকে আবার ভাসিয়ে দিতেন পুকুরে। তিনি যে কেবল ছিপ ফেলে মাছ ধরতেন তা নয়, সারা বছরই মাছেদের যত্ন দিতেন। আজ এই পুকুরে একটাও মাছ নেই। জাল বড়শি যা–ই ফেলুন একটা কুচো চিংড়িও পাওয়া যাবে না।
সেই যে হঠাৎ আসা অদৈব দুর্বিপাকে দুই পুকুরের পানি মিলেঝুলে কি বিক্রিয়া হল, কে জানে! আবার গচ্ছিত পানি ফেরত নেওয়ার সময় প্রতিবেশী কিছু পানি বেশীই নিয়ে নিল। কারও বলার কিছু ছিল না। বসন্তের আগমনে ঝরা পাতায় ছেয়ে যায় পুকুর। শ্যাওলার উপদ্রবও বেড়ে যায়। হাঁড়ি–পাতিল আর কাপড় ধোয়ার কাজ চালানো যায় কোনোমতে। রাঁধাবাড়া আর স্নানের পানি বয়ে আনতে হয় মসজিদের পুকুর হতে, কিংবা দূরের এক দীঘি হতে। রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে অবাধ সাঁতার কাটার দিনগুলো রূপকথা হয়ে যায় সেদিন হতে।
দেখতে দেখতে কেটে যায় চার দশকের বেশী সময়। পৃথিবী কত বদলে যায়! বদলে যায় বাংলাদেশ; ডিজিটাল থেকে স্মার্ট দেশে রূপান্তরিত হলো বলে। ও–বাড়ির ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে শহরে কিংবা প্রবাসে থিতু হয়। টিনের ঘরগুলো অট্টালিকা হয়ে যায়। ঘরবাড়ি দেখাশোনার জন্য নিযুক্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক। পাড়ার সকলে সমঝে চলে তাদের। কেবলমাত্র এ–বাড়িতেই কোনো দালানকোঠা নির্মিত হয় না। সময়ের প্রয়োজনে ঘরগুলোর আয়তন বাড়ে জীর্ণশীর্ণভাবে, পরিণামে ছোট হয়ে যায় উঠোন। এ বাড়ির নতুন কর্তার আয় উপার্জনের খবর আজও রাখা হয় না। তবে আজও বাড়িভরা অতিথি, দিনরাত খাওয়া–দাওয়া, পাড়া বেড়ানো, হাহাহিহির কমতি নেই। পুকুরের পানি আজ ছোঁয়াও যায় না। প্রতিবেশীদের আবর্জনার ভাগাড় এখন সেই টলটলে পুকুর। তবে এখন আর বহুদূর পথ ভেঙে পানি বয়ে আনতে হয় না। দেশের বাদবাকি জনতার সঙ্গে ভূগর্ভস্থ পানি অপহরণের দৌড়ে নিজেদের অজান্তেই সামিল হয়ে যায় এ–বাড়ির সাদাসিধে মানুষগুলো। বাড়িতে বসেছে গভীর নলকূপ।
অতঃপর মাটিখেকোদের চোখ পড়ে মজা পুকুরের দিকে। মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয় শতাব্দী প্রাচীন পুকুরটির। কারও সাধ্য নেই বাঁচায় তাকে। ইচ্ছেও কি আছে?