একটি ট্রমা সেন্টারের জন্য দুই দশকের অপেক্ষা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মীরসরাই অংশ

মাহবুব পলাশ, মীরসরাই | বৃহস্পতিবার , ৯ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৫ পূর্বাহ্ণ

দেশের সবচেয়ে ব্যস্ততম ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোটবড় দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় আহতের চিকিৎসায় আশপাশের কোথাও নেই ট্রমা সেন্টার। যার ফলে সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেয়ে সড়কেই প্রাণ হারাচ্ছেন অনেকে। তবে দেশের সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জোন চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলায় যদি একটি ট্রমা সেন্টার থাকতো তাহলে দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিদের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া সম্ভব হতো। এতে অনেক প্রাণ বেঁচে যেত বলে সংশ্লিষ্ট মহলের অভিমত। কিন্তু দুই দশক ধরে সাধারণ মানুষের এই দাবি আজো বাস্তবতার মুখ দেখেনি।

সূত্র মতে, মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যু তো অহরহ আছেই, মীরসরাইয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক জোনে গত কয়েক বছরে অন্তত ১০ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনার সাথে সাথে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করা সম্ভব না হওয়ায়। ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের নানা বিষয় দেখভালের জন্যে পৃথক চারটি হাইওয়ে থানা ও সাতটি হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ি রয়েছে। লোকবল ও সরঞ্জামাদিতে অপর্যাপ্ত এসব থানা এবং ফাঁড়ির কর্মকর্তারা নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে সচেষ্ট থাকলেও আহতদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা তাদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। ফলে দুর্ঘটনাস্থল থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত পৌঁছাতে যে সময় ব্যয় হয় তাতে অপেক্ষাকৃত কম আহত ব্যক্তিদের অবস্থা হয়ে পড়ে নাজুক, আর গুরুতর আহত ব্যক্তিরা পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।

জোরারগঞ্জ হাইওয়ে পুলিশের ইনচার্জ সোহেল সরকার বলেন, অনেক সময় দুর্ঘটনার পর যানজট লেগে যায়। তখন আহতদের হাসপাতালে নিতে অনেক বেশি সময় লেগে যায়। আশপাশে কোথাও ট্রমা সেন্টার থাকলে হয়তো দুর্ঘটনাকবলিত অনেক মানুষ প্রাণে বেঁচে যেত। কিন্তু এ মহাসড়কে একটিও ট্রমা সেন্টার নেই।

জানা যায়, মহাসড়কের ফেনী থেকে চট্টগ্রাম সিটি গেটের মধ্যবর্তী স্থানে সংঘটিত দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিদের নিয়ে ছুটতে হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দিকে। তাৎক্ষণিক স্থানীয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা ছাড়া আর কোনো সেবা ভাগ্যে জোটে না। বাধ্য হয়েই আহতদের নিয়ে যেতে হয় ১০০ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে। বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন পয়েন্টে যানজটের দরুন পথেই প্রাণ হারান অনেকে।

২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর মীরসরাইয়ের মহামায়া প্রকল্প উদ্বোধন শেষে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ট্রমা সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছিলেন তৎকালীন পর্যটন ও গৃহায়ণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির মধ্যে উক্ত দাবি স্থান পেলেও দীর্ঘ ১২ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই দাবি আর আলোর মুখ দেখেনি।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) এর তথ্য মতে, দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনা ২০১১ সালের ১১ জুলাই মীরসরাইয়ে আবু তোরাব সড়কে ঘটা দুর্ঘটনাটি। সেই দুর্ঘটনায় ৪৪ জন শিক্ষার্থী ও একজন অভিভাবকসহ মোট ৪৫ জন নিহত হন। এদের মধ্যে তিনজন মারা গেছেন হাসপাতালে নেওয়ার পথে। যদি ট্রমা সেন্টার থাকতো তাহলে অন্তত ২০ জনকে বাঁচানো সম্ভব হতো। এছাড়া গত দেড় বছরে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের শুধু মীরসরাই অংশে দুর্ঘটনায় ৫৬ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক ব্যক্তি।

সম্প্রতি দুর্ঘটনায় আহত এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, দুই মাস আগে শহর থেকে মীরসরাই আসার পথে ছোট দারোগাহাট এলাকায় বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছি। আমার পা ভেঙে গেছে। অনেক কষ্টে চলাচল করতে হচ্ছে। দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে যদি চিকিৎসা পেতাম তাহলে হয়তো এত বড় ক্ষতি হতো না। দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণ করা মীরসরাই পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মহিউদ্দিন বলেন, ২০০৩ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছি। দুর্ঘটনার পর চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা অজ্ঞান হয়ে ঘটনাস্থলে পড়েছিলাম। পরে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসার পরও ভালো হয়নি। আমার একটি পা কেটে ফেলা হয়েছে। যদি মীরসরাইয়ে ট্রমা সেন্টার থাকতো, তাহলে সময় মতো চিকিৎসা নিতে পারতাম। পা কেটে ফেলতে হতো না। ২০ বছর ধরে আমাকে হুইলচেয়ারে চলাফেরা করতে হচ্ছে। যত দিন বাঁচব এভাবেই চলতে হবে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মীরসরাই উপজেলা শাখার সভাপতি ও মাতৃকা হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেসর ডা. মো. জামশেদ আলম বলেন, ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক খুবই দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। এখানে প্রায় সময় দুর্ঘটনা ঘটে। অনেক মানুষ মারা গেছেন, অনেকে আহত হয়েছেন, আবার অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করে বেঁচে আছে। একটি ট্রমা সেন্টার নির্মাণের জন্য আমরা অনেকবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনেকভাবে জানিয়েছি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।

মীরসরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জসীম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের অভিভাবক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সকল উদ্যোগ শীঘ্রই নেয়া হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধখালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধানের চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজার রুটের ট্রেনের ভাড়া চূড়ান্ত হচ্ছে আজ