একটি অশান্ত- অস্থির- চঞ্চল কবিপ্রতিভার প্রস্থান

নাসিরুদ্দিন চৌধুরী | বৃহস্পতিবার , ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৫:৩৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে দেশ মাত্র স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার পূর্বে আমরা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার্থী ছিলাম। পরীক্ষা হবার মুহূর্তে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পরীক্ষা মুলতুবি রেখে মুক্তিযুদ্ধে চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। সুতরাং এবার পরীক্ষাটা দেয়া যেতে পারে। একাত্তরের পরীক্ষা বাহাত্তরে হলো সারাদেশে। আমাদের পরীক্ষা কেন্দ্র হলো সিটি কলেজ। পরীক্ষা দিতে দিয়ে বন্ধ,ু সহপাঠী সবার সঙ্গে আবার দেখা হলো। আমার কলেজ জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বন্ধু দিদার মোহাম্মদ শামসুল ইসলামের সাক্ষাৎ পেলাম ৯ মাস পর। দিদারের বাড়ি আমিরাবাদ বটতলী। সে চরকানাই লজিং থাকতো। সারিবদ্ধ গুবাক তরুর নয়নাভিরাম এক বাগিচার মাঝে সুন্দর ছিমছাম বাড়ি। হাবিলাসদ্বীপ ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান আবু ছিদ্দিক চৌধুরীর বাড়ি। অনেকদিন সে বাড়িতে গিয়েছি।
সিটি কলেজে শেষ পরীক্ষা দেয়ার পর দিদার আমাকে ধরে নিয়ে গেল ফিরিঙ্গীবাজারের প্রবেশপথে অবস্থিত একটি ত্রিতল বিল্ডিংয়ে, কবিরাজ বিল্ডিং হিসেবে খ্যাত। নাট্যকার মিলন চৌধুরী ও সঙ্গীত শিল্পী অশোক সেনগুপ্তের স্ত্রীর দাদু কবিরাজ শ্যামাচরণ বাবুর বাসভবন। সেটা শুধু বাসভবন ছিলো না, অনেক কিছু হতো সেখানে। দেশভাগের পর কলকাতা থেকে অনেক কবি সাহিত্যিক ঢাকা না গিয়ে চট্টগ্রামে চলে এসেছিলেন। দু’জনের নাম করতে চাই-শওকত ওসমান ও কলিম শরাফী। তাঁদের আগমনে চট্টগ্রামের শিল্পী সাহিত্যিকরা নড়ে চড়ে বসলেন। তখনো মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ বেঁচে; মাহবুব উল আলম, ওহীদুল আলম, আবুল ফজল, তাঁদের সৃষ্টির মধ্যগগনে স্বমহিমায় বিরাজ করছেন। আশুতোষ চৌধুরীর বয়স বার্ধক্যের কোলে হেলে পড়লেও তিনিও তখনো সমান সক্রিয় এবং তাঁর পুত্র সুচরিত চৌধুরী সাহিত্য ও সংগীতে নবারুণের দীপ্তি নিয়ে উদিত হয়েছেন। চিরঞ্জীব দাশশর্মা, গোপাল বিশ্বাস, মাহবুব উল আলম চৌধুরী, এবনে গোলাম নবী, মাহবুব হাসান, অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম, রাহুল আমিন নিজামী, সিরাজুল ইসলাম (আজিজ মিসির)-এমনি একদল প্রতিভাবান তরুণ তখন নানা সৃজনশীল কর্মপ্রবাহের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিভার প্রকাশ ঘটাতে উম্মুখ হয়ে উঠেছিলেন। এর ফলে জন্ম হয়েছিল সংস্কৃতি বৈঠক ও সীমান্ত পত্রিকার; ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে হরিখোলা মাঠে হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম সংস্কৃতি সম্মেলন। পরবর্তীকালে সংবাদ সম্পাদক আহমেদুল কবীর ও সায়ীদুল হাসান (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। চট্টগ্রামের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মযোগে তারাও এসে পড়লেন প্রাণের তাগিদে। পঞ্চাশের দশকের এই প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্মের অনেক বৈঠক কবিরাজ বিল্ডিংয়ে হতো।
দিদার আমাকে পরীক্ষার হল থেকে কবিরাজ বিল্ডিংয়ের দোতলায় দক্ষিণ পাশের একটি কক্ষে নিয়ে বসিয়ে বললো, এটা আমার নতুন লজিং বাড়ি। চরকানাই থেকে এসে উঠেছি। সে তার ছাত্র-ছাত্রীদের আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। তার মধ্যে একজন শাহীদ আনোয়ার, আর একজন তার বোন। ওর নাম আমার মনে নেই। দিদার তার ছাত্র-ছাত্রীদের খুব নাম করলো এই বলে যে, ওরা তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী, পড়াশোনায় উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আভাস দিচ্ছে। শাহীদের কথা বিশেষভাবে বললো, সে খুব ব্রিলিয়ান্ট। দিদারের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয়েছে। শাহীদ মেধাবী ছাত্র হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীতে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে শিক্ষা জীবন শেষ করেছে। পরে আমি বহুবার গিয়েছি কবিরাজ বিলিংয়ে।
পরবর্তীকালে আমি শাহীদকে একজন পলিটিক্যাল একটিভিষ্ট হিসেবে আবিষ্কার করি। সে ছাত্র ইউনিয়ন করতো এবং সমাজতন্ত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে। সে মুক্তিযুদ্ধে যেতে পারেনি, কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় সে ছিলো শিশু। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আবেগ এবং আগুন তার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিলো। সে খুব চরমপন্থী হয়ে পড়ে এবং তাকে একটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখার ন্যায় বিচরণ করতে আমি দেখেছি।
তখন শহরের বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে, রাস্তার মোড়ে, পার্কে উত্তপ্ত রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক, আবার সাহিত্য আড্ডাও হতো। ফুটপাথে এবং বুকস্টলে মার্কসীয় দর্শনের ওপর নানা বই প্রচুর সাহিত্য সাময়িকী পাওয়া যেত। শাহীদ এসব নিয়েই মেতে থাকতো। শাহীদের কবিপ্রতিভা ছিলো, সে কবিতা লিখতে শুরু করে। তার গদ্য লেখার হাতও ছিলো। নন্দনকাননে ফুলকি নামক একটি বাচ্চাদের স্কুলে সাহিত্যের আসর বসতো। ‘অচিরা’ নামে একটি পাঠশালা ছিলো এবং তা’ থেকে অচিরা নামে সাময়িকীও প্রকাশিত হতো। মোমেন ভাই (আবুল মোমেন) ছিলেন পাঠচক্রের সমন্বয়ক, অধ্যাপক তপন জ্যোতি বড়ুয়াও কোনভাবে যুক্ত ছিলেন অচিরা পাঠচক্রের সঙ্গে। মোমেন ভাই গুণী মানুষ। তিনি কবিতায় যেমন সিদ্ধহস্তে, গাদ্যেও তেমনি পারঙ্গম। ছোট ছোট বাক্যে চলিত শব্দের প্রয়োগে অসাধারণ গদ্য লিখতেন তিনি। আমার মনে হয় পিতৃবন্ধু অন্নদাশংকর রায়ের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। আবার অসাধারণ সংগঠক এবং সঙ্গীতের সমঝদার। চট্টগ্রামের অগ্রগণ্য রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও শিক্ষক শীলা বৌদি তাঁর সহধর্মিনী।
মোমেন ভাই’র সঙ্গে সাহিত্য আড্ডায় অংশ নেয়ার ফলে শাহীদের সাহিত্য প্রতিভার আরো বিকাশ ঘটে। কবিতার ছন্দ, অলংকার, আঙ্গিক সস্পর্কে সম্যক জ্ঞান অর্জনের ফলে তার কবিতা ভাব, ভাষা ও আঙ্গিকের দিক থেকে শিল্পোত্তীর্ণ হয়। তার কবিতার পেলবতা পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার তুলতো। শুধু শাহিদ নয়, অচিরা পাঠচক্র থেকে বিশ্বজিত চৌধুরী, ওমর কায়সার, জ্যোতির্ময় নন্দী, ইব্রাহিম আজাদ এবং আমার অজানা আরো অনেক শক্তিশালী কবি সৃষ্টি হয়েছে। শাহিদ এদের বন্ধু ছিলো। ইউসুফ মুহম্মদ ও অজয় দাশগুপ্ত অচিরা পাঠচক্রের বৃত্তে জড়িয়ে ছিলো কিনা আমার সঠিক জানা নেই, তবে তাদেরকে প্রায় সারাদিন ফুলকিতে ঘুরঘুর করতে আমি দেখেছি। অচিন্ত্য, আলোকময় তলাপাত্র, দুলাল দাশগুপ্তও দিনভর ঘুরে ঘুরে ফুলকিতেই কাটাতো। চট্টগ্রামে আশির দশকে একটি সাহিত্যিক প্রজন্ম সৃষ্টির জন্য ‘অচিরা’- কে কৃতিত্ব দিতেই হয়।
শাহিদ আমেরিকার বিশ্বব্যাপী কোন রচনা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং তার রচনা নির্বাচিত হয়। সে সম্ভবত ছ’মাস বা এক বছর আমেরিকা থাকার সুযোগ পেয়েছিলো। এই ঘটনা থেকে শাহীদের প্রতিভার খানিকটা আন্দাজ করা যায়।
১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে নতুন পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণ প্রকাশিত হলে আমি সেখানে যোগ দিই। মোমেন ভাই ছিলেন পত্রিকাটির মুখ্য সংগঠক, তাঁর টানে পূর্বকোণে ফুলকির কবিদের মেলা বসে যায়। কায়সার, বিশ্বজিত, জ্যোতির্ময়, শাহিদকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম পূর্বকোণের নিউজ ডেস্কে। ফারুক ইকবালও ফুলকিতে নিয়মিত হাজিরা দিতো এবং মাঝে মধ্যে কবিতা নিয়ে উপস্থিত হতো অচিরা পাঠচক্রের সাহিত্য সভায়।
তবে ফারুকের গদ্যের হাত ছিলো ভালো। পূর্বকোণে কাজের সূত্রে প্রমাণ পেলাম কায়সার, বিশ্বজিত, শহীদ, জ্যোতির্ময় গদ্যেও কম নয়। সাহিত্যের সৃষ্টিশীল ও চিন্তাশীল উভয় শাখাতেই তারা সমান স্বচ্ছন্দ। ফারুক ইকবাল অবিলম্বে পূর্বকোণের দপ্তরে দাখিল হয়ে গেলো। তবে সে এলো রিপোর্টার হয়ে। তার বস্‌ ছিলো মোহাম্মদ বেলাল, তিনিও ফুলকি বলয়েরই মানুষ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুরাগী।
শাহিদ ডেস্কে অনুবাদের কাজ করতো। জ্যোতির্ময়ও তাই। শাহিদ এক সময় আজাদীতে চলে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত সেখানে থাকেনি। আমি আবার তাকে পূর্বকোণে নিয়ে আসি।
বলতে ভুলে গেছি, শাহিদ কলেজে অধ্যাপনা করতো। দীর্ঘদিন ইসলামিয়া কলেজে ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করেছে। শিক্ষক হিসেবে সে সফল এবং ছাত্রপ্রিয় হয়েছিলো।
শাহিদকে নিয়ে এই আলোচনার সূত্রে তার বন্ধু জ্যোতির্ময়, কায়সার, বিশ্বজিত, ফারুক ইকবাল সম্পর্কে শেষ যে কথাটা আমি এখানে বলতে চাই সেটা হলো চট্টগ্রামের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সাংবাদিকতায় তারা একটি উজ্জ্বল সংযোজন। তারা একটি সাহিত্য রুচি ও ধারার প্রবক্তা; শিখা গোষ্ঠী বা কল্লোল গোষ্ঠীর মতো চট্টগ্রামের সাহিত্যের ইতিহাসে তারা একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত হতে পারে কিনা তা বলার মতো বিদ্যা আমার নেই। তাঁদের শাস্ত্রগুরু চট্টগ্রামের সাহিত্যের একজন দ্রোণাকার্য আবুল মোমেন।
একটি অশান্ত, অস্থির, চঞ্চল কবিপ্রতিভা ছিলো শাহিদ আনোয়ার; বন্ধু, সহকর্মী, সতীর্থ কারো সঙ্গে তার তুলনা চলে না। তীব্র মেধা তাকে সাধারণের গন্ডী থেকে উর্ধে তুলে নিয়ে অসাধারণত্বের মহিমা দান করেছিলো। সে কারণে চিন্তার জগতে সে ছিলো একা, বিচ্ছিন্ন; নীটশে, জাঁ পল সার্ত্রের অস্তিত্ববাদ বা চেতনাপ্রবাহ রীতির এক ধ্রুপদী উদাহরণ ছিলো শাহীদ আনোয়ার। সে যা খুঁজে ফিরতো জীবনে তার সন্ধান পায়নি। ফলে আবেগের উষ্ণ প্রস্রবনে অবগাহন করতে করতে সে একদিন চেতনার নগত থেকে অবচেতনে ডুবে যায়।
পুনশ্চ : কবি, অধ্যাপিকা, নারী নেত্রী ও সাবেক ছাত্রনেত্রী সেলিনা শেলীর মতো একজন প্রণয়িনী ও সহধর্মিনী পাওয়া ছিলো শাহিদের জীবনে অনেক না পাওয়ার মধ্যে একটি বড় পাওয়া। শেলী সংসারটা ঠিকটাক গুছিয়ে রেখেছিল বলে উচ্ছন্নে যায়নি। একারণে শেলী চট্টগ্রামের বিদগ্ধজনের ধন্যবাদার্হ।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সস্কৃতি সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব ও আজকের প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধসিএসইতে লেনদেন ৯১.৩৮ কোটি টাকা