জ্বর, সর্দি ও কাশি নিয়ে গত শুক্রবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন পটিয়ার নূর মোহাম্মদ। শারীরিক অবস্থা অবনতি হলে রাত ৮টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে কোভিড-১৯ রোগীর জন্য বরাদ্দ রাখা আইসিইউতে ভর্তির জন্য সুপারিশ করেন। কিন্তু আইসিইউর কর্তব্যরত চিকিৎসক ভর্তি করাতে আপত্তি করেন। তার বক্তব্য, ‘নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাস শনাক্ত না হলে ভর্তি করা যাবে না’। ঘণ্টাদুয়েক পর ওয়ার্ড বয় পরিচয়ে এক ব্যক্তি নূর মোহাম্মদের ছেলে মো. আবদুল করিমের কাছে আউসিইউ বেড ব্যবস্থার প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে দাবি করেন ১০ হাজার টাকা। শেষে ৭ হাজার টাকা দিতে রাজি হন করিম। টাকা পরিশোধের কিছুক্ষণের মধ্যেই আইসিইউ বেডে ভর্তি করা হয় নূর মোহাম্মদকে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আইসিইউ সরঞ্জাম স্থাপন করার আগেই মারা যান তিনি।
নূর মোহাম্মদের ছেলে আবদুল করিমের দাবি অনুযায়ী, তার পিতার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগের দৃশ্যপট ছিল এটি। তবে নূর মোহাম্মদের মৃত্যু চমেক হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা ঘিরে কয়েকটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তার স্বজনদের প্রশ্ন, ওয়ার্ডের চিকিৎসক সুপারিশ করার পরও আইসিইতে কর্তব্যরত চিকিৎসকের ভর্তি করাতে আপত্তি ছিল কেন? কোভিড পজিটিভের দোহাই দিয়ে ভর্তি করাতে না চাইলেও ওয়ার্ড বয় কীভাবে আইসিইউ শয্যার ব্যবস্থা করলেন? তবে কি চমেক হাসপাতালের ওয়ার্ড বয় কর্তৃপক্ষের চেয়েও ক্ষমতাধর? কেউ কেউ এটাও বলছেন, ওয়ার্ড বয়কে সামনে রেখে আড়ালে কেউ অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন না তো? সর্বোপরি আইসিইউ বেড খালি থাকার পরও রোগী ভর্তি করাতে বাধা কোথায়?
যেভাবে ঘটনাটি সামনে এল : বোরহান উদ্দিন নামে পটিয়ার এক ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গতকাল দুপুরে একটি পোস্ট করেন। তিনি লিখেন, চট্টগ্রাম মেডিকেলের আইসিইউতে কোনো ধরনের সিট নেই, কয়েক ঘণ্টা এদিক সেদিক ছোটাছুটি। পরে সেই না থাকা সিট ওয়ার্ড বয় কর্তৃক ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে ব্যবস্থা, স্বস্তির নিশ্বাস। তবে! ততক্ষণে আমার পাশের পাড়া, আদু তালুকদার বাড়ির নুর মোহাম্মদ (করিমের পিতা) এর নিশ্বাস চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। উনার ছেলের আপসোস; ওয়ার্ড বয় যদি ৭ হাজারের পরিবর্তে ৭০ হাজার টাকা নিয়ে হলেও তার পিতাকে হয়রানি না করে সাথে সাথে আইসিইউতে সিট দিত তবে উনি বেঁচে যেতেন।
বোরহান উদ্দিন আজাদীকে বলেন, আমিও আইসিইউর জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলাম। পাইনি। শেষে দুই-তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করিয়ে টাকা দিয়ে পেলেও ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমাদের হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা বিস্ময়কর। লোকটাকে আগে ভর্তি করা গেলে হয়ত বাঁচানো যেত।
নিহত নূর মোহাম্মদের ছেলে আবদুল করিম আজাদীকে বলেন, ওয়ার্ডে অঙিজেন চলছিল। বাবার অঙিজেন লেবেল যখন ৮৮-তে চলে আসে তখন আইসিইউতে ভর্তির জন্য সুপারিশ করে। আমি গিয়ে দেখে এসেছি, আইসিইউ বেড খালি ছিল। তবু সেখানকার ডাক্তার ভর্তি করাননি। তারা বলেছেন, কোভিড টেস্টে পজিটিভ রিপোর্ট না হলে করাবেন না। কিন্তু ওই মুহূর্তে তো টেস্ট করা সম্ভব না। আমি এটাও বলেছিলাম, জরুরি ভিত্তিতে টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট পাওয়া যাবে কিনা। তারা না বলেছেন। ১০টা পর্যন্ত যে ডিউটি ডাক্তার ছিলেন, বাবাকে ভর্তি করানোর জন্য তার পায়ে ধরতে চেয়েছি। তিনি করাননি। প্রয়োজনে কোভিড রোগী এলে বাবাকে নিয়ে যাব বলেছিলাম। তবু করাননি। ওনার পরে আরেকজন ডিউটি ডাক্তার আসেন। তিনিও করাননি। তারও একই কথা ছিল।
আবদুল করিম বলেন, বিভিন্ন হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম। রাত ১১টার দিকে বাবাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় একজন এসে আমাকে পরিচয় দেয় ওয়ার্ড বয়। তাকে খুশি করলে তার আত্মীয় পরিচয়ে আউসিইউতে ভর্তি করিয়ে দেবেন। সে ১০ হাজার টাকা দাবি করে। পরে ৭ হাজার টাকায় রাজি হয়। সিসি ক্যামেরা আছে বলে ওয়ার্ড বয় আমাকে একটা ছোট রুমে নিয়ে গিয়ে টাকা বুঝে নেয়। এর কিছুক্ষণ পর বাবাকে আইসিইউতে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লাগাতে লাগাতে মারা যায় আমার বাবা।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আফতাবুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, ওয়ার্ড বয়ের নাম উল্লেখ করে অনিয়মের বিষয়টি লিখিতভাবে জানালে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। এখানে অনেক ওয়ার্ড বয় আছে এবং আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমেও অনেকে কাজ করে। কাজেই সুনির্দিষ্টভাবে না বললে কার বিচার করব, কাকে ধরব। নামটা উল্লেখ করতে হবে।
তিনি বলেন, ঘটনাটি সঠিক কিনা সেটাও আমরা জানি না। তাই ঘটনাটি খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ এ ধরনের অনেকে অভিযোগ করেন, কিন্তু তদন্ত করতে গেলে দেখা যায়, ঘটনা সঠিক না। বিভিন্ন সময়ে ভুয়া অভিযোগও আসে।
উপ-পরিচালক বলেন, মেহেরবানি করে উনাদের অভিযোগটা লিখিতভাবে জানাতে বলেন। সত্য হলে অবশ্যই দোষীর বিচার করব। অনিয়মের কারণে তিন-চার মাস আগে কয়েকজনকে বরখাস্ত করেছি।
কারো আইসিইউ বেডের দরকার হলে সরাসরি হাসপাতালের পরিচালকের সাথে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, নরমাল এবং কোভিড আইসিইউ ডাইরেক্টর সাহেব নিয়ন্ত্রণ করেন। আইসিইউ বেডের জন্য অনেকে রিকোয়েস্ট করে। তাই এ বিষয়ে একজনকে নির্ধারণ করা হয়েছে। কারণ, একেকজন সিদ্ধান্ত দিলে এলোমেলো হয়ে যায়। কারো যদি আইসিইউ বেডের দরকার হয় তাকে সরাসরি ডাইরেক্টর সাহেবের সাথে যোগাযোগ করতে বলব। উনার সামনে আইসিইউ সংক্রান্ত সমস্ত অফিসিয়াল তথ্য থাকে। কয়টা সিট খালি আছে, কাকে রিলিজ করা হবে এসব তথ্য তিনি জানেন।