সুন্দর এক সন্ধ্যায় ক্লশেস দ্য কার্নিভালে অপেরা দেখতে বসেছিল ইভান দিমিত্রিচ চেরভেয়াকভ। একজন সরকারি কেরানী সে। চোখে অপেরা-চশমা পরে দর্শক আসনের দ্বিতীয় সারিতে বসে অপেরাটি দেখছিল। দেখতে দেখতে হঠাৎই তার মনে হলো, হাঁচি আসছে! হঠাৎই! গল্প-উপন্যাসে লেখকেরা যেমন লেখেন, “কিন্তু হঠাৎই…”! লেখকেরা ঠিকই লেখেন, জীবনে কিছু ঘটনা না-বলে-কয়ে হঠাৎই ঘটে। ঠিক সেরকমই হঠাৎই তার হাঁচি লাগলো। মুখের আদল বদলে গেল, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো, এক মুহূর্ত দমটাও যেন বন্ধ হলো! অপেরা-চশমাটা খুলে, একটু ঝুঁকে ‘হ্যাঁচ্চো’ দিলো সে। হাঁচি তো সকলেই দেয়। যে কোনো সময়ে যে কারোরই হাঁচি আসতে পারে। দরিদ্র একজন মানুষ থেকে শুরু করে বড় পুলিশ অফিসার, সরকারি আমলা, সকলেরই। তো, এটা নিয়ে সে খুব একটা বিব্রত হলো না। মুখটা মুছে নিল রুমাল বের করে। এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, হাঁচির শব্দে অন্য কেউ বিরক্ত হলো কিনা! ঠিক তখুনি সে দেখলো, সামনের সারিতে তার সামনেই বসা একটি লোক রুমাল দিয়ে নিজের টাক মাথাটি মুছছে। ঘাড় মুছতে মুছতে নিজে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে। এবার চেরভেয়াকভ ঘাবড়ে গেল। কেননা, লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। পরিবহন মন্ত্রনালয়ের সিভিলিয়ান জেনারেল ব্রিজালভ-ই এই সামনের সারিতে বসা দর্শক।
“যদিও তিনি আমার বিভাগের জেনারেল নন। তারপরেও বিষয়টি বিব্রতকর আমার জন্য আর বিরক্তিকর তার জন্য। অবশ্যই আমার দুঃখপ্রকাশ করা উচিত”। সে ভাবলো। এবং একটু এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে জেনারেলের কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “আমি দুঃখিত হাঁচি দেয়ার জন্য। মার্জনা করবেন”।
“না, না। কোনো সমস্যা নেই”।
“না, মানে, আমি ইচ্ছে করে হাঁচি দিইনি। আমি খুবই লজ্জিত”।
“বলছি তো, কিছু মনে করিনি আমি। আপনি শান্ত হয়ে বসুন”।
তবুও তার অস্বস্তি কাটলো না। নিজের আসনে বসে অপেরা দেখছিল ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। যেই না বিরতির ঘন্টা বাজলো, সে উঠে গিয়ে জেনারেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। আবারো বললো, “আমি সত্যিই হাঁচিটা ইচ্ছে করে দিইনি। আমাকে ক্ষমা করবেন”।
জেনারেল এবার খুবই বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন, “ওহ! আপনি দয়া করে থামবেন! আমি এটা মনেও রাখিনি। যথেষ্ট হয়েছে। আর নয়”।
“জেনারেল বলছে বটে, মনে রাখিনি; কিন্তু তার চোখ তো তা বলছে না”…সে ভাবতে থাকলো। “তিনি কথা বলতে চাইছেন না। কিন্তু আমাকে তো বুঝিয়ে বলতে হবে, এটা হঠাৎই হয়ে গেছে। আর এটা তো প্রাকৃতিক একটা বিষয়। আমি ইচ্ছে করে হাঁচি দিতেও পারি না, আটকাতেও পারি না। তিনি এখন হয়তো কিছু ভাবছেন না। কিন্তু পরে তো ভাবতে পারেন, আমি ইচ্ছে করে হাঁচি দিয়েছি”!
বাড়িতে ফিরে গিয়ে সে তার স্ত্রীকে সব খুলে বললো। স্ত্রী খুব একটা পাত্তা দিলো না, যখন শুনলো, জেনারেল তার বিভাগের কর্মকর্তা নন।
“তারপরেও তুমি গিয়ে আরেকবার দুঃখপ্রকাশ করে এসো। নইলে তিনি ভাবতে পারেন, তুমি এই সৌজন্যতাগুলো জানো না”। ওর স্ত্রী বললো।
“আমি দুঃখিত বলেছি বারবার। কিন্তু তিনি কেন যেন কথা শুনতে চাইছিলেন না। আর ওখানে এত কথা বলার পরিবেশও ছিল না”।
পরদিন সে ইস্তিরি করা ইউনিফর্ম পরে, চুল ছেটে, পরিপাটি হয়ে জেনারেলের অফিসে পৌঁছালো। সামনের ঘরে আরো কিছু মক্কেলের সাথে তিনি তখন আলাপ করছিলেন। চেরভেয়াকভ অনেকক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে তার অবসর বুঝে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
“কাল আর্কেডিয়ায়…… স্যার আমাকে মনে করতে পেরেছেন? হঠাৎই হাঁচি চলে এসেছিল…আমি ইচ্ছে করে দিইনি…”
“কী পাগলামি এগুলো! সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে”। জেনারেল বিরক্ত হয়ে অন্য একজন মক্কেলের দিকে ফিরে বললেন, “বলুন আপনার কী কাজ?”
“তিনি কথা বলতে চাইছেন না। তার মানে এখনো রেগে আছেন। কিন্তু আমাকে তো ক্ষমা চাইতেই হবে”। নিজে নিজে ভাবতে লাগলো সে। এরপর মামলার কাজ শেষ করে জেনারেল যখন ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন, সে আবার পাশে গিয়ে বলতে শুরু করলো, “আমার খুবই লজ্জা লাগছে। বিশ্বাস করুন, ইচ্ছে করে আমি কাল হাঁচিটা দিইনি। আমি বুঝতে পারছি আপনি এটায় খুব বিরক্ত হয়েছেন”।
বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেলেন জেনারেল এবার। ভ্রূটা কুঁচকে বললেন, “কেন তুমি আমার সময় নষ্ট করছো? এই তামাশার মানে কী”? বলেই বন্ধ করে দিলেন দরজা।
“তামাশা করছি আমি? তিনি কেন বুঝতে পারছেন না, এটা সত্যিই বিব্রতকর। আমার অবস্থাটা তাকে বোঝাতেই হবে। আচ্ছা, এভাবে না হলে আমি তাকে চিঠি লিখবো। এতে নিশ্চয়ই তিনি বুঝবেন। রাগ পড়ে যাবে”। সে ভাবলো।
সেদিনের মতো বাড়ি ফিরে এলো সে। সন্ধ্যায় বসে অনেকক্ষণ ভাবতে থাকলো। কিন্তু চিঠিটা কোনোভাবেই মনের মতো লিখতে পারলো না। অগত্যা পরেরদিন দেখা করে আবারো তাকে বলবে, এটাই ঠিক করলো।
পরদিন আবারো গেল। জেনারেল তার দিকে তাকাতেই সে বলা শুরু করলো, “এটাকে তামাশা বলবেন না। আমার কি সেই স্পর্ধা আছে, যে আপনার মতো মানুষের সাথে তামাশা করবো! সেই সন্ধ্যায় আমি সত্যিই আপনাকে বিরক্ত করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, হাঁচিটা আমি ইচ্ছে করে দিইনি। আপনি আমার সম্মানীয় মানুষ। ইচ্ছে করে এ কাজ আমি করতেই পারি না…”
তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “বেরিয়ে যাও এক্ষুনি!” রাগে জেনারেলের মুখটা বেগুনি দেখাচ্ছিল।
“জি! কী বলছেন!” ভয়ে তার মুখে কথা আটকে গেল।
“বেরিয়ে যাও”।
শুনে কেমন যেন অসাড় হয়ে গেল সে। তার মনে হচ্ছিল, পেটের মধ্যে হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা। মাথাটাও। যন্ত্রচালিত মানুষের মতো হেঁটে রাস্তায় নেমে এলো ধীরে ধীরে। কিছুই সে শুনতে পাচ্ছিল না, দেখতেও পাচ্ছিল না। বাড়িতে ফিরে এলো। অফিসের ইউনিফর্ম না খুলেই সামনের সোফাটায় বসে এলিয়ে পড়লো। দু’দিনের সমস্ত উদ্বেগ, অস্থিরতার অবসান হলো যেন! সেখানেই মৃত্যু হলো তার।