র্যাচেল কারসন জন্মেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ার স্প্রিংডেইলে ১৯০৭ সালে। মারাও গেছেন ১৯৬৪ সালে। কিন্তু পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা করার কাজ করার জন্য তিনি এখনো স্মরণীয়। বিশেষ করে, রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার কীভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে, সেসবের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই র্যাচেল প্রকৃতির প্রতি নিখাদ ভালোবাসা ধারণ করতেন। পরিবেশের প্রতি আগ্রহটা মা–ই তাঁর মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। হয়তো তাঁর মা বুঝতেও পারেননি যে এই মেয়ে একদিন পৃথিবী রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবেন। মাত্র ১০ বছর বয়স থেকে র্যাচেল লেখালেখি শুরু করেন। প্রকৃতির প্রতি প্রেম তাঁকে জীববৈচিত্র্য নিয়ে পড়াশোনা করতে বাধ্য করে। তিনি প্রাণিবিদ্যা বিষয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ইউএস ব্যুরো অব ফিশারিজে ১৫ বছর চাকরি করেন তিনি। মূলত ব্রোশার ও অন্যান্য কনটেন্ট লেখার কাজ করতেন। পরে ইউএস ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফের সব প্রকাশনার জন্য প্রধান সম্পাদক হিসেবে পদোন্নতি পান। এ সময়ের মধ্যে র্যাচেল কয়েকটি বই লিখে ফেলেন। এগুলোর মধ্যে ‘আন্ডার দ্য সি উইন্ড’ (১৯৪১) ও ‘দ্য সি অ্যারাউন্ড আস’ (১৯৫২) উল্লেখযোগ্য। বইগুলো বেশ বিক্রি হয়েছিল। র্যাচেল ও খ্যাতির সঙ্গে পেয়ে যান ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড, ন্যাশনাল সায়েন্স রাইটিং প্রাইজ এবং গুগেনহাইম ফেলোশিপ। ১৯৫৩ সালে তিনি সাউথ পোর্ট দ্বীপে চলে যান লেখালেখি করতে। ১৯৫৫ সালে প্রকাশ করে ফেলেন তাঁর আরও একটি বিখ্যাত বই ‘দ্য এজ অব দ্য সি’।
একবার ম্যাসাচুসেটস থেকে এক বন্ধু চিঠি পাঠালেন র্যাচেলকে। চিঠিতে লেখা ছিল কীটনাশক প্রয়োগের কারণে পাখি মরে যাওয়ার কথা। র্যাচেল এটা শুনে লিখে ফেললেন তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় বইটি। কীটনাশক যে শুধু প্রকৃতির জীববৈচিত্র্যের বাস্তুসংস্থানেরই ক্ষতি করে না, মানুষেরও ক্ষতি করে– সে কথাগুলো র্যাচেল তাঁর বইয়ে বর্ণনা করেছেন। লিখেছেন ক্যানসারের কথাও।
র্যাচেল তাঁর বইগুলোর মাধ্যমে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তিনি রাসায়নিক কারখানাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। সেসব কারখানা জনগণের কাছে রাসায়নিক দ্রব্য সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াত। রাসায়নিক প্রতিষ্ঠানগুলো উল্টো র্যাচেলকেই দোষ দেওয়া শুরু করে এই বলে যে তিনি কমিউনিস্ট এবং হিস্টেরিয়াগ্রস্ত নারী! তবু র্যাচেল কারসন চুপ থাকেননি। পরিবেশ বাঁচাতে, জীববৈচিত্র্য বাঁচাতে সজাগ থেকেছেন সব সময়।
আসলেই শুধু র্যাচেল কারসন নন, আমরা দেখছি, প্রকৃতি ও পরিবেশের সাথেই তো মানুষের চির অবস্থান। আর পরিবেশের সাথে তো নারীর আমৃত্যু ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকে। অনেক কিছু মিলও খাপ খেয়ে যা নারীর জীবন চিত্রের সাথে। তাই সুন্দর পরিবেশ নারীকে সুরক্ষায় রাখে বেশি। পরিবেশবিদ ওয়াগারি মাথাই বলেন ‘The impact of environmental degration hits our women and Children most’ পাশাপাশি নারীকেও পরিবেশ সুরক্ষায় এগিয়ে আসিতে হবে আরো বেশি হারে। আমাদের চারপাশে যা বিদ্যমান– তা নিয়েই তো আমাদের পরিবেশ।
আমরা জানি, একজন নারী সহজাত কারণেই যে কোনো বিষয়ে পুরুষের চেয়ে বেশি যত্নশীল ও উৎসাহী। পরিবেশ বাঁচানোর ক্ষেত্রেও নারীদের এই আগ্রহ এই গুণ আমরা কাজে লাগাতে পারি। জীব বৈচিত্র্যের ধ্বংস, মানুষের স্বাস্থ্য হানি, পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের সমূহ বিপর্যয়–যার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসকেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে সবচেয়ে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে নারী ও শিশুরা। নারী কাজ হারায়, অপুষ্টির শিকার হন, স্বাস্থ্যহানি হয়। প্রকৃতি সুস্থ না থাকলে সুস্থ ও স্বাভাবিক সন্তান জন্ম দিতে পারে না। আর অসুস্থ মানবসন্তান নিজেকেই রক্ষা করতে পারবে না। তাই প্রকৃতির জন্য বা পৃথিবীর জন্য চাই সুস্থ মানবসম্পদ।
সব দিক বিবেচনা করে পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনে নারীর অংশগ্রহণ ও আন্দোলনে নারীর নেতৃত্বদান পরিবেশ রক্ষায় বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। এ বিশ্বকে সবার জন্য নিরাপদ, সুস্থ, জঞ্জালমুক্ত ও বাসযোগ্য ভূমিতে পরিণত করতে নারীর ভূমিকা অগ্রগণ্য।
পরিবেশ বিপন্ন হলে পৃথিবীই ভয়াবহ দুর্দশা ও ধ্বংসের মুখে পড়বে। তাই সবার উচিত প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হওয়া।
পরিবেশ সুরক্ষার জন্য নারীদের সচেতনতা আরো বেশি জরুরি। কারণ এখনো নারীরাই ঘর বেশি সামলান, চারপাশটা বেশি দেখভাল করেন। তাই তাদের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। পরিবেশের প্রতি নারীদের সংবেদনশীল আচরণে দায়িত্ব পালন অব্যাহত রাখতে হবে। সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। তাহলেই হয়তো আমাদের চারপাশ সবদিক থেকে সুন্দর ও স্বাভাবিক হবে।
পরিশেষে, কবি সুকান্ত ভট্টচার্যের ভাষায় বলতে হয়–
‘চলে যাব, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক‘রে যাব আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
লেখক: নারীনেত্রী, লেখক ও সংগঠক