চট্টগ্রামের জেলায় বাঁশখালী উপজেলার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী খানখানাবাদ গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত বিত্তবান মুসলিম পরিবারে ১৯২৭ সালে এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের জন্ম। তাঁর জন্ম স্থানের বৈশিষ্ট, সময়কাল পারিপার্শ্বিক নানা বিষয় বিশ্লেষণ করলে প্রয়াত এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবকে দিয়ে ইতিহাসের স্থান, কাল, পাত্রের বৈশিষ্ট নির্ণায়ক একটি চিত্র বা এককের সন্ধান পাওয়া যাবে। গবেষকদের পাকা হাত সেদিকে চালনা করলে প্রজন্মের কাছে অজানা অনেক ইতিহাস পরিষ্কার হয়ে উঠতে পারে। এই এলাকায় যেমন আছেন আউলিয়া বুজুর্গ সাধু পুরুষ, তেমনি আছেন প্রখ্যাত মধ্যযুগীয় শীর্ষস্থানীয় কবি চুহর পণ্ডিত ও আমির আলী পণ্ডিত। কলিকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত মোহাম্মদী পত্রিকার সম্পাদক শাহ মোহাম্মদ বদিউল আলম, মৌঃ আবদুল কাদের, খান বাহাদুর মৌঃ গোলাম কাদের, শিক্ষাবিদ যোগেশচন্দ্র সিং, ভাস্বর নভেরা আহমেদ, প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক রম্য লেখক সাম্যবাদি চরিত্রের ধারক গণমানুষের সাথী অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম, সাধু অদ্বৈতানন্দ পুরী, রামজীবন বিদ্যাভূষন, রাজনীতিক মৌঃ নজির আহমদ চৌধুরী সহ আরো অনেক গুণীজন। বাঁশখালীতেই সরল গ্রামের ঐতিহাসিক মালেকাবানুর পরিবার, বাহারচরায় খান এ খানান দরফ খার পরিবার, লেং খান পরিবার, খানখানাবাদে কালাগাজী পরিবার সহ আরো অনেকেই তাদের পরিবারের বিদেশ থেকে আগমনের সূত্র বর্ণনা করে থাকেন। অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদের পরিবারও প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম স্যারের মতে আফগান বংশোদ্ভূত। লেখক নিজেকেও সূত্র বিশ্লেষণ করে আফগান বংশোদ্ভূতদের বলে মনে করেন।
এই সমুদ্র উপকূলে আবদুস ছবুর সাহেবদের বাড়ি সংলগ্ন এলাকাতেই ছিল এক সময়কার পর্তুগীজ পোর্ট এবং ফোর্ট, যার নাম অঙ্গারকেলী, যেখান থেকে পর্তুগীজরা চট্টগ্রাম এবং বার্মায় তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ও আধিপত্য বিস্তারের কার্যক্রম পরিচালনা করত। (সূত্র: বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য – ড. আবদুল করিম)
খানে খানান দরফ খানের নামে বাহারচরায় দরফখাঁ দীঘি ও ১৫৫৬ খৃীঃ সুলতান দাউদ কররানীর আমলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রাচীনতম মুসলিম স্থাপনা দরফখাঁ মসজিদ নির্মিত হয়। তার ভাইদের মধ্যে জাহিদ খান ও তৈয়ব খানের নামে দু’টি দীঘির নামকরণ করা হয়। খানে খানান দরফ খানের সূত্র থেকে অথবা তিনি নিজে খানখানাবাদ নামক জায়গার নামকরণ করেন। (সূত্র : দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রচীনতম মুসলিম স্থাপনা দরফ খান মসজিদ –মুহাম্মদ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কতৃর্ক প্রকাশিত প্রবন্ধ)।
এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের বাড়ী সমুদ্র পাড়ের খানখানাবাদ গ্রামে। যদিও তাঁদের মূল আবাসস্থল একই গ্রামের পশ্চিমাঞ্চল সমুদ্রগর্ভে বিলিীন হয়ে যায় ৫০/৬০ বছর আগে। বর্তমানে তাঁরা প্রায় দেড় কিলোমিটার পিছনে (পূর্বে) এসে আবাস তৈরী করেছেন। তাও এখন ভাঙনের আশংকাজনক অবস্থানে পৌঁছেছে। এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের পূর্ব–পুরুষগণও সাগর পথে বিদেশ থেকে এসে এই জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিলেন বলে প্রকাশ আছে ।
এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের পিতার নাম আবদুল লতিফ। তিনি খানখানাবাদ ইউনিয়নের প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং এলাকায় ‘সাহেব’ নামে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। একই সময়ে বাহারচরা ইউনিয়নেরও প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফয়জুল্লাহ মাস্টার। সে সময় জেলা পরিষদই ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট মনোনীত করতো। তথিত আছে যে, তখন প্রথম প্রেসিডেন্ট এর গ্রামের নামেই ইউনিয়নের নামকরণ করা হতো। এই দুই ইউনিয়নের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের বাড়ীর মতোই মরহুম ফয়েজুল্লাহ মাস্টারের বাড়ীও প্রায় ৮০ বছর আগে সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, পুর্বপুরুষ থেকে আবদুল লতিফ সাহেবের পরিবারটি গ্রামের একটি শিক্ষিত পরিবার নামে পরিচিত ও খ্যাত। আবদুল লতিফ সাহেবের অন্য এক চাচাতো ভাই শ্রদ্ধেয় মরহুম আবদুল্লাহ মাস্টারকে আমি খুব কাছ থেকে চিনতাম। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ শিক্ষকতা পেশায় আমার বাবার (মরহুম ছাবের আহমদ মাষ্টার, রত্নপুর) সহকর্মী ছিলেন। ছিলেন একজন আদর্শ লোকের প্রতিভূ। তাঁর দুই ছেলে মরহুম মোহাম্মদ ইসমাইল ও হাফেজ মোহাম্মদ ইসহাক সাহেবের সাথে আমার সখ্যতা ছিল এবং আছে। ঘনিষ্ঠভাবে চলাফেরার দরুণ এই পরিবারের আরো অনেকের সাথে আমার পরিচয় ঘটেছে। কারো কারো সাথে ঘনিষ্ঠতাও ছিল কিংবা আছে। ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে বিশেষভাবে প্রয়াত হুমায়ুন আহমেদ, নুর মোহাম্মদ মাষ্টার প্রমুখ অন্যতম।
এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবরা ছিলেন চার ভাই। অপর তিন ভাই হলেন – মরহুম আবদুল মোমন (ইউ.পি সদস্য ছিলেন), মরহুম নুরুল কবির মাস্টার ও মরহুম হুমায়ুন কবির। স্ব স্ব অবস্থানে থেকে সবার চলাফেরা, আচার–আচরণ, ব্যক্তিগত ব্যবহার এমনকি খাবার–দাবারের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আমাকে বরাবরই আকৃষ্ট ও মোহিত করে আসছে।
এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেব – আনোয়ারা তৈলারদ্বীপের ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ী ‘সরকার বাড়ী’র বুজুর্গ মৌলানা আবদুর রহমান সাহেবের দৌহিত্র। প্রয়াত আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক রাষ্ট্রদূত মরহুম আতাউর রহমান খান কায়সার (এম.এন.এ ১৯৭০) ছিলেন তাঁর (চাচাতো) মামাতো ভাই।
বয়সের বিরাট ফারাক থাকা সত্ত্বেও শ্রদ্ধেয় এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেবের সাথে রাজনীতির সুবাদে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিলো। তিনি আমাকে এক প্রকার নিজে থেকেই কাছে টেনে আন্তরিকতার সহিত আলাপ করতেন, স্নেহ করতেন। মৃত্যুর আগে তাঁর বেয়াইন জনতা ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজার শ্রদ্ধেয় খুরশীদ জাহান আপার মাধ্যমে আমাকে তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার বিলম্বের কারণে সেই দেখাটি হয় নাই। যার জন্য আমি এখনো অনুতপ্ত। পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য সন্তানদের সাথেও আমার আন্তরিক যোগাযোগ ঘটে। এসব পরিচিতির ভূমিকা প্রদানর পেছনে আমার উদ্দেশ্য এই যে, এই পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে আমি যে চূড়ান্ত ভদ্রতা, সৌজন্যবোধ, রূচিবোধ. স্বাতন্ত্র্য, সারল্য, মাত্রাবোধ, শালিনতাবোধ, উন্নত মননশীলতার প্রকাশ দেখতে পেয়েছি তাতে আমি ও আমার চিন্ত চেতনা বিশষভাবে স্পর্শিত হয়েছে। বর্ণিত সব ব্যক্তির মধ্যে এতসব গুণের ‘ংড়ঁহফ ঁহরভড়ৎসরঃু’ বা ‘নীরব সামঞ্জস্য’ – ভাবলে আমাকে আপ্লুত করে, এমনকি এর সূত্র খোঁজার গবেষনায় প্রলুব্ধও করে বৈকি।
শ্রদ্ধেয় ছবুর সাহেবকে তাঁর পিতা যে আমলে কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নের জন্য পাঠিয়েছিলেন, তাও আমাদের এলাকার একজন লোকের পক্ষে বিশেষ প্রজ্ঞাপূর্ণতার বিষয় বটে। তথায় প্রসিদ্ধ বেকার হোস্টেলে অবস্থানকালে তিনি শেখ মুজিবুর রহমান–এর রুমমেট ছিলেন এবং তাঁর ঘনিষ্টতা লাভ করেন। কালে উভয়ে হয়ে উঠেন ঘনিষ্ঠ ও পরম বন্ধু, যা অজীবন বজায় ছিল। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু পরবর্তীতেও তিনি ছিলেন মৃত বন্ধুর চিন্তা, চেতনা ও মননের একজন প্রকৃত সারথি হয়ে। তোয়াক্কা করেন নাই কোথায় কখন কি পদ দখল করে থাকতে হবে। এ যেন আদর্শকে সমুন্নত রাখার অনন্য দৃষ্টান্ত।
কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই তিনি চট্টগ্রাম জেলায় দল সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ১৯৬৮ সালে এম.এ. আজিজের বিশেষ অনুরোধে তিনি বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের প্রথম কমিটির সভাপতির দায়িত্ব নেন। সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন এম.এ আজিজের আর এক স্নেহভাজন নুরুল আনোয়ার চৌধুরী। এই কমিটি বাঁশখালীকে ঐ সময় আওয়ামী লীগের দূর্গে পরিণত করেন এবং ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার গুরু দায়ীত্ব পালন সহ ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত এই কমিটি কার্যকর ছিল।
রাজনীতিতে তাঁর শুদ্ধাচারের একটি উদাহরণ তুলে ধরার লোভ করছি। ২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী সুলতানুল কবির চৌধুরীকে বাঁশখালী থানা আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীরা নির্বাচনী কৌশল নিয়ে কিছু নীতিনির্ধারণী সুপারিশ করতে চায়। সুপারিশ বা বিষয়গুলো কার্যকরভাবে উপস্থাপনের জন্য তারা অভিভাবকতুল্য প্রবীণ রাজনীতিবিদ শ্রদ্ধেয় আবদুচ ছবুর সাহেবের সাহায্য নিতে চান। অর্থাৎ, তিনি প্রস্তাবিত সুপরিশগুলো দলীয় প্রার্থীকে জানাবেন। এ কাজে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তাবকরা আমার কাছে আসেন। আমি মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শফিকুল ইসলাম সহ আরো কয়েকজনকে নিয়ে শ্রদ্ধেয় আবদুচ ছবুর সাহেবের নিকট গেলে তিনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “মুজিব, দল বিশ্বাস ও আস্থা রেখে সুলতানকে নমিনেশন দিয়েছে। সুলতান আগেও কয়েকবার নির্বাচন করেছে, একবার এম.পি হয়েছে। তাই তিনি নিজেও এলাকায় প্রচারণা চালানোর ব্যাপারে অভিজ্ঞ। এ বিষয়ে নিশ্চয় তার একটা পরিকল্পনা আছে। ঠিক নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে একজন প্রার্থীকে মৌলিক বিষয়ে কঠিন পরামর্শ দেওয়া ঠিক হবে না। এতে সে বিব্রত হতে পারে। তদুপরি নির্বাচনে হারলে পরে প্রার্থী সব দোষ আমাদের ঘাড়ে তুলে দেওয়ার আশংকাও থাকে। তাই প্রার্থীকে তার নিজস্ব পরিকল্পনা মতো কাজ করার জন্য সহযোগিতা দিয়ে যাওয়াই এখন আমাদের কাজ। আর যদি তিনি পরামর্শ যাঁচনা করেন তখনই তাকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া যায়। আপাততঃ আমরা তাকেই অনুসরণ করি”। তাঁর কথায় কেউ খুশী, কেউ না–খুশী। কিন্তু আমি বিমোহিত। বুঝলাম, এ জন্যই প্রবীণ ও বিজ্ঞের পরামর্শ সামনে রেখে কাজ করার জন্য শাস্ত্রীয় নির্দেশ আছে। উল্লেখ্য, সেই নির্বাচনে সুলতানুল কবির চৌধুরীকে নিয়ে আমাদের নৌকা মার্কা পরাজিত হয়।
শ্রদ্ধেয় আবদুচ ছবুর সাহেবের পরিবারটি আলোকিত সদস্যদের নিয়ে এলাকার একটি আদর্শ পরিবার নামে খ্যাত। তাঁর স্ত্রী বিশিষ্ট লেখিকা ও নারী নেত্রী প্রয়াত মমতাজ সবুর। মমতাজ সবুর এর পিতা প্রথিতযশা এডভোকেট, ঢাকা হাইকোর্ট বার–এর এক কালের প্রেসিডেন্ট এ.এইচ.এম. মোফাখ্খার, যিনি দেশ ভাগের আগে কলকাতা হাইকোর্টেই আইন পেশা শুরু করেছিলেন। সবুর দম্পতির ১ম সন্তান এ.এইচ.এম কফিল উদ্দীন, (সাবেক জি.এম–এলিট পেইন্ট লিমিটেড), ২য় সন্তান বোরহান উদ্দিন জাহেদী (সাবেক বিচারপতি–সুপ্রীম কোর্ট), ৩য় সন্তান শাহীন সবুর (সাবেক শিক্ষিকা), ৪র্থ সন্তান নাসরীন সবুর (সাবেক অধ্যক্ষ) ৫ম সন্তান – তহুরীন সবুর ডালিয়া (সাবেক অধ্যক্ষ, এনায়েত বাজার মহিলা কলেজ), ৬ষ্ঠ সন্তান – এ.এইচ.এম. জিয়াউদ্দিন (এডভোকেট), ৭ম সন্তান নাহিদ শিরিন (ব্যাংকার, এ.বি ব্যাক)।
সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে উচ্চ স্তরে অবস্থান সত্ত্বেও অত্যন্ত মহৎ এই মানুষটি এতই বিনয়ী ছিলেন যে, একেবারে সাধারণ মানুষের মতো সাধারণ মানুষদের মাঝে মিলেমিশে জীবন যাপন করে গেছেন। যদিও এডভোকেট আবদুচ ছবুর সাহেব পারিবারিকভাবেই জ্ঞানী গুণী বিদগ্ধজনদের বলয়ের একজন ছিলেন। জ্ঞানীরা জ্ঞানের অলোকবর্তিকা বহন করে এগিয়ে যান, তেমনই একজন লোক ছিলেন তিনি। তাঁদের মত লোকেরাই ‘স্মরণীয় বরণীয়’ হয়ে থাকেন সুদূর আগামী প্রজন্মের কাছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিক্ষা সংগঠক।










