একজন জামাল উদ্দিন নিঃস্ব হলেন যেভাবে

অনলাইনে পার্ট টাইম চাকরির লোভনীয় প্রস্তাব ।। সক্রিয় চক্র, হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা ।। সতর্ক থাকা এবং ব্যক্তিগত তথ্য না জানানোর পরামর্শহাসান আকবর

হাসান আকবর | বুধবার , ১৩ মার্চ, ২০২৪ at ৮:০৯ পূর্বাহ্ণ

অনলাইনে পার্ট টাইম চাকরি কিংবা ঘরে বসে আয় করার লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। হোয়াটসঅ্যাপে কল করে অপরিচিত মানুষের মাঝে শিকার খুঁজে বেড়ায় তারা। ফাঁদে পড়ার মতো কাউকে পেলে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ছে। এই ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিন ঘটছে নগরীসহ চট্টগ্রামের সর্বত্র। অনেকে সর্বস্ব খুঁইয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন। আবার কেউ কেউ প্রতারকদের আইনের আওতায় আনার জন্য পুলিশের শরণাপন্ন হচ্ছেন। তবুও থেমে নেই চক্রটির প্রতারণা। নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার জামাল উদ্দিন খান ডবলমুরিং থানায় দায়েরকৃত অভিযোগে ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। গার্মেন্টসে চাকরি করা জামাল উদ্দিনের সমস্যা হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। এ অবস্থায় হোয়াটসঅ্যাপের একটি কল আসে তার কাছে। ০১৫৩১৩৬৩৫২১ নম্বর থেকে আরিফ পরিচয় দেওয়া এক ব্যক্তি তাকে ঘরে বসে বাড়তি আয়ের প্রস্তাব দেয়। তাকে বলা হয়, দৈনিক অন্তত পাঁচশ টাকা আয় হবে, এমন একটি অনলাইন পার্ট টাইম চাকরি তিনি করবেন কিনা। এই খাতে বেশি সময় দিতে হবে না। শুধু মোবাইলে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেই ব্যবসা হবে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করা জামাল উদ্দিন খানের সাম্প্রতিক খারাপ সময়ের মাঝে দৈনিক ৫শ টাকা বাড়তি আয় লোভনীয় বলে মনে হলো। ফলে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি কাজ করতে চান জানানোর পর তাকে একটি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্ট খুলতে বলা হয় এবং সেখানে কাজ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানানো হয়। জামাল উদ্দিনকে অনলাইনে পণ্য কেনাবেচার একটি ট্রেডিং ওয়েবসাইটের সদস্য করা হয়। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন পণ্য বিক্রির কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়। পণ্য বিক্রি করার সাথে সাথে তিনি ঘরে বসে কমিশন পেয়ে যাবেন বলে জানানো হয়।

টেলিগ্রামে তাকে একটি ওয়েবসাইটে লগইন করতে বলা হয়। তার ফোন নম্বর ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাকাউন্টের নম্বর দিয়ে সেই সাইটে লগইন করেন। লগইন করার সময় তার টাকা লেনদেনের মোবাইল অ্যাপের প্রোফাইলের পিন নম্বরও ওই ওয়েবসাইটে দেওয়ার অপশন পূরণ করতে হয়। জামাল তাদের মেসেজে দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী একের পর এক সব ধাপ পূরণ করেন। তাকে টোপ হিসেবে কাজ শুরু করার আগে একটি উপহার পাঠানো হয়। একটি পণ্য কেনাবেচার ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়।

জামাল উদ্দিন খানকে ওই ওয়েবসাইট থেকে নির্দিষ্ট পণ্য কেনার এবং সেই সাইটের মাধ্যমে সেগুলো বিক্রি করার কাজ দেওয়া হয়। কত টাকার মধ্যে কোন পণ্য কিনতে হবে সেটিও তাকে ঠিক করে দেওয়া হতো টেলিগ্রাম মেসেজের মাধ্যমে।

শুরুতে ২ হাজার টাকার একটি পণ্য কিনে সাথে সাথে তা বিক্রি করে ৬০০ টাকা কমিশন পান। এরপর তাকে ওই সাইট থেকে ৫ হাজার টাকা একটি পণ্য কিনতে বলা হয়। অ্যাকাউন্টে থাকা টাকা দিয়ে সেটি কেনার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যায়। এই বিক্রি থেকে তাকে ১৫শ টাকা কমিশন দেওয়া হয়। অ্যাকাউন্টে টাকা পাওয়ার মেসেজ আসায় জামাল উচ্ছ্বসিত হন। কোনো অবিশ্বাস ছিল না।

এর পরের ধাপে তাকে ৮০০০ টাকার, পরের ধাপে ১৯ হাজার ৮শ টাকার পণ্য কিনতে বলা হয়। এভাবে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা দামের পণ্যও ওই সাইটে রয়েছে। কিন্তু পরে টাকাগুলো আর তাকে দেওয়া হয় না। তাকে বলা হয় আরও দুটি ‘টাস্ক’ সম্পন্ন করলে সব টাকা একসাথে তুলে নিতে পারবেন। পরের টাস্কে তাকে আরো বড় অংকের বিনিয়োগ করে পণ্য কেনার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বলা হয়, ওই পণ্য বিক্রি করলে সব টাকা একসাথে পেয়ে যাবেন। তা করার পর বলা হয় আরো একটি টাস্ক করতে হবে। এতে আরো বড় অংকের টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। আগের আটকে যাওয়া টাকা উদ্ধার করতে ভাই, বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজন থেকে ঋণ করে একের পর এক টাস্ক পূরণ করে যাচ্ছিলেন জামাল উদ্দিন খান। এভাবে বিকাশ এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তার কাছ থেকে ১১ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। পরে আরো তিন লাখ টাকা প্রদান করলে সব টাকা একসাথে পাওয়া যাবে বললে তার সন্দেহ হয়।

জামাল উদ্দিন আজাদীকে বলেন, তাদের কিছু কাজে আমার সন্দেহ হচ্ছিল। কিন্তু কিছু করারও ছিল না। বলা হচ্ছিল, পরবর্তী টাস্কটি না করলে আমার ইতোপূর্বের সব টাকা জব্দ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে একটির পর একটি ধাপ করে গেছি। বিশ্বাস ছিল, টাকাগুলো বিকাশে দিচ্ছি, ইউসিবিএলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিচ্ছি। ভুয়া কেউ তো আর বিকাশ বা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারবে না। নিশ্চয় এদের ব্যবসা বাণিজ্য বা পরিচয়পত্র ব্যাংকে রয়েছে।

তিনি জানান, তাদের দেওয়া বিকাশ নম্বর এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৯ ধাপে ০১৮৭৬১৭৯২৩৭, ০১৭৭৭৪৩৫৫২৪ ও ০১৮২৪৪৮০০৫৮ নম্বরে টাকা প্রেরণ করেছি। এছাড়া মোহাম্মদ রুবেল মিয়া নামে এক ব্যক্তির ইউসিবিএল ব্যাংকের কামাল বাজার শাখার অ্যাকাউন্ট নম্বর ০৭৮৬৩২৪১০০০৫৬৯৭৩২ এবং একই ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখার সানজিদা সুলতানা সুইটির অ্যাকাউন্ট নম্বর ০০৪৩২০৯০০০০৫৪৬৪৮এ প্রদান করেছি। এসব বিস্তারিত তথ্যউপাত্ত উল্লেখ করে তিনি ডবলমুরিং থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন। পুলিশ বিষয়টি জিডি হিসেবে রেকর্ডভুক্ত করেছে। ৭ মার্চ রেকর্ডকৃত জিডি নং ৪৭০। পুলিশ জিডি রেকর্ড করার কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

জামাল উদ্দিন খান আজাদীকে বলেন, ধার দেনা করে টাকা খুঁইয়েছি। এখন পাওনাদারদের চাপে অসহায় বোধ করছি। এভাবে প্রতারিত হব কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি। নিজের টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি তার মতো মানুষকে এই ধরনের প্রতারণা থেকে রক্ষা করতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, জামালউদ্দিন একজন নন, হাজার হাজার জামাল উদ্দিন এভাবে প্রতারিত হয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছেন। অনলাইন প্রতারকচক্র সক্রিয়। লোভের বশবর্তী হয়ে অনলাইন প্রতারকদের ফাঁদে পড়া অনেক মানুষ এখন দিশেহারা। তিনি সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন।

একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, সাইবার প্রতারণা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। অপরিচিত নম্বর থেকে লোভনীয় অফারের কোনো ফোন বা মেসেজ এলে সতর্ক হতে হবে। সবার সাথে কথা যেমন বলার দরকার নেই, তেমনি কোনো অবস্থাতেই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা উচিত নয়। একমাত্র সতর্কতার মাধ্যমে এসব প্রতারকের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর টিনুসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা
পরবর্তী নিবন্ধঅভিজাত হোটেল রেস্টুরেন্ট থেকে অলিগলি সবখানে ক্রেতাদের ভিড়