নারীর ইমেজ, ইমেজে নারী
সাদিয়া মেহজাবিন
পর্ব–৪
ধূসর প্রান্তরেখা, চোখের সীমানার বাইরেও বালি, পানির খোঁজে দিশেহারা পথিক আর উঁচু প্রাণের সন্ধান, মরুভূমিকে ব্যাখ্যা করা সহজ নয় তবুও যার চোখ আছে দেখার, বাদুড়ের মতো কান পেতে যিনি শুনেন সর্বজনের আত্মার শব্দ, তিনি সহজেই ভেসে যাবেন সে–তরঙ্গে। হয়তো পথিক নন, নন তিনি কবি তবুও দিকশূন্য মরুভূমিতে ঠিকই খুঁজে নেন টুকটাক নথি।
ক্যামেরার এক বিশাল শক্তি আছে, প্রাণ–প্রকৃতির যা কিছুই দেখা–অদেখা সব চাইলেই ফ্রেমে ধরা যায়। ফ্রেমের বাইরেও কিছু রেখে তার নির্যাসটুকু নেওয়া যায়, তবে এর জন্যে যিনি ক্যামেরা হাতে আছেন তার প্রবল স্পর্ধা প্রয়োজন। যন্ত্র এবং প্রাণের এ মেলবন্ধনে নতুন যা কিছু সঞ্চার তার প্রত্যেকটিই একেকটা ইমেজ। আর ইমেজের গল্পে নারী কখনো হয়েছেন অবজেক্ট, কখনো বা অবজেক্টকেই তুলে এনেছেন ফ্রেমে।
সার্বক্ষণিক পাশে ক্যামেরা হাতে বাবা ঘুরছেন, হুটহাট নিয়ে নিচ্ছেন কিছু ইমেজ, তবে বাবা হয়তো জানতেন না তাঁর মেয়ের ভেতর এই ঢেউ হানা দেবে। কেবল তো ঢেউ নয় ছোট্ট সে গৌরি গিলের ভেতর চলেছে তুফান।
যে বিশ্বে আচমকা হানা দেয় দুর্ভিক্ষ, সামাজিক সমতা থাকে হুমকির মুখে সে বিশ্বে ক্যামেরার লেন্সকে তাক করে মানবতার কথা বলা জটিলই বটে। তবুও ক্যামেরা অনবরত মুখিয়ে ছিল সমাজের অসংলগ্ন, ভারসাম্যহীন, মানুষের মর্মান্তিক দৃশ্যে। আর এই স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন গৌরি গিল।
১৯৭০ সালে ভারতে জন্ম নেওয়া গৌরি, অন্যতম সম্মানিত আলোকচিত্রী যিনি তাঁর কাজের প্রতি ভীষণ প্রাণবন্ত। গৌরি দেশের সীমানা পেরিয়ে কাজ করেছেন বহিঃবিশ্বে। গিল ‘প্রিক্স পিকটেট ফটোগ্রাফি এন্ড সাসটেইনিবিলিটি এওয়ার্ড’ এর দশম আসরের বিজয়ী। পেয়েছেন কানাডার গ্র্যাঞ্জ (এৎধহমব) পুরস্কারও। জুরি বোর্ডের মতে, গিলের কাজগুলো একই সাথে ভীষণভাবে শক্তিশালী এবং সাবজেক্টের সাথে নিখুঁতভাবে সম্পর্কিত, যার প্রভাবে ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলো এখন আমাদের কাছে প্রধান নথি হিসেবে ধরা দিয়েছে।
রাজস্থানের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দিনের পর দিন শিক্ষকের দ্বারা নির্যাতনের শিকার এক ছোট বালিকা, সে বালিকা আর স্কুলের ছবি তুলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলো গিল, রাজনৈতিক অনেক মঞ্চে লিখিত ও ফটোগ্রাফিক দলিল জমা দিয়ে চেষ্টা করেছে ন্যায্য অধিকার পাওয়ার। তবে দারুণ বিষয় এ কাজগুলো গিলের প্রথম দিকের, যখন গিলকে হয়তো কেউ চিনতো না।
গিলের কাজের তালিকায় বেশিরভাগই প্রতিকূল পরিবেশে করা, যেখানে মানবতা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, সেখানেই ক্যামেরার লেন্স ঘুরিয়ে সম্পূর্ণ বিশ্বকে জানান দিয়েছেন গিল– ‘অনেক হলো, তোমাদের এবার থামতেই হবে।’
‘দ্য আমেরিকানস’ এ গিল তার পরিবার ও বন্ধুদের ছবি তুলে গেছেন একযোগে, যেখানে ভারত থেকে আসা অভিবাসীদের জীবন ও ভাবনাগুলো ফুটে উঠেছে। কেবল জীবনযুদ্ধ নয়, জীবনের আনন্দ–উল্লাসের ছবিও আছে এই সিরিজে।
রাজস্থানের রঙিন মরুভূমির বিচিত্র সব গল্প ‘নোটস ফ্রম ডেসার্ট’ সিরিজে এসেছে গিলের নিজস্ব গল্প হয়ে। ঘটনাগুলো গল্প হয়ে উঠে গিলের ছবিতে, কখনো খুব চড়া কিংবা ম্যাটমেটে। ‘দ্য মার্ক অন দি ওয়াল’, ‘জান্নাত’, ‘বালিকা মেলা’, ‘বার্থ সিরিজ’ ইত্যাদিও গিলের সে গল্পেরই স্রোত।
একজন আলোকচিত্রী কেবল ফ্রেমে চোখটি রেখে ক্লিক করেন এমনটা নয়, তাকে হতে হয় দূরদৃষ্টি সম্পন্ন, ভালো শ্রুতি ও আত্মা–কথনের মিশেলে তবেই তৈরি হয় স্বচ্ছ–সরল–সত্য ইমেজ। ‘নোটস ফ্রম ডেসার্ট’ সেইসব ইমেজকে প্রতিনিধিত্ব করে যা গিলের নিজস্বতাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে।
সুনীল গুপ্ত ও রাধিকা সিং এর সাথে মিলে গিল তৈরি করেছিল, ‘ক্যামেরা–ওয়ার্ক’ নামক একটি মুক্ত পত্রিকার যেখানে দিল্লিসহ অন্যান্য দেশের স্বাধীন সব ছবি ছাপা হতো।
গিল সবসময় চেয়েছিলেন, জনগণের স্রোতে ভেসে, জনগণের কথা বলতে। মানবতার কথা বলতে। গিলের মতে, ফটোগ্রাফির ভবিষ্যতের কথা না ভেবে, ভবিষ্যতের জন্যে ফটোগ্রাফি নিয়ে ভাবা উচিত। কেননা ইমেজের শক্তি এই যে, এর ফোরগ্রাউন্ডে সহজেই পরিবেশের জটিল এবং জরুরি বিষয় স্থাপন করা যায় যা পরবর্তীতে সমাজে সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
গিল যখন ‘হিউম্যান’ নামক সিরিজে কাজ করছিলো তখন তিনি সরাসরি সে ঝুঁকিকে অনুভব করে। শুধু তাই নয়, রাজস্থানের প্রতন্ত গ্রামে কাজ করতে গিয়েও একই কথা বলেন গিল। ‘যদি না আমি এসব গ্রামে আসতাম, একজন শহরবাসী হিসেবে কখনই জানতে পারতাম না, আমাদের পৃথিবী কোনো বাস্তবতার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মরুভূমির মতো স্থানে দরিদ্র ও ভূমিহীন থাকা আপনাকে কতটা জটিল জীবন দিতে পারে তা ভাববার বাইরে, সেই ভূমিতে প্রত্যেকে একে–অপরকে ধরে আছে নিজেদের জীবনবোধ দিয়ে, কখনো নিজে কখনো বা প্রকৃতিই হয়ে উঠছে অন্তিম রক্ষাকর্তা’।
গৌরি আমাদের শৈশবের গল্প বলা সেই দিদির মতো, যার গল্পে সুখ–দুঃখ এবং জীবনের নানান শিক্ষাও রয়েছে। সাদা–কালো কিংবা রঙিন যে ফর্মেই গিল কাজ করুক না কেন, নিজস্ব গল্পের ঢঙে তার ইমেজগুলো যুগ যুগ ধরে আমাদের বাস্তবতার কথা বলে, আমাদের অসম আচরণের কথা বলে।
গৌরি গিল আধুনিক বিশ্বে নারীর ক্ষমতায়নের ইমেজকে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। নারীর ইমেজে যখন সমাজের বাস্তবতা, আর্থ–সামাজিক অবস্থান ফুটে উঠে তখন সে ইমেজকে দমিয়ে রাখা সহজ নয়, কেননা সমাজের অন্যতম প্রতিনিধি গৌরি গিল একই সাথে রাজনৈতিকও, সক্রিয় আত্মবিশ্বাসী ছবিগুলো গৌরির ভিত্তিকে আরও মজবুত করে দেয়।
গৌরি গিলের বেশিরভাগ ইমেজে আমরা দেখতে পাই সরাসরি প্রাণের অবয়ব, প্রাণ থেকে প্রাণে জড়িয়ে আছে কৌতূহল, সুখ, দুঃখ নিয়ে। এ জড়িয়ে থাকা ইমেজের জড় অবস্থান আমাদেরকে ভাবিয়েছে, ভাবাবেও। গৌরি গিল সময়ের উদাহারণ হিসেবে আমাদের মাঝে ধরা দিয়েছে, এখন কেবল খুঁটিয়ে গোড়ায় পৌঁছানো সাথে সমাজের সকল অপশক্তিকে মূল থেকে উপড়ে ফেলা।