একজন ঋদ্ধ প্রমিত মানুষ ড. মাহবুবুল হক

রীতা দত্ত | শনিবার , ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৫:৫০ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভুবনের একজন ঋদ্ধ মানুষ ড. মাহবুবুল হক। তিনি ছিলেন চলনে বলনে পোশাকে আশাকে চিন্তায় চেতনায় একজন পরিশীলিত রুচিবান ব্যক্তি। কৈশোরে ছাত্রাবস্থা থেকেই সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যাপৃত ছিলেন। যা পরবর্তী সময়ে বহুধা বিস্তৃত হয়েছে। এক গভীর জীবনবোধে তাড়িত হয়ে শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছিলেন জীবনের ব্রত হিসাবে। বহু ছাত্রছাত্রী তৈরি করেছেন যাদের মধ্যে অনেকে শিক্ষকতায় এসেছেন এবং সুনাম অর্জন করেছেন। ‘তাঁর পাঠদান কেবল শ্রেণিকক্ষে নয়, যখন তিনি বক্তৃতা মঞ্চে বক্তব্য রাখতেন তখন সভাস্থলটি শ্রেণিকক্ষে পরিণত হতো। আমি নিজে তাঁর সাথে চট্টগ্রাম একাডেমি সহ বহু সংগঠনের আয়োজিত আলোচনা সভায় একই মঞ্চে বসার সুযোগ পেয়েছি, শুনেছি তাঁর সাবলীল বক্তব্য, দেখেছি তাঁর উপস্থাপনার সৌকর্য বহূ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর পঠনের ব্যাপ্তি বিস্ময় জাগায়।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এর সাধনা করেছেন নিরলস। বাংলা বানানের কঠিন জটিল বিষয়কে সহজবোধ্য করেছেন, বাংলা ভাষার প্রমিত বানান রীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন যা আমাদের নিত্য পথ দেখিয়ে চলেছে। বাংলা ভাষার প্রতি আমাদের শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়াবার জন্য সারা দেশব্যাপী দৈনিক প্রথম আলো ‘ভাষা প্রতিযোগ’ এ নামে একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছে। এ কাজেও তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছেন। দশের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে গেছেন, অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার উত্তর দিতেন ক্লান্তিহীনভাবে। বাংলা পাঠ্যপুস্তক সংকলন করেছেন, সম্পাদনা করেছেন। আমি বর্তমানে শিশুকিশোরদের একটি স্কুল পরিচালনায় আছি বিধায় দেখেছি বাংলা ‘আমার বই’ এ বই এ শিশু কিশোরদের উপযোগী কবিতা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধ গ্রন্থিত হয়েছে যা ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের মানস গঠনে সহায়ক।

বাবার কর্মস্থল চট্টগ্রাম হওয়ার কারণে ফরিদপুর থেকে চট্টগ্রামে এসেছেন। চট্টগ্রামে কাটিয়েছেন আমৃত্যু। চট্টগ্রাম ভাষাভাষী না হওয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রামবাসী হওয়ার কারণে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার জন্য তাঁর ছিলো গভীর মমত্ববোধ। তাই ভাষাটির উৎকর্ষ সাধনের জন্য চট্টগ্রাম এর আঞ্চলিক ভাষা পরিষদের সাথে যুক্ত হয়েছেন, গবেষণা করেছেন, চট্টগ্রামে প্রচলিত অনেক শব্দের উৎসেরও সন্ধান দিয়েছেন। যে কাজেই হাত দিয়েছেন তা যত্নে করেছেন এবং নিষ্ঠার সাথে করেছেন। ছাত্র অবস্থা থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে গড়ে উঠেছিল গভীর সখ্যতা। পরবর্তী সময়ে তাঁর পিএইচডি গবেষণার বিষয় বেছে নিয়েছিলেন তিন জন কবির কবিতা যাঁরা শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কথা বলেছেন। (সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সমর সেন, সুকান্ত ভট্টাচার্য) দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি গভীর দায়বদ্ধতার কারণে তিনি সব সময় চাইতেন দেশের কল্যাণ, সমাজের কল্যাণ। আমাদের ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা ছিল। জাতির যেকোনো সংকটে প্রতিবাদী হয়ে পথে নেমেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি একজন সফল সংগঠকও। চট্টগ্রামের অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের তিনি পুরোধা মানুষ। জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, চট্টগ্রাম শাখার সাথে ছিল তাঁর গভীর আত্মিক সম্পর্ক। দীর্ঘদিন সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

সে সময় আমি ত্রিদিব চৌধুরী (টুলু)’র আগ্রহে এ পরিষদের সাথে যুক্ত হয়েছিলাম। সে সুবাদে টুলুর বাসায় দেখা হতো, কথা হতো। তাঁর সুচিন্তিত পরামর্শে পরিষদের কাজ অত্যন্ত সুচারূপে চলতো। আমাদের অপর্ণাচরণ স্কুলের সংস্কৃতিমনা বড়দিদিমণি (প্রণতি সেন), কল্যাণী দিদিমণিদের সাথে তাঁর স্নেহময় সম্পর্ক ছিল। তাঁদের প্রয়াণ বার্ষিকীতে স্মারণানুষ্ঠানে তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি সালেহা ভাবী সহ। বহু সংগঠন তাঁকে সম্মাননা জানিয়েছে অন্তরের তাগিদে। তিনি একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, চট্টগ্রাম একাডেমি পুরস্কারও পেয়েছেন। চট্টগ্রামের মোমিন রোড এ ‘কথাকলি’ এ নামে তাঁর অত্যন্ত মানসম্মত একটি বই বিপণি ছিল। প্রায় যেতাম ব্যতিক্রমী বই এর খোঁজে। সেখানে প্রায় তাঁর দেখা পেতাম। এখন আর সেই বিপণি নেই। জীবৎকালে বহুভাবে তিনি নিজেকে উন্মোচিত করেছেন এবং সার্থকভাবে। Plain living, high thinking ছিলো তাঁর জীবনের নিয়ামক। কোন বাহুল্য ছিলো না, অত্যন্ত সাধারণ জীবন যাপনঅথচ অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন তিনি। বহু অভিধায় পরিচিত এ মানুষটি নিজ গুণে চট্টগ্রামের সম্পদ হয়ে থাকবেন।

লেখক

শিক্ষাবিদ, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে
পরবর্তী নিবন্ধভূমিকম্প মোকাবিলায় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি জরুরি