একজন আলোকবর্তিকা ফাহমিদা আমিন

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:০৩ পূর্বাহ্ণ

স্মৃতির পাতায় ধুলো জমে, কালের স্রোতে হারিয়ে যায় অনেক নাম। কিন্তু কিছু কিছু নাম নক্ষত্রের মতো এতো উজ্জ্বল থাকে, ধুলো জমলেও তা স্পষ্টই অবলোকন করা যায়। যারা আপন আলোয় চিরকাল দীপ্তমান থাকেন। তেমনই ছিলেন ফাহমিদা আমিন তথা সকলের প্রিয় ফাহমিদা আপা।

ফাহমিদা আমিন ছিলেন একাধারে রম্যসাহিত্যিক, সমাজসেবী ও সংগঠক। নারী সমাজের অগ্রগতির এক অনন্য নিদর্শন । তিনি চট্টগ্রামের রোকেয়া নামেও খ্যাত ছিলেন। ফাহমিদা আমিন ১৯৩৬ সালের ১৬ জানুয়ারি খুলনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার স্বামী প্রয়াত বিজ্ঞানী ড. এম আর আমিন। এই দম্পতির ছয় ছেলে। দ্বিতীয়জন লেফটেন্যান্ট কর্নেল এনশাদ ইবনে আমিন পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে নিহত হন। ছেলের মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েছিলেন।

সবক্ষেত্রেই তিনি সার্থক ও সফল। নবম শ্রেণি পড়াকালীন বিয়ে হয় তাঁর। ছয়টি সন্তানের জননী সংসারধর্ম পালন করে, সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। নিজেও অর্জন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। তিনি ছিলেন রত্নগর্ভা। ছিলেন সৃষ্টিশীল এক মানুষ। তাঁর লেখা আমাদের সাহিত্যের সম্পদ হয়ে থাকবে।

পুরুষশাসিত সমাজে কীভাবে নারী মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে তা ফাহমিদা আমিন শিখিয়ে গেছেন । তিনি বিভিন্ন বিষয়ে সাহিত্যচর্চা করেছেন। কিন্তু রম্য রচনায় তিনি পাঠকের সাথে বন্ধন গড়ে তুলেছেন। তার ভেতরে যে প্রবাদ আর শ্লোকের ভাণ্ডার একেকটা রম্য রচনায় তিনি অবলীলায় ব্যবহার করেন। সেখানে তার তুলনা তিনি নিজেই। অসাধারণ বক্তব্য, চমৎকার রসালো যুক্তিভরা উপস্থাপনা।

তিনি গল্প, গান, কবিতা, শিশুতোষ সাহিত্য, ছড়া, স্মৃতিকথাসহ অনেক বিষয়ে লিখেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে ‘নিমমধু’, ‘অনিবার্যকারণবশত’, ‘মনের আঙ্গিনায়’, ‘মৌ ঝুর ঝুর’, ‘বার্মিংহাম থেকে লিখছি’, ‘করাচি প্রবাসে’, ‘রঙে রঙে বোনা’, ‘প্রজাপতি রং ছড়ায়’, ‘ঝালে ঝোলে অম্বলে’ ইত্যাদি। তিনি তাঁর লেখার স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, সম্মাননা। স্বর্ণপদকে সম্মানিত হয়েছেন বহু সংগঠন থেকে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। আরো বহুসংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২২টি এর মধ্যে নয়টিই ‘রম্যরচনা’। প্রথম গ্রন্থ ‘নিমমধু’ ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত এবং শেষ গ্রন্থ ‘সাজতে সাজতে ফিঙ্গে রাজা’ প্রকাশিত ২০১০ সাল। এটিও রম্যরচনা।

প্রয়াত সাহিত্যিক সুচরিত চৌধুরীর মূল্যায়নে ফাহমিদা আমিন বাংলাদেশের একমাত্র লেখিকা যাঁর রম্যরচনা রসজ্ঞ পাঠকপাঠিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ নিমমধু’র ভূমিকায় প্রয়াত আবু হেনা মোস্তফা কামাল লিখেছেন ‘সমকালীন জীবনের বিপুল নৈরাশ্য ও নৈরাজ্যের ভেতরে দাঁড়িয়েও কেউ যে হাসতে পারছেন এবং অন্য সবাইকে হাসিতে উদ্ভাসিত করতে চাইছেন এটি কম কথা নয়’।

আর অনিবার্য কারণবশত: গ্রন্থটির পর্যালোচনায় সুচরিত চৌধুরী লিখেছেন, ‘গ্রন্থটি অধ্যয়ন করতে করতে শিয়রে ছায়া জাগে পরশুরামের, শিব্রামের, আবুল মনসুর আহমেদ, সৈয়দ মুজতবা আলীর, বিভূতি মুখার্জীর, রূপদর্শীর লেখিকার সাজানো রম্য বিতানটি দেখে মনে হলো আমরা বাঙালিরা শুধু কাঁদতে জানি না, হাসতেও জানি’।

তিনি ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জানুয়ারি বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করেন। ওখানেই তাঁকে কবর দেয়া হয়।

গত ১৮ জানুয়ারি লেডিস ক্লাবে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ আয়োজন করেন স্মরণসভার। লেখিকা সংঘের বর্তমান সভাপতি জিনাত আজম আপা ছিলেন ফাহমিদা আপার খুব কাছের মানুষ। উনি তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন, ফাহমিদা আমীন আপার মতো মানুষ দ্বিতীয় আর নেই। সর্বগুণে গুণবতী। সংসার সামলিয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি, লেখালেখির সাথে যুক্ত থেকে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা এতো সহজ নয়। রত্নগর্ভা একজন।

উনার সান্নিধ্যে যারা ছিলেন, তারাও আবেগপ্রবণ স্মৃতিচারণ করেছেন। সবার একটাই ক্ষোভ ছিল রাষ্টের কাছে কোনো স্বীকৃতি পাননি বলে। সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও ওনাকে নিয়ে বড় পরিসরে কোনো আয়োজন হয়নি। অন্তত বেগম রোকেয়া পদক ওনার প্রাপ্য ছিল।

তবে চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ ওনার নামে একলাখ টাকার বৃত্তি ঘোষণা করেছেন।

আশা করবো এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে বড় পরিসরে সবার মিলিতভাবে আয়োজনে ওনাকে স্মরণ করা হবে। তাঁর স্মৃতি যেন কেবল কিছু পুরোনোদের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁকে তুলে ধরতে হবে। তাঁর সৃষ্টিগুলো নতুন করে আবার পাঠকের কাছে ফিরে আসুক।

শ্রদ্ধা জানাই বাংলার নারীদের চোখ, কান খুলে দেয়ার অগ্রদূত ফাহমিদা অমিন

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীদের প্রতি সম্মান ও যত্ন থাকুক সকল পরিবারে
পরবর্তী নিবন্ধবোয়ালখালীতে জিয়াউর রহমানের জন্মবার্ষিকী উদযাপন